আম্বাপুরের গল্প: অনুষ্টুপ শেঠ

আম্বাপুরের গল্প: অনুষ্টুপ শেঠ

আম্বাপুরের মাঠে জব্বর খেলা চলছিল সেদিন। মুহুর্মুহু গোল হচ্ছিল আর মাঠশুদ্ধু কালোকোলো ডিগডিগে খেলোয়াড়রা অমনি সবাই মিলে “গোওওওওওওল” বলে ডিগবাজি খাচ্ছিল শূন্যে।
টিম-ফিমের বালাই নেই, যে পারে যেদিকে ইচ্ছে বলে লাথি মারে। ওই করতে করতে বল দু’দিকের তেকাঠিতে কখনও গলে গেলেই গোল। যেই করুক, সবার গোল। যার গোলেই হোক, সবাই-ই জেতে। ভারি ভালো ব্যবস্থা, কেউ রাগ-মাগ করার সুযোগ পায় না। মাঠের তিন দিক ঘিরে ঝুপসি গাছের সারি – নিম, তেঁতুল, শ্যাওড়া, বট। তার ছায়ায় ছায়ায় কত দর্শক বসে বসে দেখছে, হাততালি দিচ্ছে, খুব আনন্দ হলে ঘোঁতনের পিসির মতো উঠে দাঁড়িয়ে দু’পাক নেচেও নিচ্ছে। কেউ কিছু মনে করে না এখানে।
মনে আর করবেই বা কে! জনমনিষ্যি নেই তো এ দিগরে!
কী বলছ? জনমনিষ্যি নেই তো খেলছেই বা কারা, আর সে খেলা দেখছেই বা কারা?
আহা, আমি কি একবারও বলেছি তারা মনিষ্যি, মানে মানুষ?
আরে শোনো শোনো পালিও না! ভূত হলেও, ওরা সবাই-ই খুব সজ্জন। ওদের কথা শুনে অমন করে পালালে খুবই অপমানিত বোধ করবে তো হে! শুনে যাও, এসব গপ্পো আর কারও কাছে পাবে না!
আম্বাপুর গ্রামের নামই শোনোনি তোমরা তো? শোনার কথাও নয়। মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, মাত্রই কয়েক ঘর চাষি-গোয়ালা-বামুন ছিল। সে তারা তো কবেই কলেরা, ডেঙ্গি আর নিউমোনিয়ায় ভুগে হেজেমজে গেছে। যে ক’জন যায়নি, তারা চম্পট দিয়েছে। ফলে অমন লকলকে চাষজমি সব আগাছার জঙ্গল, পুকুর পানাসর্বস্ব, গেরস্তর পুঁইমাচা বেগুনক্ষেত সব শুকিয়ে নারকেলদড়ি।
জনমনিষ্যি তো গেল, কিন্তু ছেড়ে যেতে পারল না সদ্য পালে পালে মারা যাওয়া ভূতের দল। সাধের গাঁয়ের এমন হাল দেখে তাদের ভূতোকান্না দেখলে স্বয়ং শিবঠাকুরেরও চোখে জল আসত গো! শেষে একদিন চোখের জল-টল মুছে, গলা খাঁকরে বড়ো বেম্মদত্যি, মানে ভবনাথ চক্কত্তির ভূত, বেঁচে থাকতে যিনি গাঁয়ের মুখের ছোট্ট মন্দিরের মিষ্টি দেখতে অন্নপূর্ণা মায়ের পুজো করতেন, উঠে দাঁড়ালেন।
“শোনো হে সব। ওরা যায় যাক, আমরা তো আছি! আমরা থাকতে কি আমাদের গাঁয়ের এমন হাল হতে দেব?”
চাদ্দিকের হেটো ভূত মেঠো ভূত পেতনি শাকচুন্নি মামদো বেম্মদত্যি মেছো ভূত সব্বাই একবাক্যে বলে উঠল, “কক্ষনো না!”
ব্যস। সেই থেকে ভূতেরা এসে আবার যে যার বাড়ির ভার নিল। ঘরদোর পরিষ্কার করল, বাগানে আগাছা সাফ করল, কুয়ো ধুয়ে মুছে চকাচক করে রাখল, যদি কোনো অতিথ আসে কখনও জল দিতে হবে তো! পুকুরের পানা সাফ করল, আর যদিও চাষ করল না, কিন্তু চাষের জমি জুড়ে হরেক রঙের ফুল ফুটিয়ে ফেলল। সাজুর ক্ষেত জুড়ে দোপাটি, তো মনুয়ার ক্ষেত জুড়ে চন্দ্রমল্লিকা।
ওদের তো রান্না খাওয়ার বালাই নেই, সারাদিন তাই এসব কাজকম্মো করে আর বিকেল হলে এই বড়ো মাঠটায় এসে খেলাধুলো করে, কখনও বা সবাই মিলে নাচগান করে।
আজও তেমন ফুটবল খেলা চলছিল। পটকে সতেরো নম্বর গোলটা করার পর রেফারি পুকুরপাড়ের বেম্মদত্যি খেলা শেষ বোঝাতে ফটাস ফটাস করে হাততালি দিয়ে দিলেন। সে হাততালির শব্দ হুইইইই দূরে টাউন মার্কেটেও শোনা যায় তা জানো? লোকে ভাবে পুলিশে গুলি ছোঁড়া প্র্যাকটিস করছে।
তারপর সব গুছিয়ে-টুছিয়ে নিয়ে, ঘোঁতনের পিসিকে ইস্তক ধরে-বেঁধে গাছের মগডাল থেকে নামিয়ে সবাই মিলে বাড়ি রওনা দিয়েছিল রোজকার মতোই। এমন সময়েই, সেই কাণ্ডটা হল।
বলব?
