খেলা: অনুষ্টুপ শেঠ

খেলা: অনুষ্টুপ শেঠ

আজকাল গুলগুলির খেলাগুলো খুব অন্য ধরনের হয়ে গেছে। এই যেমন ধরো, এখন ও আর মিঠুল বসে আছে মিঠুলদের ফ্ল্যাট বাড়ির পাশের ‘মা সিদ্ধিময়ী জেরক্স সেন্টার’-এর সামনে। সকাল তো, তাই দোকান এখনও গেট টেনে বন্ধ, বসে বসে দেখছে রাস্তায় কেমন কালো পিচের ওপর হলুদ রোদের ওয়াশ, তারও ওপর স্প্রে পেইন্টিং-এর মতো সজনে গাছের ছায়া। এমন সময়ে সামনের গলির মিষ্টির দোকানের পাশের লাল দরজা খুলে পিকুদিদি জুতোর বেল্ট লাগাতে লাগাতে বেরোলো। কলেজ যাবে কাঁটাকলের ওখানে, গলা তুলে বলল “মা, এলুম” আর ভিতর থেকে অলি আন্টির রেওয়াজ করা ক্ল্যাসিকাল গলার চিকন উত্তর ভেসে এল, “সাবধানে যাস!” – এই অবধি সব একদম রোজের ব্যাপার। টেনে দিতেই লাল দরজা আপনি বন্ধ হয়ে গেল, সামনে দিয়ে যাবার সময়ে মিঠুলের দিকে চেয়ে হালকা হাসল পিকুদিদি।
তারপর দুম করে সব কীরকম অন্যরকম হতে লাগল। গলির মোড়টা ঘুরেই পিকুদিদি একটা জোরে আর্তনাদ করে ধপাস করে পড়ে গেল।
মিঠুল আর গুলগুলি তাড়াতাড়ি এসে দেখল ব্যাগ একদিকে, জুতো আরেকদিকে, পিকুদিদি বাঁ হাঁটু চেপে ধরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাজামাটা ছিঁড়েছে, রক্ত বেরোচ্ছে দেখা যাচ্ছে।
যে মাটির বড়ো ঢেলাটায় পিকুদিদি হোঁচট খেল, সেটা কস্মিনকালেও এ রাস্তায় ছিল না।
এক মিনিট! এ রাস্তা? এই রাস্তাটাই তো মিঠুল কস্মিনকালে দেখেনি।
প্রচণ্ড এবড়ো-খেবড়ো মেঠো রাস্তা একটা। গর্তে ভরপুর। এপাশে সারি সারি গাড়ির চায়ের মনিহারি দোকানগুলো একইরকম আছে মনে হচ্ছে, কিন্তু অন্য দিকে হলুদ কমলা ফ্ল্যাটগুলোর বদলে একটা ভাঙা পরিত্যক্ত টিনের চালের কারখানা।
সামনে বি টি রোডের বদলে যদ্দূর দেখা যায়, ধানক্ষেত। সবুজ সবুজ ধান।
গুলগুলি মিঠুলের কনুই ধরে টান দেয়। খুব আস্তে আস্তে পিছন ঘুরে মিঠুল দেখে, ওদের বাড়ি-টাড়ি সব মুছে দিয়েছে কেউ ইরেজার দিয়ে। তার বদলে, কেমন ঝুপসি জঙ্গল একটা। খুব রোদের দিন তো, গাছগুলো কেমন যেন ধোঁয়ার মতো দেখাচ্ছে তাই।
পিকুদিদি ইতিমধ্যে নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছে কোনোরকমে।
“এটা কী হল বল তো!”
মিঠুল গুলগুলি আর কী বলবে! ওরা নিজেরাও তো কিছুই বুঝতে পারছে না।
মিঠুলের কাঁধে হাত রেখে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে কারখানার ছায়ার দিকে চলল পিকুদিদি। গুলগুলি ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়েছে ততক্ষণে।
“এইখানে বসবে? আমরা দেখি কোথায় জল পাই?”
“আমার ব্যাগেই জলের বোতল আছে, দে দেখি।”
জল ঢালতে গিয়ে রক্ত মেশা লাল ধারা গড়িয়ে পড়ল পথের পাশে। সেই ছোঁয়াতেই হয়তো, রাস্তাটা ওদের চোখের সামনে আরও লালচে, আরও রুক্ষ হয়ে উঠল। খোয়া ভাঙা সুরকির মত লাল। ওইটুকু জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে কেমন ওপার অবধি পৌঁছে গেল দ্যাখো!
