সাইকেল

সাইকেল

লোকে বলে, সাইকেল শিখতে হলে নাকি আছাড় খাওয়া বাধ্যতামূলক। আমার মত ডাকসাইটে “খেকো” মানুষ অবশ্য শুধু আছাড়েই সীমাবদ্ধ রাখতে পারেনি নিজেকে। সে এক অসম্ভব, ভয়ংকর, অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানার স্মৃতি। বলব নাকি?

সেসব দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আমার চেয়েও বেশি মজা পাবেন বোধহয় আমার পিসেমশাই।

খুলে কই।

ইস্কুলে পড়ি তখন। সেভেন এইট কিছু একটা হবে। পিসির বাড়ি ছিল “রিকশা না পেলে হেঁটেও মেরে দেওয়া যায়” গোছের দূরত্বে, ফলে শনি, রবি, গরমের ছুটি পেলেই পোঁ করে চলে যাওয়া যেত। পুজোয় ঠাকুর দেখাও রে, বিয়েবাড়িতে সাজিয়ে গুজিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাও রে, শীতের ছুটিতে চিড়িয়াখানা নিয়ে চলো রে, গরমের ছুটিতে সাতদিন নিজের কাছে এনে রেখে দুপুরে শুয়ে শুয়ে গল্প বলো রে, সব আবদার পিসির কাছে চলত। সেই সঙ্গে চলত পিসতুতো ভাইয়ের উপর সর্দারি। আমি আদার কারবারি না হলেও, আমার পিসেমশাই ছিলেন জাহাজের মানুষ, মার্চেন্ট নেভির ইঞ্জিনিয়ার। বছরের যে ছ’মাস তাঁর মাটিতে পা পড়ত, আহা, বাকি সময়ে তো জলে ঘুরতেন রে বাপু, তো সেই ছ’মাস হুট হাট হপ্তায় তিন চারদিন চলে আসতেন আমাদের বাড়ি সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে।

ক্লাস এইট-ই হবে, এখন মনে হচ্ছে। লম্বা হয়েছি বেশ তখন, পিসের একদিন খেয়াল হল সেটা।

“দাদামণি, টুম্পাকে কাল থেকে রোজ বিকেলে পাঠিয়ে দেবেন তো! সাইকেলটা শিখিয়ে দিই।“

শেখানোর নামে আমার পিতৃদেব আর মাতৃদেবী তো অমনি এক পায়ে খাড়া। আমিও কিছু নন-খাড়া নই। অতএব পরদিন লাফাতে লাফাতে গিয়ে হাজির হলুম বিকেল চারটেয়।

“স্কার্ট পরে সুবিধে হবে না তোর, এটা তো লেডিজ সাইকেল নয়! ওকে আমার একটা পুরোনো ট্রাউজার দাও দেখি বার করে!”

শেষের কথাটা পিসির দিকে ফিরে। বলতে কী, পিসেমশায় তেমন লম্বা নন। ফলে, তাঁর কলেজ আমলের প্যান্ট একটু ফোল্ড করে আমার বেশ ঠিকঠাক ফিট হল। তারপর মহা উৎসাহে শুরু হল প্রশিক্ষণ। সে এক দৃশ্য, পিসেদের বড় মাঠে আমি সাইকেলে ল্যাগব্যাগ করছি, পিছনে পিসে ছুটছে, দোতলার বারান্দা থেকে পিসি আর পিসেমশাইয়ের মা সোল্লাসে চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন, মাঠের ধারে ভাই আর পিসিদের তখনকার কাজের মেয়েটি লম্ফঝম্প করে চীয়ারলিডারের ভূমিকা পালন করছে।

কিছুদিন অমন ল্যাগব্যাগার্নিশগিরি করে, এবং তার মধ্যেই বিস্তর পড়ি-পড়ি দশা হবার পর একটু ব্যালেন্স এল। অমনি, পিসে কেমন যেন অকুতোভয় হয়ে গেল। ‘চ’, চ’, হয়ে গেছে, এবার রাস্তায় বেরোই’ বলে, পিসি হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই বোঁ করে আমায় সামনে বসিয়ে নিয়ে দমদমের বিখ্যাত গলিঘুঁজির একটায় গিয়ে হাজির হল।

রাস্তায় গিয়ে কিন্তু মানতে বাধ্য হলুম পিসে কথাটা মন্দ বলেননি। মাঠের এবড়ো খেবড়োর চেয়ে পিচ রাস্তায় শেখা অনেক সহজ লাগছিল। শিখছিলুমও বেশ, পিসের ভারি সুন্দর একটা নিটোল গোল ভুঁড়ি ছিল, সেটা নাহোক আধ ইঞ্চি কমিয়ে দিয়েছিলুম তখন দৌড় করিয়ে করিয়ে।