নাকি থাক?
ওরে বাবা, অমন করে জামা টানলে ছিঁড়ে যাবে যে! বলছি, বলছি, রোসো!
হয়েছে কী, গ্রামের কাছাকাছি এসে শোনে কারা যেন কথা বলছে!
অ্যাঁ! এখানে আবার কে কথা বলবে এই ভর সন্ধ্যাবেলায়? ওরা তো সব্বাই মাঠে গেছিল।
মেজ বেম্মদত্যি আবার সবাইকে দাঁড় করিয়ে মাথা গোনে। হ্যাঁ, তেতাল্লিশটাই হচ্ছে তো! তাহলে?
আশপাশের গাঁ থেকে ভূতেরা এসে ওদের বাড়ি দখল করছে না তো?
হাঁই হাঁই করে বাকি পথটুকু পেরিয়ে এসে যা দেখল, তাতে তো ওদের চক্ষু চড়কগাছ!
মানুষ!
তিন তিনটে মানুষ ওদের ডেরায়! একটা আখাম্বা লম্বা, ঝুলো গোঁফওলা লোক, সবুজ পেন্টুল আর লাল জামা পরেছে। একটা ছোটোখাটো, গোল মুখের চুলে বিনুনি করা মিষ্টি মেয়ে। আর একটা ভারিক্কি মোটাসোটা বুড়ো লোক।
ঘুরঘুর করছে খালি না, কী সব মাপছেও আবার!
তবে রে! মজা দেখাচ্ছি দাঁড়াও। আমাদের জায়গা দখল করা!!!
তেড়ে যাচ্ছিল ভূতের দল। বড়ো বেম্মদত্যি ইশারায় থামালেন। সবাইকে যেতে হবে না, আমি যাচ্ছি দাঁড়া।
ভূত তো, ইচ্ছেমতো চেহারা ধারণ করতে পারে ওরা। কিন্তু তার জন্য খানিকটা সময় লাগে।
নিজের সবচেয়ে ভয়াল চেহারাটা তৈরি করতে করতে লোকগুলোর কথাবার্তা শুনছিলেন বড়ো বেম্মদত্যি। এদের এখানে একটা হোটেল গোছের কিছু খোলার ইচ্ছে, যা বুঝলেন।
“দত্তদা বুঝলেন, রিসেপশনটা এইখানে বসাতে হবে। লোকে গাড়ি নিয়ে পুরো চলে আসতে পারে যাতে।”
“পুকুরটা এদ্দিন পড়ে থেকেও কী সুন্দর সাফ দ্যাখো রবিন, একটু পদ্মের চাষ করে নিলে কী সুন্দর যে হবে!”
“রবিনদা, ঘরগুলো যেমন যেমন আছে, মোটামুটি সেই বরাবরই আমরা কটেজ করব, তাই তো? এরকম বাগান কী করে রয়ে গেছে বলো তো? এইগুলো রেখে দেব বুঝলে, একটু কিচেন গার্ডেনও করে নিতে পারলে আমাদের রান্না একদম ফ্রেশ সবজি দিয়ে হবে, খুব পছন্দ করবে লোকে।”
“সবই তো ভালো রে বিদিশা, কিন্তু এত কিছু করতে কত লোক লাগবে ভেবে দেখেছিস? খরচাটাও তো ভাবতে হবে!”
বড়ো বেম্মদত্যি একটু দ্বিধায় পড়ছিলেন। জায়গাটা যদি মানুষের কাজে লাগে, তবে কি বাধা দেওয়া উচিত? ওদের বাস করার জন্য তো মাঠের ধারের গাছ বা এদের এই কটেজের ছাত রইলই।
কিন্তু একগাদা লোক এসে যদি ওদের এতদিনের যত্নে তৈরি করা বাগান তছনছ করে দেয়? ফুল পাতা ছেঁড়ে, পুকুরে নোংরা ফেলে, সব খারাপ করে রাখে? এদ্দিনের ভূতজীবন যাপন করে এইটে বুঝে গেছেন তিনি, মানুষ বড়ো খারাপ জীব। নিজেরটুকু ছাড়া কারও কথা ভাবে না। শীতকালে এক আধবার ঐ মাঠে পিকনিক পার্টি এসেছে, দেখেছেন তো! চলে যাবার পর মাঠ জুড়ে এঁটো কাঁটা কাগজ খোসা প্লাস্টিকের প্যাকেট বোতল … কী না ছড়িয়ে থাকে! ছিঃ!
