শিফটিং: অনুষ্টুপ শেঠ

শিফটিং: অনুষ্টুপ শেঠ

মাটিতে বাবু হয়ে বসে কিছুটা চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন, হাতা-খুন্তি, একটা কড়াই, একটা ডেকচি এসব আলাদা করে একটা ছোট কার্টনে প্যাক করছিল সোমা। গিয়েই তো আর কিছু সব খুলে পেড়ে সাজানো হয়ে যাবে না, রাতে – আচ্ছা সে আজ রাতেও না হয় কিনেকেটে খেল, কাল সকাল দুপুরে রান্না করতে লাগবে। টুক করে একসঙ্গে পেয়ে যাবে এটা খুলেই।
হুঁ, কাল রান্না করতেই হবে। অমিতাভ একে পেটরোগা মানুষ, তায় এই একা হাতে এমন বাড়ি পাল্টানোর ধকল সামলে কাহিল হয়ে পড়ে প্রতিবার বড়। পর পর দুদিন বাইরের খাওয়া খেলে তার আর শরীরে দেবে না। সব হিসেব করাই আছে সোমার, যত লেটই হোক সন্ধে সাতটা আটটার মধ্যে তো শিফটিং হয়েই যাবে, অমিতাভকে বলবে আগে গ্যাসটা একটু ফিট করিয়ে নিতে, আর খাবার জলের ফিল্টারটা বসিয়ে দিতে। বাকি কাজ চালানোর মত রান্নাঘর ও আজই গুছিয়ে নেবে’খন। তারপর অমিতাভ যখন খাবার আনতে বেরোবে, তখন বেডরুমটা সাফ টাফ করে চাদর পেতে রেডি করে ফেলবে, মানুষটা এসে স্নান করে একটু বিশ্রাম নিতে পারে যাতে।
চার বছর হল বিয়ে হয়েছে। এই নিয়ে তিনবার হচ্ছে বাড়ি পালটানো। ভাড়াটে জীবন, কী আর করা! তা গুছিয়ে সংসার করার পাশে পাশে লোকটার সুবিধে অসুবিধেও মুখস্থ হয়ে গেছে সোমার।
কার্টনে চেপেচুপে শেষ হাতাটা ঢোকাতে গিয়ে উৎকর্ণ হয় সোমা। বাইরে কী যেন একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ, তারপরই শোনে অমিতাভ খুব রাগারাগি করছে! আবার কী হল!
তাড়াহুড়ো করে বাক্সটা বন্ধ করে বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়ায় ও।

অমিতাভর মুখ লাল, চুল উস্কোখুস্কো হয়ে আছে। সেই সকাল সাতটায় চা জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে এই লোকগুলোকে ধরে এনেছে, সেই থেকে তো চলছে এই! সোমা যেমন রান্নাঘরের জিনিস, অমিতাভও তেমনি অন্যান্য জিনিসের প্যাকিং তদারকি করে চলেছে, দরকারে নিজেও হাত লাগাচ্ছে।
এই মুহূর্তে বসার ঘর পুরো খালি, সোফা কাম বেড, স্টিলের ডিভানটা, একটু পালিশ ওঠা সেন্টার টেবিল, টিভির শোকেস সব উঠে গেছে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট লরিটায়। ঘরের মাঝখানে যে বড় প্যাকিং কেসটা পড়ে রয়েছে, সেটা টিভি, বুঝতে অসুবিধে হয় না সোমার।
ওকে দেখেই আবার নতুন করে ঝাঁঝিয়ে উঠল অমিতাভ।
“নাও দ্যাখো। তোমার বুদ্ধিতে এসব লোক ধরে কমে কাজ সারতে গিয়ে কী হল তাই দ্যাখো। ভেঙে থাকলে কত হাজারের ধাক্কা বোঝো?”
কমবয়েসী মজুরটা রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে আছে। সেও এবার তেড়ে উঠল, “ঊধারটা তো আপনার ধরা ছিল। অমন হট করে বিনা বাতায়ে ছেড়ে দিলেন কেন, আমি কী করে বুঝব? এত ভারি জিনিস… একা সামাল দেওয়া যায়? তখন থেকে এত তাড়া করছেন আপনি, বললাম দাঁড়ান আর দুটো লড়কা চা খেতে গেছে, ওরা আসুক তারপর করছি… গলতি কার!”
