গেম

মালতী ন্যাতাটা চেপে নিংড়ে টান টান করে মেলে দিয়েই হুড়মুড় করে চটি পায়ে গলিয়ে দৌড়ল। সাড়ে নটা হয়ে গেছে, ওবাড়ির বৌদি আবার খুব রাগ করে দেরি হলে, তার অফিস বেরোনোর লেট হয়ে যায় কিনা!

কিন্তু তিন তিনবার বেল বাজিয়েও কেউ দরজা খুলল না দেখে যারপরনাই অবাক হল সে। বৌদি যদি বেরিয়েও যায়, ঠাকুমা আছে তো। বুড়ি আস্তে আস্তে নড়াচড়া করে, কিন্তু পায়ে পায়ে এসে দরজা খুলে দিতে পারবে না এমনও নয়! আর এখন তো বাবুনের ছুটি, সেও বাড়িতে থাকে সকালে।

এপাড়াটা একটু পুরোনো ধাঁচের। মাথা চাড়া দেওয়া ফ্ল্যাটগুলোর ফাঁকে ফাঁকে এরকম কিছু পুরোনো বাড়ি এখনো রয়ে গেছে। গেট পেরিয়ে চিলতে জায়গায় কিছু বেল জুঁই পাতাবাহার, দুধাপ গোল সিঁড়ি উঠে দরজা, তার ধারে নকল বাহারী ঘন্টার পিছনে লুকোনো আসল বেল।

মালতী কী করবে বুঝতে পারে না। ওর এর পর আরেক জায়গায় কাজ আছে, সেখানেই আগে চলে যাবে কি তাহলে?

ধাপি নেমে গেটের বাইরে এসে আবার দ্যাখে। দোতলা বাড়ি। ওপরতলায় একফালি বারান্দা গ্রিল দেওয়া খালি শুনশান। ওই দ্যাখো, জানলাগুলো খোলা। তার মানে সবাই মিলে কোথাও গেছে ওকে বলতে ভুলেছে তাও নয়।

না বাপু। ভাল বুঝছে না মালতী। কোমরের বটুয়া থেকে মোবাইলটা বার করে বৌদির নাম্বার ডায়াল করে সে।

সে ফোনও বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যায়।

এইবার ভয় ভয় করে মালতীর। প্রায় ছ বছর কাজ করছে এ বাড়িতে, রাগমাগ করলেও বৌদি মানুষটা খুব ভাল। বাড়ির বাকিরাও। এমন অশৈলী কাণ্ড কখনো দেখেনি।

পাশের দোকানটায় হানা দেয় সে, “অ বিশু, এবাড়ির দাদার নাম্বার আছে না তোর কাছে? কল কর না বাবা!”

“তুই কিছুই বুঝছিস না?”

ইন্সপেক্টর তমাল রায়ের প্রশ্নের জবাবে প্রায় ককিয়ে ওঠে অরিন্দম, “বলছি তো, কিচ্ছু জানি না! এ কী হল রে ভাই!”

বুঝছেন না তো তমালও। এভাবে বাড়িশুদ্ধু সব লোক উড়ে যায় কী করে! কচি খোকা নয় যে লুকিয়ে আছে, কমবয়েসী নয় যে পালিয়ে গেছে। একজন ক্লাস এইটের ছেলে, তার মা আর ঠাকুমা, সকাল সাড়ে আটটা অবধি যেমন থাকার ছিল, আর দশটায় হাওয়া! এ কী ভূতুড়ে ব্যাপার রে বাবা!

বিশুর ফোন পেয়েই অফিস থেকে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছে অরিন্দম। থানায় খবরও দিয়েছে। অন্যসময়ে মিসিং শুনেই পুলিশ কিছু নড়েচড়ে বসে না, কিন্তু এক্ষেত্রে এতই আশ্চর্য ব্যাপার – তাছাড়া তমাল এ পাড়ারই ছেলে, অরিন্দমের বাল্যবন্ধুও বটে।

গোটা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে ওরা। সব যেমন থাকার কথা তাই আছে, একটা কুটোও এদিক ওদিক হয়নি। মালতী জোর গলায় বলে গেছে, “আমি রোজ ঘরদোর ঝাড়ি দাদা, আমি জানি সব ঠিক আছে।”

বাবুনের টেবিলে টিনটিনের কমিক্স আধখোলা, হেডফোন জড়ানো পাকানো পড়ে। পুজোর কোনাটায় আসন পাতা, সামনে ঘটে জল, তাজা ফুল ছাতের গাছ থেকে তুলে আনা। অরিন্দমদের বেডরুমে খাটের উপর ওড়না পাট খুলে ছড়িয়ে রাখা, পাশে মৈত্রেয়ীর অফিসের ব্যাগ। মানে সে অফিস যেতে তৈরি হচ্ছিল, তুলে নিয়ে বেরিয়ে যাবে এরকম।

তারপর? কী হল তারপর?