পিকুদিদি ব্যাগে বোরোলিনও রাখে। সেটা ঘষতে ঘষতে বলল, “এসব কী ভূতুড়ে কাণ্ড হল বল দিকি!”
গুলগুলির কানে মনে হয় কথাটা গেল না। ও খুব মন দিয়ে তখন জঙ্গলের ঠিক পাশে, একটা শ্যাওলা পড়া কাঠের ফলকের দিকে চেয়ে ছিল। ভ্রূ অল্প কুঁচকে গেছিল ওর, মুখ একটু হাঁ – এটা কি এইমাত্র গজাল ওখানে? আগের বার দেখেনি মনে হচ্ছে যে!
মিঠুল হঠাৎ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। পিকুদিদি গুলগুলি দু’জনেই শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। অনেক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মিঠুল যা বলে তার মোদ্দা কথা হ’ল ওর জলখাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আর মা কোথায় গেল বুঝতে পারছে না। সুতরাং ও কাঁদবে।
“চুপ্‌! কেঁদে যদি কিছু হত কাজ কখনও!”
পিকুদিদি এমন বোম-ফাটা গলায় ধমক দিতে পারে গুলগুলির ধারণাই ছিল না। মিঠুল তো বটেই, ভয়ে ও-ও ঢোঁক গিলে ফেলল তিনটে পর পর।
ব্যাগ থেকে টিফিনবাক্স বার করে ওদের দু’ভাগ করে দিল পিকুদিদি, মিঠুল বাক্সটায় আর গুলগুলি ঢাকনাটায়। ঝাল না দেওয়া টমেটো সস মাখা চাউমিন, ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েও একবার থামল গুলগুলি, “তুমি?”
“আমি তো এই ভাত খেয়ে বেরোলুম রে। খা তোরা।”
তা খায়। কিন্তু খেতে খেতেও গুলগুলির মনটা ঐ বোর্ডে পড়ে থাকে। কী লেখা আছে জানতে খুব ইচ্ছে করে।
প্রায় ওর মনের কথা বুঝে ফেলেই যেন, পিকুদিদি বলে, “কোথায় এসে পড়লুম কিছুই তো বুঝতে পারছি না রে! একবার গিয়ে দেখে আয় তো ঐখানে কিছু জায়গার নাম-টাম লেখা আছে কিনা!”
গুলগুলি অমনি এক দৌড়ে পৌঁছে যায় সেই জঙ্গলের পাশের বোর্ডের কাছে। ঝুপসি জঙ্গলটা এর মধ্যেই আবার কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে উঠেছে, যেন কেউ এসে যথেচ্ছ গাছ উপড়ে নিয়ে চলে গেছে। রোদটাও কেমন যেন মাখন মাখন নরম হয়ে গেছে ওদের খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে। লেখাটা কোন ভাষায় বুঝতে পারছে না গুলগুলি। মিঠুলের স্কুলে বাংলা আর ইংলিশ শেখায় খালি। সামনের বছর থেকে হিন্দিও শেখাবে নাকি। এই অক্ষরগুলো একটাও চেনা নয় ওর। পিকুদিদি কি চিনবে? কিন্তু পায়ে চোট নিয়ে পিকুদিদি আসতে পারবে না এখানে। নাহ, ফিরে যাওয়া যাক।
কোনটা আগে হল বোঝা গেল না ঠিক। গুলগুলি ফিরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে প্রবল একটা ঝড় আছড়ে পড়ল যেন ওর চারদিকে। পাতা খসে পড়ল সর্বত্র, গাছ দুমড়ে ভেঙে পড়ল মাটিতে। যারা ভাঙল না, তারা কেমন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে নুইয়ে পড়ল মাটির কাছাকাছি। আকাশের সেই সোনাঝরা রোদ পালটে স্লেটের মতো মেঘ ঘনিয়ে এল, এক কোণে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। কারখানা বাড়ির গায়ে তারপর আছড়ে পড়ল ঝড়। এতোল-বেতোল হাওয়া আর কোন্‌ না কোন্‌ ধ্বংস হয়ে যাওয়া চাষের জমির থেকে উড়ে আসা গুঁড়ো গুঁড়ো মাটি সব কেমন চোখের আড়ালে লেপে পুঁছে দিল।