অমিতাভর মুখ আরো লাল হয়ে যায়, তেড়ে যায় আর কী। সোমা তাড়াতাড়ি ওর হাতটা ধরে ফেলে।
“আহ্ কী অশান্তি করছ! অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে, কী করা যাবে! যে কারো হাতেই হতে পারত। চেঁচিয়ে শরীর খারাপ কোরো না, আমি বলছি দ্যাখো কিছুই হয়নি হয়তো।”
অমিতাভ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মজুরটাও। দুজনের কেউই খুলে দেখার উদ্যোগ দেখায় না। অগত্যা সোমা নিজেই হাত বাড়িয়ে আবার একটা ধমক খায়, “ছাড়ো ছাড়ো, অনেক হুজ্জুত করে প্যাক করেছি ও আর খুলতে হবে না এখন। গেলেও তো আর এরা সারিয়ে দেবে না! যা হবে, ওখানে গিয়ে সেই আমাকেই দেখতে হবে। তুমি যাও এখান থেকে, তোমার রান্নাঘরের খুটুরখাটুর শেষ হল? কখন বেরোব আর, এত দেরি করলে?”
কথা না বাড়িয়ে সোমা আবার রান্নাঘরে ফিরে আসে।
সব সারতে রাত এগারোটা প্রায় বাজল। সোমা আর চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। কিন্তু ঘরের আলো না নেভালে সে আবার ঘুমোতে পারে না কিছুতেই। ওদিকে অমিতাভ কী যে করছে টিভিটা নিয়ে, আসছে আর না!
প্যাকিং খুলে সেট মজুরগুলোই করে দিয়ে গেছিল। কী ভাগ্যি, কিছু হয়নি, অন্তত চোখে দেখা যাচ্ছে না কিছু। কাল পরশু এপাড়ার কেবলের লোক ধরে লাইন লাগাতে হবে, তখন বোঝা যাবে। এ বাবা, আবার মোবাইলে সিনেমা দেখতে বসে গেল নাকি? কীসব আওয়াজ আসছে…
“কই গো?”
আর থাকতে না পেরে গলা তুলে তাড়া দেয় সোমা।
উত্তর আসে না। তবে আরেকটু পরেই অমিতাভ ঘরে এসে ঢোকে। জামা ছেড়ে, জল খেয়ে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর বলে, “ঠিকই আছে, বুঝলে। ছবিও ঠিকঠাক, আওয়াজও আসছে। জোর বেঁচে গেছি।”
“মানে? চালালে? কী করে?”
“পুরোনো ভিসিআরটা ওইতেই প্যাক করে এনেছি তো! জুড়ে দেখলাম এখন।”
ভুলেই গেছিল সোমা। এই কেবলের যুগে, কে আর ওসব চালাচ্ছে আজকাল!
দুজনেই প্রবল পরিশ্রান্ত, ঘুম আসতে দু’মিনিটও লাগল না।
তখনো ভোর হতে ঢের দেরি। জানলার বাইরে অন্ধকার। ঘুমটা এমনভাবে ভেঙে গেল কেন সোমা বুঝছিল না।
অস্বস্তি হচ্ছিল। গলাও শুকিয়ে গেছিল। দুঃস্বপ্ন দেখছিল কি?
উঠে, ঘুমজড়ানো চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে একটু দাঁড়াল। নতুন ফ্ল্যাট, কোথায় কী সড়গড় নেই এখনো। চোখ সইয়ে নিতে নিতে আলোর সুইচ কোনদিকে মনে করতে চেষ্টা করছিল। হঠাৎ চোখ ধাঁধিয়ে উঠল।
বাঁদিকে বসার ঘরের দরজা। সেখানে একটা আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল। নীলচে আলো।
দেখেছ বাবুর কাণ্ড! টিভিটা চালিয়েই রেখে এসেছে নির্ঘাৎ! জলের কথা ভুলে সোমা বসার ঘরে ঢোকে।
যা ভেবেছে তাই। টিভি চলছে, নীল আলো ঝলসে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।
অভিভূতের মত এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় সোমা।
এটা কোন সিডি? কী সিনেমা? দেখেনি তো সে কোনোদিন!