“তারপর?”

এরকম আজব কথা জীবনেও শুনেছেন কিনা সন্দেহ হচ্ছিল শোভনার। নাতি প্রায়ই অনেক কিছু এটা ওটা এসে বলে, সায়েন্সের ব্যাপার – তাল রাখতে পারেন না তিনি, বোঝেনও না বেশির ভাগ সময়ে। কিন্তু এই কথাগুলো বুঝছিলেন মোটামুটি।

তাতে লাভ না ক্ষতি বলা মুশকিল। এরকম অভাবনীয় পরিস্থিতিতে পড়ার কথা কখনো ভাবেননি এটা ঠিক। তবে বাবুনের মায়ের চেয়ে তিনি মনে হয় একটু বেশি শক্ত, ভয় পেয়েছেন, খুবই পেয়েছেন, কিন্তু অন্তত অমন হাউমাউ করে কেঁদে ভাসাননি।

মৈত্রেয়ীর চোখে এখনো জল ছলছল করছে। বার বার মুখ মুছছে সে, আর ভাবছে, স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাচ্ছে না কেন! তাদের সঙ্গে যে সত্যিই এমন কিছু ঘটে গেছে, এটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে  পারছে না।

“তারপর… আমার খুব  ঘুম পাচ্ছিল আসলে। অথচ এমন ইন্টারেস্টিং গেমটা, যে ছাড়তেও পারছিলাম না। লেভেলটা সল্ভ করতে প্রায় পেরেও পারছিলাম না বলে জেদও চেপে গেছিল। শেষে যখন থাকগে বলে শুয়ে পড়তে যাব, দুম করে হয়ে গেল। আর তাতেই…”

“তোকে কতবার তোর বাবা বারণ করেছে বল তো, এরকম অনলাইন গেম খেলতে…”

বাবুন দৃশ্যতই চটে যায়।

“বললাম তো আমি করিনি। গেমটা নতুন ছিল, বাবাই নামিয়েছে কাল নিশ্চয়! তুমি কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করতে চাও না!”

শোভনা বোঝেন ব্যাপারটা এখন অন্যদিকে গড়াতে দিলে চলবে না। যাই হয়ে থাক, সেটা ওঁরা দুজনে কেউই পুরো বুঝবেন না, কিছু করতেও পারবেন না। যা করার, যদি কিছু করার থাকে, তার জন্য বাবুনই একমাত্র ভরসা ওঁদের। তার মনোবল এখন ভেঙে দিলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। তাই চোখের ইশারায় মৈত্রেয়ীকে  নিয়ে আর কিছু বলতে বারণ করে তিনি কথা ঘোরান, “তারপর কী হল বলো দাদাভাই। আমরা এখানে এলাম কী করে?”

বলতে বলতেই চারদিকে আবারও চোখ বোলান তিনি, ‘এখান’টা কোন খান সেটা যদিই বোঝা যায় সেই আশায়।

একটা অদ্ভুত আধো-অন্ধকার ঘরে বসে আছেন তাঁরা। চারদিকে দেওয়ালগুলো ইট বার করা, তাঁর কমবয়সে একবার এদের গ্রামের বাড়িতে গেছিলেন তিনি, সেইরকম পুরোনো পুরোনো, ছোট ছোট ইট। মৃদু একটা ফুলের গন্ধও আছে ঘরটায়, যদিও, কী ফুল মনে পড়ছে না তাঁর।

আর, ঘর বলছেন বটে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন তিনটেই দেওয়াল। অন্যদিকটা কত বড় বোঝা যাচ্ছে না, সুড়ঙ্গের মত সেটা সটাং চলে গেছে বহুদূর।

আজ সকালে রোজের মত পূজা সেরে উঠেছিলেন তিনি। নাতির মাথায় ফুল ছোঁয়াবেন বলে গেছিলেন তার ঘরে। বাবুন তখন বাথরুম সেরে এসে আবার পাশপবালিশ জড়িয়ে গড়াচ্ছিল , তাঁর ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলে উঠে বসেছিল সবে।

মৈত্রেয়ীও তখনই ঘরে ঢুকেছিল। “এখনো উঠিসনি বাবুন, আমার বেরোনোর সময় হয়ে গেল! মালতীও এল না এখনো…”

