আলোছায়া

বহুকাল বাদে খাস উত্তর কলকাতায় ঘুম ভাঙল আজ। সেই পুরোনো আমলে যাকে প্রপার কলকাতা বলত – ইদিকে বাগবাজার উদিকে ধর্মতলা, আর এপাশে মানিকতলা ওপাশে গঙ্গা এই যার চৌহদ্দি ছিল, সেই অঞ্চলের প্রায় কেন্দ্রে।
‘বহুকাল বাদে’ কথাটা কেন বললুম কে জানে! এইসব অঞ্চলে এককালে বাসিন্দা হিসেবে থাকতুম, সে পাট চুকেছে আমার সাড়ে ছয় বছর বয়সেই। তখনকার কথা কিছুই কি আর মনে আছে? যা মনে পড়ে তা বাড়ির মধ্যের, রাস্তাঘাট লোকজন কিছু আর সেভাবে ধরা নেই স্মৃতিতে।
তবু যখন ভোরে লরি চলার আওয়াজ পেলুম একটু দূরে, যখন চায়ের কাপ হাতে বসে শুনতে পেলুম সুর করে ফিরিওলার ডাক, কেমন যেন খুব চেনা পরিবেশ মনে হল। জলখাবার খেয়ে এসে জানলার ধারে বসেছি, আর আশপাশের সাত পুরোনো ঝাঁকড়া গাছে কিচিরমিচির করছে পাখির দল…. কেমন যেন বুকের মাঝে আরাম ছড়িয়ে যাচ্ছে এখনও কড়া না হওয়া রোদের মতো। চোখ বুজে আসতে চাওয়া ভেস্তে দিয়ে মোটরবাইক স্টার্ট নেয় একটা, আর সে আওয়াজ মিলিয়ে যেতে না যেতেই যেন বা তাকে ধমকে ওঠে একটা কোকিল, ডেকেই চলে, ডেকেই চলে…
স্নান সেরে নিই সকাল সকাল। হরি ঘোষ স্ট্রীটের বাড়ির বাথরুমে স্নান করার স্মৃতি কিছু নেই আমার। কিন্তু কাচার জন্য গামলায় জড়ো করে রাখা জামাকাপড়ের উপর রাত্রে কিটি বেড়াল ঘুমোত, তাকে হঠাৎ মনে পড়ে যায়। সামনের পাঁচিলের ধারে অমনই একটা সাদা বেড়াল হেঁটে গেল। কোকিলটা এখনও আদুরে গলায় ডেকেই চলেছে। গলিতে বল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে কটা বাচ্চা ছেলে, তাদের স্যান্ডো গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট পরা। আরেকটু ঝাঁঝ বেড়ে যায় রোদের। ওদিকে বুগেনভিলিয়ার ঝাড় ফুলে ঝলমল করছে। স্কুল ছুটি হল কাদের, নীল ইউনিফর্মে কিশোরীরা বাড়ি যাচ্ছে। আমিও এককালে স্কুল থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরতুম না? এককালে। বাপির হাত ধরে। প্রায় মনে নেই। কোনওদিন হেদুয়ার পাশ দিয়ে, কোনওদিন ভিতরের গলি দিয়ে স্কটিশের পাশ দিয়ে। কাদের যেন একটা বাড়ি ছিল সেই গলিতে, গেটে সিংহ দেওয়া। ছোটোবেলায় গরমবোধ থাকে না মনে হয় তত। এই যে মেয়েগুলো বকবক করতে করতে হেঁটে গেল, বিনুনি বাঁধা চুল, সামনে একটু একটু খুচরো চুল আলগা উড়ছে – হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে তাদেরও ঘাম হাতে চেপে চেপে বসিয়ে দিল ছোট ছোট চোখের মিষ্টি দোহারা মেয়েটি – আমি কি এখন আর পারব এমন ঝাঁ ঝাঁ রোদে নির্বিকার পথ পেরোতে?
দিন গড়িয়ে চলে। টুং টুং করে কি আইসক্রিমের গাড়ি গেল? ছায়ার নকশা পড়ছে রাস্তায় – গাছের পাতার ছায়া, গেটের কারিকুরির ছায়া, ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া লোকটার বেঁটে ছায়া… ছোটবেলার দুপুর মানে খাটের মাঝখানটিতে পাশবালিশ নিয়ে ঘুম, আর ঘুম ভেঙে গেলে জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আসা আলো আর কড়িবরগার ছাতে চলন্ত গাড়ির রঙীন ছায়া।
এখন জীবনের প্রতি প্রহর জুড়ে কালো ছায়ার আনাগোনা…
কিন্তু ছায়া মানেই তো আলোও। কোথাও না কোথাও থাকা একটা আলো। ছায়ারা আর আমায় ভয় দেখাতে পারে না। আমি বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেই আলোটুকু ছুঁয়ে ফেলি, আর নির্ভার পায়ে হেঁটে বেড়াই, গরম লাগে, ঘাম গড়ায় কপালে, হাতের উলটো পিঠে সেটা মুছতে মুছতে টুক করে চওড়া হয়ে যাওয়া কপালের প্রান্তের উড়োখুড়ো চুলগুলো চেপে বসিয়ে দিতে চেষ্টা করি, বেখেয়ালে হাসি ফুটে ওঠে মুখে…
জীবন যে হাসি মুছে দিতে পারেনি।