না, না, এদের এমন ভয় দেখাবেন যে আর কখনও এমুখো হবেই না!
ভয়াল চেহারাটা প্রায় হয়ে এসেছে। হাতের পাকানো লাঠিটা তুলে দেখা দিতে যাবেন, শুনলেন মেয়েটা বলছে, “দত্তদা দেখুন, এইখানটায় বাচ্চাদের প্লেগ্রাউন্ড করলে খুব ভালো হবে না? দুটো স্লিপ, দুটো দোলনা বেঁধে দেবে ঐ গাছের ডালে…”
বড়ো বেম্মদত্যির হাতটা আপনি নেমে আসে। ঐ গাছটায় টুকটুকির দোলনা বাঁধা হত। খিলখিল করে হাসত মেয়েটা দুলতে দুলতে।
টুকটুকি তাঁর একমাত্র নাতনি। তিনি মারা যাবার পর টুকটুকির বাবা মা তাকে নিয়ে টাউনে চলে গেছিল সেই কবে, আর দেখেননি মেয়েটাকে।
ঐ গাছে দোলনা করলে আবার বাচ্চারা আসবে। কত বয়েসের, কত রকম।
কদ্দিন এ গ্রামে কোনও নতুন শিশু আসেনি!
মত পালটে ফেলতে বেশিক্ষণ লাগল না। বাকি ভূতেদের কথা বলে রাজি করাতেও বেশিক্ষণ লাগল না।
ভয়াল ভয়ংকর রাগী ব্রহ্মদত্যির বদলে, গাছের আড়াল থেকে যে লোকটা বেরিয়ে এল ওদের সামনে, তার সৌম্য হাসি হাসি মুখ, চোখে চশমা, পরনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি।
“আপনারা লোক রাখা নিয়ে কথা বলছিলেন যেন শুনলুম? সে ভার আমার উপর ছেড়ে দিন, আশপাশের গরীব গুর্বো লোক আছে অনেক, আমি ব্যবস্থা করে দেব সব, কিচ্ছু দেখতে হবে না আপনাদের। সব কাজ পারবে, একটু দেখিয়ে দেবেন ব্যস। আর খুব সৎ, খুব পরিশ্রমী, চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি করবে, মাইনে আপনারা যা দেবেন তাই মুখ বুজে নেবে। চলবে?”
চলবে মানে! দত্তদা হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন তো! তক্ষুণি সব কথাবার্তা পাকা করে, সামনের মাস থেকেই কটেজ বানানো শুরু করবেন, তিন মাসে বুকিং চালু হয়ে যাবে সব ঠিক হয়ে গেল।
“তবে, একটা শর্ত আছে কিন্তু আমাদের। যতই হোক আমাদের গাঁ, ইয়ে মানে, আমাদের অঞ্চল তো! বুকিং করার সময়েও বলে দেবেন এখানে কোনোরকম গাছপালা ছেঁড়া, নোংরা করা চলবে না। সেরকম দেখলে কিন্তু আমার লোকেরা খেপে গিয়ে মারধর করে দিতে পারে!”
হাত তুলে অভয় দেন দত্তদা।
“নোট করো বিদিশা, আমাদের পেজে বড়ো বড়ো করে লেখা থাকবে ইকো ফ্রেন্ডলি না হলে ফাইন দিতে হবে। কোনোরকম পরিবেশ দূষণ বরদাস্ত করা হবে না।”
ওরা চলে যেতে ভূতেরা হইহই করে বেম্মদত্যিকে ঘিরে ধরল। সব্বার মনে খুব আনন্দ, ওদের জায়গাও সুন্দর থাকবে, আবার ওরাও থাকবে!
কী হল? গপ্পো তো শেষ বাপু, এবার একটু খেলতে যাও দিকি বল-টল নিয়ে! রোজ দৌড়ঝাঁপ করলে শরীর মন দুই ভালো থাকে জানো না?
আরেকটা কথা, এর পর থেকে মা-বাবার সঙ্গে রিসর্টে বেড়াতে গেলে খুব সাবধান কিন্তু। মানে আম্বাপুরটা কোথায় আমি ঠিক জানি না তো, কোন রিসর্টে যে তেনারা মালি ওয়েটার ঘরসাফাই মাসি হয়ে কাজ করছেন তাও জানি না তাই! ভুল করে গাছের পাতা ফুল ছিঁড়ে ফেললে, পুকুরে জঞ্জাল ফেললে, এখান ওখানে খালি বোতল ফেললে যদি তারা দেখে ফেলে? শুনেছি, ভূতের গাঁট্টা খেলে খুব ব্যথা লাগে কিন্তু!
___

Leave a Comment