বলতে বলতেই ক্ষিপ্র হাতে বাবুনের টেবিলটাও গুছিয়ে দিচ্ছিল সে। অভ্যাস। ট্যাবটা তুলতে গিয়ে সুইচ অন হয়ে গেল, একটা ভয়ানক মনকেমন করা সুর বেজে উঠল।

“ওটা দাও, মা, আঃ, সবেতে তুমি অমন হাত দাও কেন…”

“ফের খেলতে খেলতে ঘুমিয়েছিস, এত বারণ করি…”

“দাও দাও, আমায় দাও, আমি রেখে দিচ্ছি।”

তিনজনেই একসঙ্গে ট্যাবটা ধরেছিলেন, কাড়াকাড়িতে কার আঙুলের ছোঁয়ায় কী হয়ে গেল কে জানে, দুম করে সারা ঘর ধোঁয়ায় ধোঁয়া হয়ে গেল আর সে কী কান ফাটানো শব্দ! শোভনা দেবী তো টলে মাটিতে বসেই পড়েছিলেন।

তারপর থেকে তাঁরা তিনজন এই ঘরটায়। বাবুন অনেক করে ঘুরে দেখে এসেছে, কোথাও কোনো দরজা নেই, যদিও হাওয়া চলাচল টের পাচ্ছেন। ওইদিকটায় অবশ্য মৈত্রেয়ী বেশি দূর যেতে দেননি। শোভনাও ভয় পেয়েছিলেন।

“ওই হবে কিছু বুঝলে। লেভেলটা ক্লিয়ার হবার পর দেখি একটা একদম নতুন অপশন দিল গেমটা, সঙ্গে একটা মস্ত বড় কন্ডিশনের লিস্ট। দারুণ একটা লেভেলে নিয়ে যাবে আমায়, সে নাকি অসামান্য এক্সপিরিয়েন্স, কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর যা হবে তার দায়িত্বও আমার – এরকম কিছু ছিল তাতে। ‘আই এগ্রি’টা টিপেও ফেলেছিলাম প্রায়, শেষ মুহূর্তে কেমন খটকা লাগল বলে রেখে দিয়েছিলাম ওভাবেই, কাল , মানে আজ উঠে পড়ে দেখব আরেকবার বলে। তারপর ওই টানাহ্যাঁচড়ায় মনে হয় ক্লিক হয়ে গেল।“

“হ্যাঁ রে, কী বলছিস এসব? গেম তো নেটে চলা যাই হোক, তাতে আমরা অন্য কোথাও চলে আসব কী করে? সব গুলিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাবুন – ভাল চাস তো পুরো খুলে বল আর কী করেছিস তুই!”

বাবুন এবার রীতিমত রেগে যায়।

“মা! বার বার বলছি আর কিছু জানি না! ঘুম থেকে উঠতেই তোমরা অমন হামলা করলে আর এসব কী হয়ে গেল! দাঁতটা অবধি মাজা হয়নি তোমাদের জ্বালায়। এখন আমার পিছনে না পড়ে কী করে ফিরে যাব সেটা ভাবো তো!”

“কেন, তোর ঐ হতচ্ছাড়া ট্যাবটা বার কর, করে দ্যাখ ওতে কী বলছে!”

বাঃ, রেগে থাকলেও মৈত্রেয়ী কথাটা ভাল বলেছে তো! ওতে চেপেই যদি তাঁরা এখানে এসে থাকেন, যদিও ব্যাপারটা কিছু বোঝেননি ঠিক শোভনা, তবু, তাহলে ওতে চেপেই ফেরা যাবে আবার নিশ্চয়!

“সেটাই তো মুশকিল গো মা, ট্যাবটা নেই তো!”

নিজের হাতের দিকে তাকান মৈত্রেয়ী। শোভনা আর বাবুনের দিকেও। না, সত্যিই নেই। কিছুই নেই তাঁদের কাছে এখন। বা ঘরটায়। ফাঁকা ঘরে, শোভনা আর বাবুন মেঝেতে বাবু হয়ে বসে আছে।

তিনিও ধপ করে ওদের পাশে বসে পড়েন এবার।

মালতী তার অন্য বাড়ির কাজ সেরে এসে খানিক রান্নাবান্না করে দিয়ে গেছে। যতই বিপদ হোক, মানুষকে পেটে কিছু তো দিতে হয়। অরিন্দমের বাড়িতে খবর গেছে, শিলিগুড়ি থেকে তার ভাই ভাই-বৌ চলে আসবে কাল।

পাড়ার পুরোনো সবাই এসে দেখা করে গেছে, নতুন ফ্ল্যাটবাড়িরও কেউ কেউ এসেছিল। অরিন্দমের অদ্ভুত লাগছে এসব। মালতী বলে গেল ফ্ল্যাটগুলোয় কানাঘুষোও হচ্ছে নাকি, হয়তো লোক লাগিয়ে ও নিজেই ফ্যামিলিকে হাপিস করে দিয়েছে এমনও বলেছে কেউ কেউ।

“আমি ছাড়িনি দাদা। বলেছি তোমরা চেনো না দাদাকে, তাই নিজেদের মত বদমাইশ ভাবছ! অত ভাল মানুষ একটা, অমন চাকরি করে, সে ইন্সুরেন্সের টাকার লোভে নিজের মা-বৌ-ছেলেকে হাপিস করবে, তোমরা পাগল না আর কিছু?”

