চলার পথে – পর্ব ১
চলার পথে – পর্ব ১
——————————-
বাঙালীর পায়ের তলায় সরষে, জানেন তো? আমার মতো ঘরকুনো বইমুখো লোকও বেড়াতে যেতে ভা-আ-রি ভালোবাসে। এই যে করোনাকবলিত সময়ে এদ্দিন ধরে বেড়ানোর নামগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না, সে নিয়ে আক্ষেপ না করে বরং পুরোনো বেড়ানোর গল্প করি একটু।
বেড়ানো বললেই হিমালয়ের কথা মনে পড়ে সবার আগে। জীবনে প্রথম হিমালয়দর্শন, মানে হরিদ্বার থেকে দূরের পাহাড় বলছি না, বেশ সেইভাবে কাছ থেকে দর্শন, ছিল কেদারনাথ-বদ্রীনাথ। আমি তখনও স্কুলে পড়ি। সেই যাত্রার মনোরম অভিজ্ঞতায় উৎসাহ পেয়ে তার দুবছর পর যাওয়া হল মদমহেশ্বর। মানে পঞ্চকেদারের আরেকটি।
পঞ্চকেদারের গল্পটা ভারি সুন্দর। বলি একটু? আমাদের দেশে তো বিভিন্ন জায়গার স্থানীয় উপকথায় রামায়ণ বা মহাভারত মিশে আছে, এখানেও তাই। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পাণ্ডবেরা ঠিক করলেন শিবের পূজা করে ভ্রাতৃহত্যার পাপ মোচন করবেন। গেলেন বারাণসী। কিন্তু শিবের তখন ইচ্ছা নেই এঁদের দেখা দেওয়ার, অতএব তিনি বারাণসী থেকে অন্তর্হিত হয়ে গিয়ে হাজির হলেন গুপ্তকাশীতে।
পাণ্ডবরাও ছাড়ার পাত্র নন। ধাওয়া করলেন পিছনে। তখন শিব এক ষাঁড়ের রূপ ধারণ করে ছুটে পালাতে লাগলেন উত্তরাখণ্ডের পাহাড় থেকে পাহাড়ে। পিছনে সমানে ছুটতে লাগলেন পাণ্ডবেরাও। এই করতে করতে এক জায়গায় এসে সেই ষাঁড়ের পিছনের অংশে হাত পড়ল পাণ্ডবদের, সম্ভবত ভীমসেনের।
অমনি সেই অংশ পাথর হয়ে গেল, আর সাক্ষাৎ শিবের অংশ হিসাবে পূজা হতে লাগল। এই জায়গাটিই এখনকার অতি পরিচিত তীর্থস্থান কেদারনাথ।
শিব কিন্তু তখনো ধরা দেননি! সেই “আমায় ধরতে পারে না!” করে ছুটোছুটি চলছে তখনও। এর পরে আবার তিনি ধরা পড়লেন মদমহেশ্বরে। পেট বা নাভির অংশ পাথর হয়ে রইল সেইখানে। তারপর তুঙ্গনাথে বাহু, রুদ্রনাথে মুখ এবং অবশেষে কল্পেশ্বরে জটা পাওয়া গেল। কথিত আছে এইভাবেই পঞ্চকেদারের উৎপত্তি, এবং এই মন্দিরগুলি পাণ্ডবদের তৈরি। তবে সম্ভবত এগুলি গল্পকথাই কারণ আমি যতদূর জানি মহাভারতে কেদার অঞ্চলের উল্লেখ নেই কোনো।
যাই হোক, বেড়ানোর গল্পে ফিরে আসি। মদমহেশ্বর হেঁটে উঠতে আমাদের তিনদিন লেগেছিল মনে আছে, নামতে দুদিন। রাস্তার সৌন্দর্য মুখে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমার মনে এই যাত্রাটি কেদারের চেয়েও বেশি দাগ কেটেছিল কারণ আগাগোড়া রাস্তার নির্জনতা। কেদারের রাস্তায় নিত্যযাত্রীর ভিড়, আগে পিছে পাশ দিয়ে সারাক্ষণ লোক চলছে, ডান্ডি কান্ডি যাচ্ছে, হইহই করে ঘোড়সওয়ার নিয়ে ঘোড়াওলারা যাচ্ছে। সেও অন্যরকম মজা একটা – অচেনা মানুষ সব, চোখাচোখি হলেই “জয় কেদার” বলে হাঁক দিচ্ছেন… কিন্তু এ হল একদম আলাদা এক অভিজ্ঞতা। ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁটে যাচ্ছি, দলের নিজেরা কয়েকজন আর গাইডরা ছাড়া কোনো মানুষ চোখে পড়ছে না, হয়তো বহুক্ষণ পরে পাকদন্ডী বেয়ে একজন কাঠকুড়ানি মেয়ে নেমে এল; কখনো বা উপত্যকার ধারে পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছি, এত নিঃশব্দ যে কানের মধ্যে ঝিমঝিম করছে, চোখের সামনে অপার সৌন্দর্য, ডুবে যাওয়ার মত ভালো লাগছে, সময়ের হুঁশই থাকে না, গাইড তাড়া দিলে খেয়াল হয় আরো অনেক পথ পেরোলে তবে রাতের আশ্রয় পাওয়া যাবে।
একদিনের প্রায় পুরো রাস্তা ছিল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, ঘন পাইন ফারের জঙ্গল, পায়ের নিচে ঝরা পাতা জমে জমে প্রায় তিন চার ইঞ্চি পুরু গালচে। মনের আনন্দে ধপাং ধপাং করে হাঁটছি, পায়ের নিচে পাতা মচমচ করছে ভারি মজা লাগছে, তাতে আবার গাইড সতর্ক করে দেয়, বেশি আওয়াজ করবেন না, ভালুর আনাগোনা আছে। অমনি ভয় পেয়ে পা টিপে টিপে চলা ধরি। শেষদিকে যেমন খাড়া চড়াই, তেমনি অপার্থিব সৌন্দর্য পৌঁছনোর পর। মন্দির পেরিয়ে আরো উপরে ছিল এক ফুলে ঢাকা উপত্যকা, স্থানীয় ভাষায় “বুড়া মদ”।
জীবনে অন্তত একবার, সম্ভব হলে, হিমালয়ে যাওয়া উচিত। ওই বিশাল ক্যানভাসের মধ্যে নিজের সঙ্গে একা দাঁড়ানোর অনুভবটি আজীবনের অমূল্য সম্পদ।
হিমালয়ের আরও গল্প আছে। তবে সেটা পরের কিস্তিতে।
(ক্রমশঃ)