তারপর দুম করে একদিন একটা লোককে সাইড দিতে গিয়ে নর্দমায় পড়ে গেলুম।

মানে, আমি পড়লুম না ঠিক, সাইকেলটা পড়ে গেল, আমি দেখলুম সীটটা আমার তলা থেকে নিচে চলে গেছে, আর শ্যাওলা পড়া দেওয়ালে এক হাত আর হ্যান্ডেলে এক হাত আমি শূন্যে বসে আছি। দেওয়ালে ঘষে হাত ছড়ে টড়ে একাকার।

গেল কনফিডেন্সের চোদ্দটা বেজে। ঝুলোঝুলি করে পিসেকে রাজি করালুম বাকিটা আবার মাঠেই হোক। ভাগ্যবিধাতা তখন ফ্যাক করে হেসেছিলেন, সে কি আর জানতুম!

মাঠে ফিরে আসায় ভাই যৎপরোনাস্তি খুশি হয়েছিল, কারণ রাস্তায় তার আমার পিছু পিছু যাবার পারমিশন ছিল না। বেশ চালাচ্ছি বুঝলেন তখন, পিসের পেন্টুলটা জন্মের শোধ আমারই হয়ে গেছে বলতে গেলে। রোজ বিকেল চারটে বাজলেই হানা দিতুম। সাহস টাহস ফিরে এসেছে আবার, এমনকি চালাতে চালাতে সুর ভাঁজছি অবধি, কথা নেই বার্তা নেই এদ্দিনের চেনা মেঠো রাস্তাটা কী বেইমানিই না করল!

কী যে পড়ে ছিল, মাটির ঢেলা না ভাঙা ইট, আজও জানি না। শুধু মনে আছে, প্রফুল্ল বদনে প্যাডেল করতে করতে আচমকা একটা ঝাঁজুনি খেয়ে দেখি রাস্তা ছেড়ে গড়গড় করে এপাশের পানাপুকুরের ঢালু পাড় ধরে নেমে যাচ্ছি।

ঢালু এমন, ব্রেক মেরেও থামছে না।

আমার আর্তনাদ, ভাইয়ের গগনবিদারী চীৎকার, বারান্দার জনগণের হাহাকার – এসবের মধ্যে পিসে পি টি ঊষার মত স্প্রিন্ট টেনে এসে একহাতে খপাং করে ক্যারিয়ারটা চেপে ধরল।

বলতে ভুলেছি, নোয়াপাতি ভুঁড়ির সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের আর্নল্ড সোয়ারজেনেগার টাইপের বাইসেপ টাইসেপ ছিল, টি শার্টের হাতা ইলাস্টিক না থাকলেও হাতে কেটে বসত। ওই একহাতেই সাইকেল শুদ্ধু ধেড়ে মেয়েকে টেনে তুলে আনলেন। অবশ্য আমি খুব ভালো সাঁতার জানতুম, তবে সাইকেলটা তো আর জানত না!

তারপরের কাণ্ডটা আরো জ্বালাময়ী। আক্ষরিক অর্থেই। পুকুরের ভয়ে আবার রাস্তায় ফিরে গেছি তখন। প্রেমসে চালিয়ে একদিন ফিরছি, গেট দিয়ে ঢুকেই কীরকম সব গুলিয়ে গেল, হাই স্পীডের মাথায় ব্রেক কষে ফেললুম।

আমি দুটো ডিগবাজি খেয়েছিলুম, সাইকেলটা তিনটে। বা আমি তিনটে আর সাইকেল দুটোও হতে পারে। সেটা বড়ো কথা নয়। কথা হল, আমি রোল ওভার করে টরে গিয়ে ল্যান্ড করলুম একটা কাঁটাঝোপের মধ্যে। সে মাঠের ঘাস ভর্তি চোরকাঁটাও ছিল আবার ঠিক ঐ জায়গাটিতেই।

পরবর্তী দৃশ্য – পিসিদের ডাইনিং স্পেসের মাটিতে আমি হাত পা ছড়িয়ে বসে আছি, পিসেমশাই কাঁচুমাচু মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে পিসির বকুনি খাচ্ছে, আর পিসি, ভাই, ভাইয়ের ঠাম্মা এবং সেই কাজের মেয়েটি আমার সর্বাঙ্গ থেকে “কাঁটা লাগা” দশা হটাচ্ছে।

তবে ঐ ডিগবাজি খেয়েই ফাইনালি সাইকেলটা শিখে গেছিলুম, পিসেমশাই জাহাজে গেলে সাইকেল দিয়ে যেতেন আমাদের বাড়িতে, প্র্যাকটিস করব বলে। প্র্যাকটিস সেশনে কচি করে একবার এক ফুচকার গাড়িতে ধাক্কা মারা ছাড়া আর কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটেনি।

Leave a Comment