অরিন্দম ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। অসহায়তা আর দুঃখ খেয়ে ফেলছিল তাকে।

কেমন আছে ওরা? কী করছে এখন?

বাবুনের ঘরে গিয়ে ওর খাটে বসেছিল অরিন্দম। কথাগুলো মনে হতেই আর থাকতে পারল না, হাঁটুতে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল সে।

“ফিরে আয় বাবা, ফিরে আয় মা ঠাম্মাকে নিয়ে। আমি কী করে থাকব বল?”

মৃদু ফুলেল গন্ধটা তখনই ভেসে এল নাকে।

এখানে এ গন্ধ কোথা থেকে এল?

এ তো ছোট্টবেলার স্মৃতি তাঁর। তাঁর ঠাকুমা আসতেন মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে, দুপুরবেলা তাঁর কাছ ঘেঁষে শুয়ে গল্প শুনত ছোট্ট অরু। ঠাকুমার মাথার চুল থেকে এই গন্ধটা ভেসে আসত।

খুব তেজী মানুষ ছিলেন। মনে আছে, মা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতেন যতদিন থাকতেন।

আজ হঠাৎ তাঁকে কেন মনে হল কে জানে।

“না রে, কিছুই ট্রেস নেই। সাধারণ গেম আজকাল যা খেলে সব বাচ্চারা। অনলাইন অ্যাক্টিভিটি পড়াশুনো ছাড়া আর কিছু নেই, রামি টামি ও না, এটা খুব আশ্চর্য যদিও, তবে তুই তো বললি লক করে রেখেছিলিস যথাসম্ভব। বারণ করলে কথাও শুনত বাবুন, যা দেখেছি। আর ওর খাতাপত্রেও কিছু নেই বলার মত।“

পরদিন বিকেলে একসঙ্গে চা খাচ্ছিলেন অরিন্দম আর তমাল। কাল বাবুনের ঘর থেকে ওর খাতা বই ডায়রি আর ট্যাবটা নিয়ে গেছিল পুলিশ। বন্ধুর জন্য চিন্তায় রাতে ভাল ঘুম হয়নি তমালের, আজ ডিউটি শেষ না হতেই ছুটে এসেছেন দেখা করতে। ট্যাবটাও অমনি হাতে করে নিয়ে চলে এসেছেন। কিছুই নেই যখন তখন ও আর রেখেও লাভ নেই।

“কী হল বল তো!”

“পাড়ায় খোঁজ নেওয়াচ্ছি রে। কোনো অচেনা লোকজন যদি এসে থাকে, কেউ দেখে থাকে…”

“অপহরণ, বলছিস?”

“সবই ভাবতে হবে। তুই কল পাসনি তো কিছু? টাকা চেয়ে টেয়ে?”

“না রে। কিছুই নেই তারপর থেকে।”

“মৈত্রেয়ীর ফোন?”

“সে তো ওর ব্যাগে পড়েছিল দেখলি। অফিস থেকে কিছু কল এসেছে কাল ওর ফোনে। আর কিছু না। ওটাও কি নিয়ে যাবি? দেখবি একবার তোরা যদি কিছু থাকে?”

“করা যায়, ক্ষতি নেই। দে দেখি, নিয়ে যাই আমি।“

অরিন্দম ফোন এনে দিলেন।

কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তমাল এরপর আর, “তুই সাবধানে বন্ধ টন্ধ করে থাকিস। অরিজিৎরা কখন পৌঁছবে?”

“রাত্রে বলল তো, তার আগের ট্রেনে পায়নি টিকিট, রাত হবে…”

“কিছু লাগলে ডাকিস।” উঠে পড়েন তমাল। আরেকবার থানা হয়ে যেতে হবে, এই ফোনটাও জমা করে দেবেন আজই।

গন্ধটা বার বার করে ধাক্কা মারছে নাকে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে শোভনার। মনে পড়ে পড়েও পড়ছে না কী ফুল এটা।

তিনজনে এখন লাইন করে ঐ ভিতরের দিকটায় যাচ্ছেন। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর মৈত্রেয়ীই প্রস্তাবটা দিয়েছিল।

“চল, দেখেই আসি ওদিকে কী আছে।”

“ঠাম্মা?”