চোখে ধুলো ঢুকছে বলে চোখ বন্ধ করল গুলগুলি। অমনি পিছনের বোর্ডের লেখাগুলোর মানেও ও বুঝতে পেরে গেল হঠাৎ।
ওর আদরের নামটা। গুলমোহরিয়া। মা ডাকত। লিখতে পারত না তো, তাই অমন আঁকড়ি বাঁকড়ি করে নামটা লিখত। গুলমোহরের ফুল আঁকার চেষ্টা, কাঁচা হাতে।
মিঠুলদের বাড়ি কাজ নিয়ে চলে এসেছিল গুলগুলি সেই পুজোর পর। জমি গেল, কারখানা হল না, কাজ নেই, খেতে হবে তো পেটে! চার বছরের বাচ্চাটার সঙ্গে খেলা করেই বেশি সময় কেটে যেত। আসছে পুজোয় বাড়ি যেতে দেবে বলেছিল তখন মিঠুলের মা। আর হল না যাওয়া।
ধান জমিটার সামনের রাস্তায় আপনি আপনি হোলির মতো লাল রঙ মেখে যাচ্ছে এবার।
মিঠুলের মুখ সেটা দেখে কেমন গম্ভীর হয়ে উঠছে। গুলগুলি আবার রঙের বাক্সে ঝুঁকে পড়ে। চেনাশোনা মানুষজনকে নিয়ে গল্প বরাবরই বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারত ও, কিন্তু এত ভাল আঁকতে পারে তা কি জানত আগে! মিঠুলের জন্য এনে রাখা রঙ তুলি কাগজে রোজ রোজ নতুন ছবি ফুটে ওঠে। মিঠুল ছাড়া কেউ জানে না ওগুলো ওর আঁকা।
মিঠুল যদিও ওর মাকে বাবাকে নতুন আয়া দিদিকে সেটা বলে, কেউ বিশ্বাস করে না। তবে মিঠুলকে ঘাঁটায়ও না। যা ভেবে ভালো থাকে, থাক।
সবাই মায়া করে বাচ্চাটাকে। বেচারা সারাদিন হুইলচেয়ারে বন্দি তো।
খুব আগলে রাখত গুলগুলি মিঠুলকে। ঘুরতে ঘুরতে বি টি রোডের কাছাকাছি চলে গেলে হাত ধরে থাকত টিপে। সেদিন কীভাবে যে হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিল… গুলগুলিও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে ধরে ফেলেছিল। তারপরই পিকুদিদির চীৎকারে মুখ তুলে দেখে মিনিবাসটা রাক্ষসের মতো ধেয়ে আসছে, সামান্য পিছনে আরও একটা, বাসেদের রেস চলছে।
প্রাণপণে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বোকা ছেলেটা কিছুতেই গুলগুলির হাত ছাড়ল না, নইলে ওর পা দুটোও বেঁচে যেত। ঠিক পা দুটোর ওপর দিয়েই সামনের চাকাটা গেছিল।
আর পিছনের চাকাটা গুলগুলির মাথার উপর দিয়ে।
ঝুঁকে পড়ে, ছবির মধ্যে অবধারিত ছুটে আসতে চাওয়া লাল হলুদ মিনিবাসটাকে তুলির হিংস্র টানে রাশি রাশি হলুদ ফুলের স্তূপে চাপা দিয়ে দেয় গুলগুলি। গুলমোহরের ফুলে ভরে ওঠে ধানজমি, কারখানার ফাঁকা তকতকে উঠোন, জঙ্গলের ভিজে ভিজে সোঁদা মাটি। সে হলুদের রেশ জলে জলে ফেড হয়ে মেখে যায় আকাশ জুড়ে, ঝকঝকে দিন হেসে ওঠে আবারও।
এইত্তো মিঠুল হাসছে, হাততালি দিয়ে। ওর দিকে চেয়ে গুলগুলির মুখেও হাসির আলো ছড়িয়ে পড়ে।
ধ্যাত্তেরি তোমাদের মরে যাওয়া! ভালবাসা কি অত সহজে মরে নাকি!
___

Leave a Comment