নির্জন জঙ্গুলে একটা জায়গা। রাত্তিরবেলা, খুব কম চাঁদের আলো। যে মেয়েটা একা একা হেঁটে চলেছে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। পিঠ ছাপানো চুল, সাধারণ ফিগার।
ভূতের গল্প নাকি? সোমা ভীতু মেয়ে, ভূতের সিনেমায় মাঝে মাঝেই ভয় পেয়ে চোখ বুজে ফেলে। হয়তো তেমন কিছু, এই সীনটা তাই চিনতে পারছে না।
মেয়েটা হেঁটেই যাচ্ছে হনহন করে। আওয়াজ মিউট করা, তাই কিছু শুনতে পাচ্ছে না ও। হয়তো সেজন্যই ভয় লাগছে না তত। নিভিয়ে দিলেই হয়, কিন্তু কী যেন এক অদম্য আকর্ষণে চোখ ফেরাতে পারছে না ও টিভির দিক থেকে।
একটা হ্রদ, জল চিকচিক করছে। তার পাশে পাথুরে, বিশাল বড় একটা… গুহা! এর সামনে এসে মেয়েটা থমকে দাঁড়াল।
না, এটা এর আগে কক্ষনো দেখেনি সোমা। খুব অবাক লাগছিল ওর। যে সংসারের প্রতিটি কোণা ওর চেনা, সেখানে এমন একটা না দেখা জিনিস এতদিন ধরে থাকে কী করে?
ওকী!
গুহার মধ্যে নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। আবছা ধোঁয়াটা কীসের, আগুন?
দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কারা যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। ছায়ামূর্তির মত।
মানুষ।
তারা এবার সবাই বেরিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে গুহার বাইরে। কত! সবাই মেয়ে। বিভিন্ন বয়েসী। তাদের চুল খোলা, রুক্ষ, জটপড়া। জামা কাপড় গায়ে ঝুলছে ঢলঢল করে। খালি হাত, খালি পা। হাত পায়ে মাটিমাখা, যেন চাষের জমি থেকে উঠে এসেছে।
বাবা গো!
সোমার ভয় করছে এবার। একা একা না দেখলেই হত!
সব কটা মেয়ের চোখের দৃষ্টি কী তীব্র!
যেন তারা সব জানে। সব।
এ পৃথিবীর শেষ রহস্যটুকুও।
যে মেয়েটি এতক্ষণ হেঁটে যাচ্ছিল, ক্যামেরা দুম করে ঘুরে গিয়ে তাকে এবার ক্লোজ আপে দেখায়।
খুব আস্তে আস্তে মুখ তুলে সরাসরি তাকায় সে।
সম্মোহিতের মত সোমা দেখে, মেয়েটির চুল নেতিয়ে আছে কপালের উপর। ঠোঁট ফাটা। চোখের কোলে গাঢ় কালি।
সোমার চোখে চোখ রেখে তাকেই যেন সে জিজ্ঞাসা করে, “যাবে?”
সোমা বোঝে না, বুঝতে চায় না। মাথা নেড়ে বোঝায় খালি, না! না!
মেয়েটা কেমন যেন একটা হেসে, মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে যায়। ছবি পালটাতে থাকে, সিনেমা এগোয়…
সোমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যথায়, গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। আর দাঁড়াতে পারে না সে, চোখ উলটে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
কখন জ্ঞান ফিরেছিল, কখন উঠে সিনেমা শেষ হয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়া টিভিটা নিভিয়ে দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে বিছানায় এসে শুয়েছিল সে আর মনে নেই।
পরদিন ভোরে উঠে থেকে রান্নাঘর চালু করা, জামাকাপড় বের করে আলমারি গুছোনো, রান্নাবান্না সব নিয়ে তুমুল ব্যস্ততায় কাটল সোমার দিনটা। অমিতাভর গা ম্যাজম্যাজ করছিল, ঘুমোল অনেকক্ষণ দুপুরে খেয়ে দেয়ে। সন্ধের মুখে মুখে উঠতে, চা মুড়ি এনে সোমা দেখে সে আবার টিভিটাকে নিয়ে পড়েছে।
সেটা দেখে, কাল রাত্রের কথা মনে পড়ল তার।
আশ্চর্য। সারাদিন সে সম্পূর্ণ ভুলে ছিল কথাটা।
“কেবলের লোক আজ এল না, না?”