মৈত্রেয়ীর হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শোভনা বলেছিলেন, “সবাই মিলেই যাব। আমি এখানে একা থাকতে পারব না বাপু!”

আস্তে আস্তে রওনা দিয়েছিলেন তাঁরা। সামনে বাবুন, মাঝে শোভনা, শেষে মৈত্রেয়ী।

অনেকটা চলে এসেছেন তাঁরা, পিছনে যেখানে তাঁরা বসে ছিলেন সে জায়গাটা আর দেখা যাচ্ছে না। অথচ ঘর, বা সুড়ঙ্গ, বা কী কে জানে, তার শেষ হবার কোনো লক্ষণই নেই।

কতক্ষণ হল তাঁরা এইখানে এসে হাজির হয়েছেন, সে হিসেবও পাচ্ছেন না। কেমন যেন সময় চলছেই না মনে হচ্ছে। খিদে তেষ্টাও কিছু পাচ্ছে না। অদ্ভুত!

চোখের ভুল, নাকি খুব দূরে এবার একটু আলো দেখা যাচ্ছে?

ট্যাবটা নিয়ে আপনমনে নাড়াচাড়া করছিলেন অরিন্দম। পুরোনো ট্যাব এটা, বিশেষ ভালোও নয়। নিজে নতুনটা কেনার পর এটা বাবুনকে দিয়ে দিয়েছিলেন, মূলত ওর পড়ার জন্য। অ্যাসাইনমেন্টের জন্য নেট ঘাঁটা তো আজকাল কমন হয় গেছে, বার বার ল্যাপটপটা নিয়ে টানাটানি করলে অসুবিধে হয়, ওঁর নিজের কাজ থাকে, মৈত্রেয়ীরও এক এক দিন অফিসে লগিন করতে হয় বাড়ি ফিরেও।

স্বাভাবিকভাবেই, ছেলে কিছু গেম টেমও খেলত তিনি জানেন, ওই বয়েসে হলে তিনি নিজেও কি আর খেলতেন না? তবে ব্লু হোয়েল স্কেয়ারের পর যথাসম্ভব সেফটি প্রিকশান নিয়ে রেখেছিলেন, মাঝে মাঝে নিজেও খেলাচ্ছলে সঙ্গে বসে চেক করে নিতেন ইদানীং কী কী দেখছে। কখনো কোন গড়বড় দেখেননি বলে নিশ্চিন্তই ছিলেন ছেলেকে নিয়ে।

জিতুদের ট্রেন লেট করছে। মাঝরাত পেরিয়ে ঢুকবে। অত রাতে আর আসবে না বলেছে, রাতটা স্টেশনে ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে সকালে চলে আসবে। একা বাড়িটা অরিন্দমকে যেন গিলে খেতে আসছিল। নিজেকে ভুলিয়ে রাখতেই ট্যাবটা অন করলেন অরিন্দম। ঘুম আসছে না। আসবে না আজ। বরং এভাবেই একটু ছেলেকে ছোঁয়ার চেষ্টা করা যাক, আর কী!

আনমনে স্ক্রীনে আঙুল বোলাচ্ছিলেন অরিন্দম। লাস্ট বাবুনের সঙ্গে বসার পর বেশ কিছুদিন গ্যাপ হয়ে গেছে, এখন মনে হচ্ছে। অফিসে খুব চাপ যাচ্ছিল। বেশ কিছু নতুন গেমের শর্টকাট দেখতে পাচ্ছেন যেগুলো তাঁর অচেনা।

তবে সবকটাই খুব সাদামাটা, লজিকের গেম, বা পাজল। বাবুনের ইন্টারেস্ট ও দুটোতেই।

ফিরে হোম স্ক্রীনে আসতেই একটা খটকা লাগল। এই আইকনটা ছিল কি এতক্ষণ?

দেখেননি তো!

মিস করে যাওয়া অবশ্য খুব অসম্ভব না। ভীষণ সাধারণ দেখতে একটা আইকন, গোলের মধ্যে আরেকটা গোল, তার মধ্যে ক্রস একটা। রঙগুলো এত বাজে, একটা আরেকটার সঙ্গে মিশেই গেছে যেন। তার ওপর বাবুনের ফোনের ওয়ালপেপার হচ্ছে  এক ফুটবল প্লেয়ার, আর আইকনটার রঙ তার জার্সির রঙের সঙ্গে প্রায় এক, ফলে আরোই দেখা যাচ্ছে না।

চোখে পড়েনিই হবে।

গেমটা খুললেন অরিন্দম।

বাবুন থমকে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ। শুনতে পাচ্ছ?

শুনতে ওঁরাও পাচ্ছিলেন বইকি। মিঠে, হালকা মিউজিক একটা।

“এটাই! এটাই তো!”

“কী রে?”

“এইটে ঐ গেমটার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মা! কেউ ওটা খেলছে আবার নিশ্চয় আমার ট্যাবে!”

“তাহলে?”

“সেটাই তো, এবার কী হয়…”

মৈত্রেয়ী চিন্তিত ভাবে ছেলের দিকে চেয়ে থাকেন। শোভনা দুজনের মুখ দেখেন। বোঝেন না ঠিক এত চিন্তার কী হল। মৈত্রেয়ী আবার বলে,

“তারপর কী হবে রে? আমরা উদ্ধার পাব এখান থেকে? নাকি…যদি উলটে…?”

এইবার শোভনা ওদের চিন্তার কারণটা বোঝেন। অরু, মানে অরু ছাড়া আর কেউ তো নেই বাড়িতে, নিশ্চয় গেমটা দেখছে এখন। যদি খেলতে খেলতে সেও এরকম আটকে যায়?

তাঁর না ভাবা আশঙ্কাটা বাবুনই বলে উঠল এবার, “তাছাড়া, মা, বাবা যদি অদ্দূর যেতেও পারে, আর অমন নেক্সট লেভেলে যায়ও, এখানেই এসে পড়বে কিনা তা কিন্তু আমরা জানি না। হয়তো স্কোর অন্য হলে অন্য কোথাও গিয়ে আটকে যাবে!”

শোভনার মাথা প্রায় ঘুরতে থাকে। ওরে বাবা! একবার নিজেরা আটক হয়ে রক্ষা নেই, আবার ছেলেটাও কোথায় না কোথায় গিয়ে পড়বে!

মৈত্রেয়ীও বিলক্ষণ ঘাবড়ে গেছিল। কিন্তু ইতিকর্তব্য ঠিক করল সে-ই।

“দ্যাখ, যা হবার হবে। আমরা যেমন এগোচ্ছি এগোই চল! যা হবে, দেখা যাবে।“

তখনই, শোভনার মনে পড়ে গেল ঠিকঠাক।

অরিন্দম ভাবেননি, একটা এত পাতি দেখতে গেম এরকম ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠবে দু লেভেলের পর থেকেই। প্রতিটা লেভেল আলাদা আলাদা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে, যেন ইন্টারনেটের সমস্ত জনপ্রিয় গেমের নির্যাস খুঁজে নিয়ে এটা বানানো হয়েছে। পরিচিত সব গেমগুলোর ফ্লেভার পেলেও, এটার মধ্যে আরো কিছু একটা ব্যাপার আছে। প্রতি ধাপে এটা কিছু নতুন জিনিস অ্যাড করছে তাঁর ঝুলিতে, যা পরের ধাপে ব্যবহার করা যায়। সে অনেক গেমই করে, তফাৎ হচ্ছে সোনা দানা, লাইফ সেভিং মেডিসিন, অস্ত্রশস্ত্র, খাবার এসব স্ট্যান্ডার্ড জিনিস ছাড়াও গেমটা আরেকটা জিনিস স্টক করছে যা তিনি আগে কখনো দেখেননি।

স্বভাব। বা বলা ভাল, অনুভূতি।

বিভিন্ন আবেগ এবং দোষ-গুণ জড়ো হচ্ছে তাঁর লেভেল পার করার ক্ষিপ্রতা ও কৌশল অনুযায়ী। এখন যেমন তাঁর ঝুলিতে আছে ৩০% রাগ, ১৫% সাহস, ২২% জেদ ইত্যাদি।

আরো অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তিনি নিজেও অবিকল অমনই অনুভব করছেন এই মুহূর্তে।

গেমটা যেন তাঁর ব্রেনে ঢুকে মেপে আনছে এগুলো।

এই লেভেলটা তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন। এখন আর আঙুল অত ক্ষিপ্রতায় নড়াচড়া করে না। এরকম স্টেজগুলো তিনি সাধারণত বাবুনের হাতেই ছেড়ে দেন। কিন্তু আজ…

কেন জানি না মন বলছিল, ওদের উধাও হয়ে যাওয়ার সঙ্গে এই নতুন গেমটার কিছু যোগ থাকতে পারে। মনের মধ্যে একটা তাগিদ টের পাচ্ছিলেন, যে খেলা ছাড়া যাবে না, শেষ অবধি দেখতেই হবে।