নিজের গলাটা নিজের অজান্তেই কেমন যেন ধারালো শোনায় সোমার।
“আরে আমারই আর যাওয়া হয়নি। দোকান টোকান খুঁজতেই বেলা হল। কাল যাব।”
“কাল কী সিডি লাগিয়েছিলে? আমি আগে দেখিনি তো?”
খুব চেষ্টা করেও গলা কেঁপে যাওয়াটা এড়াতে পারল না সোমা। অমিতাভ কিন্তু সেটা লক্ষ করল না। চায়ে আয়েস করে চুমুক দিয়ে বলল, “কে জানে! এই তাকটায় পড়ে ছিল। কভার টভারও নেই, শুরুও হল মাঝখান থেকে কেমন… আগের কেউ ফেলে গেছিল মনে হয়। কী বোরিং সিনেমা, একজন খালি হাঁটছে তো হাঁটছেই! আসলে, আমাদেরগুলো কোথায় প্যাক করে এনেছি ভুলে গেছি। ভালো মনে করিয়েছ, দেখি দাঁড়াও।”
সোমা ভুলে যায়নি। বেডরুমের দেওয়াল ঘেঁষে জড়ো করে রাখা বাক্সগুলোর মধ্যে কোনটায় সিডি আছে দেখিয়ে দিতে এক মিনিট লাগল ওর। পছন্দের একটা হিন্দি মুভি বেছে নিয়ে এসে আয়েস করে বসল অমিতাভ।
সোমার সব অবাস্তব লাগছিল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে চলে এল শোবার ঘরে।
অমিতাভর জামা-টামা সকালেই গুছিয়ে ফেলেছে। ওর নিজেরগুলো এখনো তোলা হয়নি, দুটো ঢিলেঢালা নাইটি বার করে নিয়েছে খালি। অস্থির হাতে একটা কার্টন খুলে ফেলল সে। তারপর খেয়াল হল, বাক্স খুলে জামাকাপড় বার করার পর ধুলো হচ্ছে বেশ জায়গাটায়, এখন এসব করলে আবার ঘর ঝাঁট দিয়ে গা ধুতে যেতে হবে।
শীত করছিল। শরীরটা ওরও ভালো লাগছিল না। আবার বাক্সটা মুড়ে রেখে বেরিয়ে এল সে। বসার ঘরের সোফা ঘেঁষে দাঁড়াল, দেওয়ালে হেলান দিয়ে।
খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর অমিতাভর তাকে চোখে পড়ল, এতই মগ্ন হয়ে টিভি দেখছিল সে। হই হই করে পাশে সোফায় চাপড় মেরে ডাকল, “আরে! বসো বসো। এ জায়গাটা হেব্বি!”