ফুলেল গন্ধটা তখনো ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু অরিন্দমের আর সেদিকে মন ছিল না। গাড়িটাকে ক্র্যাশ থেকে বাঁচাতে হবে…

—-

একটা ভয়ংকর আওয়াজ হয়ে সবশুদ্ধু পায়ের তলায় মাটি কেঁপে উঠল। মৈত্রেয়ী ধরে না ফেললে, শোভনা পড়েই যেতেন। গুরুগুরু আওয়াজটা যেন কানের ঠিক সামনে হচ্ছে এত জোর হচ্ছিল তখনো।

ওরা তিনজনেই ঘাবড়ে গেছিলেন। এটা কী হচ্ছে?

“কী করবি রে? পিছনে ফিরে যাব?”

সেই আলোটা এখন আর মনের ভুল নয়, বহু বহু দূর হলেও, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ওটা লক্ষ্য করেই প্রাণপণে পা চালাচ্ছিলেন ওঁরা।

“সে তো বহুদূর মা! যেতে যেতে আবার যদি এমন হয়…”

বলতে না বলতে আবার সেই সাংঘাতিক শব্দ। ধাক্কাটা এত জোর এল যে তিনজনেই মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে গেলেন। দেওয়াল অবধি কেঁপে উঠেছিল, একদিক থেকে কিছু ইট খসে পড়ে গেল ওঁদের চোখের সামনে।

“এগো, এগো, চল!”

কয়েক পা মাত্র গেছেন ওঁরা, আবারও সেই ধাক্কা! এবার শুধু হুড়মুড় করে ইট খসেই পড়ল না, পিছনে মাটিতেও ভীষণ আওয়াজে চিড় ধরল একটা।

“বুঝেছি! মা! ও মা! বাবা গো!”

মৈত্রেয়ী আর শোভনা হাঁ করে বাবুনের দিকে চেয়ে থাকেন।

“আরে দূর, বুঝছ না? বাবা গেমটা খেলছে! অনেকটা খেলে ফেলেছে। এটা ইলেভেন্থ না টুয়েল্ভথ লেভেল। এই কার রেসিং ব্যাপারটা বাবা একদম পারে না, তাই বার বার ক্র্যাশ করছে।“

মৈত্রেয়ী ফিসফিস করে বলেন,

“যদি লেভেল ক্লিয়ার করতে না পারে? যদি ডেস্ট্রয় হয়ে যায়, আমরাও কি তাহলে…?”

বাবুন এটা ভাবেনি আগে বোঝা যায়। দৃশ্যত ভয় পেয়ে গেছে সে।

“কী সর্বনাশ! ও মা, কী হবে গো?”

মৈত্রেয়ী শোভনাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে নিয়েছিলেন, ওঁর ভয় হচ্ছিল বুড়ো মানুষটা এরকম পড়ে গিয়ে চোট না পান আবার! ঐভাবেই যথাসম্ভব দ্রুত এগোতে এগোতে তিনি বললেন, “চলে আয়, চলে আয়… যে করে হোক ঐ আলোর কাছে পৌঁছতেই হবে আমাদের তার আগেই। দাঁড়াস না, যাই হোক না কেন, পা চালিয়ে এগোতে থাক।”

শোভনা পরিষ্কার তাঁর শাশুড়ির গলাই শুনতে পেলেন যেন মৈত্রেয়ীর কথার মধ্যে। খুব দাপুটে মহিলা ছিলেন, অল্প বয়েসে তিন সন্তান নিয়ে বিধবা হবার পর একা হাতে শুধু সংসারের হালই ধরেননি, শ্বশুরের জমিজমা আর হাটের দোকান সব দ্যাখভালও নিজে করে ছেলেদের দাঁড় করিয়েছিলেন। এই যা মৈত্রেয়ী বলল, সেই কথাটা ছেলে-বৌ সবাইকে বার বার করে বলতেন তিনি।

‘কিছুতেই হার মানার নেই। যা-ই হোক, শেষ অবধি লড়ে যেতে হয়।‘

এই যে নাম মনে করতে পারছিলেন না, এই ফুলের গন্ধটা সবসময় তাঁকে ঘিরে থাকত। তুলনায় দামী মাথার তেলটাই তাঁর জীবনের একমাত্র শৌখিনতা ছিল।

বেতো হাঁটুতেও কেমন জোর পান শোভনা এসব মনে পড়ায়। বাবুন আর মৈত্রেয়ীকে অবাক করে হাঁটার স্পীড আপনি বেড়ে যায় তাঁর।

—-

অরিন্দমের কপালে ঘাম জমে গেছিল। শেষ অবধি যাস্ট কোনরকমে ক্লিয়ার করেছেন তিনি লেভেলটা। বুকের মধ্যে দামামা বাজার মত লাগছিল।

একটা গেমই তো! নাকি?