সোমা ধীরে ধীরে বসে। কিছুক্ষণ দেখে।
ও মনে হয় বড্ডই ক্লান্ত, মাথায় কিছু ঢুকতে চাইছে না। ভাঁড়ামি মনে হচ্ছে।
উঠে পড়ে আবার।
অমিতাভ তাকায় না। তবে টের পেয়েছে ঠিকই, বলে ওঠে, “আরেক কাপ চা দিও তো! গায়ে ব্যথাটা এখনো যায়নি পুরো, আদা দিও একটু।”
সেদিন অনেক রাত্রে, সোমা নিজেই উঠে গিয়ে টিভিটা চালাল। হ্যাঁ, ঐ আগের সিডিটা দিয়েই।
আগের দিনের শুরুর জায়গাটা থেকেই আবার শুরু হল সেটা। সেই মেয়েটা আবার হেঁটে যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ও রিওয়াইন্ড করেনি, তাই অবাক হবার কথা। কিন্তু ও অবাক হল না।
আজও যখন মেয়েটা ডাকল, “যাবে?”, ও না-সূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু আজ ওর ঠোঁটে খুব মৃদু একটা হাসি ছিল। এবং আজ, তার পরের অংশটা খুব মন দিয়ে দেখল সোমা। ভয় পেল না, ডিস্টার্বড হল না, চোখ বুজল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি সিন দেখল। দরকার মত রিওয়াইন্ড করে করে।
পরদিন সকালে অমিতাভ খেয়েদেয়ে অফিস চলে গেল। তারও ঘন্টাখানেক পরে জঞ্জাল নিতে এল বাঁশির হাঁক পেড়ে। খোসা-কাঁটা, ধুলো ঝুল, ভাঙা প্যাকিং বাক্সের টুকরোটাকরার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা লম্বাটে চৌকো জিনিস সে গাড়িতে ফেলে দিয়ে এল সোমা। একটা সিডি।
আর কী করবে রেখে? অমিতাভর ব্যাঙ্কে যথেষ্ট ব্যালেন্স থাকা সত্ত্বেও তার বাবার ক্যান্সারের চিকিৎসায় কিছু সাহায্য করতে না পারার অক্ষমতার নিপুণ অভিনয়, অফিসের জুনিয়র মেয়েটার সঙ্গে ট্যুরে গিয়ে এক ঘরে ওঠা, আগের ভাড়াবাড়িতে ঠিক যখন বাড়িওয়ালা থাকত না তখনই তার বৌয়ের কাছে ভাড়া দিতে যাওয়ার কারণ, তার নিজের গত বছর মিসক্যারেজের সময়ে শরীর খারাপ লাগছে বলে হসপিটালে না আসা, তার বদলে সেই বিকেলেই কলেজের পুরোনো বান্ধবীকে নিয়ে ওয়ো রুম বুক করে যাওয়া – এর সবই খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে সে গতকাল।
ওটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই ফেলে দিল।
এছাড়া আর কীই বা করতে পারে ও? বা ওর মত ট্যাঁকের জোর না থাকা, সামাজিক নিরাপত্তাটুকু ঘুচে যাওয়ার ভয়ে কুঁকড়ে থাকা মেয়েরা?
স্নান করে মন দিয়ে ঠোঁটে ভেসলিন লাগাল সোমা, ঠোঁট ফাটছে নইলে। তারপর খুব ফুরফুরে মনে খেয়েদেয়ে দিব্যি একটা ভাতঘুম দিল সে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল, একটা নির্জন জঙ্গল। হেঁটে যেতে যেতে ওর পায়ের নিচে নরম ঘাসের স্পর্শ পাচ্ছিল সোমা, টের পাচ্ছিল পাশের সারি সারি গাছের পাতা নড়ার শব্দ, হ্রদের জল ছুঁয়ে ভেসে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া, পাথুরে পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছিল রাস্তার শেষে।
বিকেলে রুটি করে নিয়ে, কড়াইতে তেল বসিয়ে, ঝিরিঝিরি পেঁয়াজ আর মোটা ফালা ফালা বেগুন কাটছিল সে। সকালে ভেসলিনটা কেনার সময়েই দই এনে রেখেছে, তেল মশলা দিয়ে কষিয়ে বেগুনের ঝাল রান্না করবে আজ। তার খুবই প্রিয় পদ। বিয়ের পর আর বানায়নি, অমিতাভর বেগুনে অ্যালার্জি আছে বলে।
খুন্তি নাড়া শেষ করে ঢাকা দিয়ে কিছুক্ষণ রাখতেই রান্না তৈরি। কাটিং বোর্ড ইত্যাদি পরিষ্কার করে রেখে গা ধুতে যায় সোমা। আজকের মত রান্নাঘরের কাজ শেষ। আর কিছু করতে ওর ইচ্ছে করছে না।
অমিতাভ? খাবে যা হোক। ওবেলার আলুকপি পড়ে আছে, নয়তো গলির মোড় থেকে তড়কা আনিয়ে নেবে। এমন কী আর বেশি দাম!

Leave a Comment