কেন যেন মনে হচ্ছে তাঁর ঐ গেম ঠিক করে খেলার উপরেই সব নির্ভর করছে।

ঝুলিটার খুব খারাপ দশা। একটা মাত্র লাইফ পড়ে আছে, মেডিসিন শেষ, অস্ত্রর মধ্যে বোমাও শেষ।

৯৩% রাগ, ৬৪% জেদ, ৮৯% হিংস্রতা, ৩৩% বিরক্তি।

একটু বিশ্রাম দরকার। উঠে জল খেলেন। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন অনেককাল, আজ ইচ্ছে করছিল খুব খেতে। মন ঘোরাতে বাবুনের টেবিলের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। ছবি আঁকার খাতাটা, কতদিন খেয়াল করে দেখেননি তো কী আঁকে আজকাল। গ্লোবটা গত জন্মদিনে দিয়েছিলেন। সাজিয়ে রাখা দুটো ফটো ফ্রেম। একটায় তাঁরা তিনজনে, অন্যটায় ঠাম্মা আর নাতি। দুটোই এক এক করে হাতে তুলে অনেকক্ষণ দেখলেন।

কান্না পাচ্ছিল খুব।

ট্যাবটা মিহি মিউজিকটা বাজিয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ওটা আবার হাতে তুলে নিলেন উনি।

৯৩% রাগ, ৬৪% জেদ, ৮৯% হিংস্রতা, ৩৩% বিরক্তি।

দেখামাত্র মনটা পালটে গেল আবার। দাঁতে দাঁত চেপে পরের লেভেলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন উনি।

“এবার কী করব রে?”

মৈত্রেয়ীর গলা অসহায়, আর্ত শোনাল।

ওদের সামনে একটা গভীর খাদ। বিশাল চওড়া। লাফিয়ে পেরোনোর কোনো প্রশ্নই নেই, এত বড়।

বাবুন কিন্তু একটুও ঘাবড়ায়নি দেখা গেল।

“অপেক্ষা করব। এটা লজিক দিয়ে সলভ করার ছিল, বাবা এটা পেরে যাবে। একটু ওয়েট করো, ব্যস।”

—-

অরিন্দম ভ্রূ কুঁচকে ভাবছেন। ভেবে যাচ্ছেন অনেকক্ষণ ধরে। একটাই লাইফ বেঁচে, রিস্ক নেওয়া যাচ্ছে না।

নাঃ, এটা ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবে দেখেছেন উনি।

বাটনটা ক্লিক করতে গিয়ে হাত কেঁপে গেল একটু।

উচ্ছল মিউজিকের সঙ্গে সবুজ টিক বোঝাল চয়েসটা একদম ঠিক হয়েছে। সামনের আঁকা খাদটার উপর ঘরঘর শব্দে একটা পাটাতন বেরিয়ে এসে জমিটা সমান করে দিল।

আরে বাঃ, আরেকটা লাইফও পাওয়া গেছে! অরিন্দম নবোদ্যমে পরের লেভেলে ঢুকে গেলেন।

—-

আলোটা অনেকটা কাছে এবার। কিন্তু ওরা এগোতে পারছে না আর এক পা-ও।

একটা কাচের দরজা সামনে। বাবুন সব তন্নতন্ন করে দেখেছে, কোথাও কিছু নেই যা দিয়ে এটা খোলা যেতে পারে।

শক্ত কাচ। ভাঙার মত কিছু থাকলেও ভাঙা যেত না। বাবুন বলছে বুলেটপ্রুফ কাচ, ঐ গেমে তেমনই ছিল নাকি।

অসহায়ের মত কাচের মধ্যে দিয়ে আলোর দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে ওঁদের! দরজাটা খুলে দিতে হবে অরিন্দমকে। নইলে…

—-

অরিন্দম খুব দোটানায় পড়েছিলেন।

গেমটা ওঁকে দুটো অপশন দিচ্ছে।

দরজাটা খুলে ফেলতে পারলে, গেম শেষ, তিনি জিতে যাবেন।

অথবা এই লেভেল স্কিপ করে গেলে, তাঁকে বোনাস আরো একটা গেম খেলতে দেওয়া হবে ফ্রীতে, যেটা এর চেয়েও মজাদার, এর চেয়েও চ্যালেঞ্জিং, এর চেয়েও বেশি রিয়াল লাইফ অ্যাওয়ার্ড এর কুপন থাকবে তাতে, ইনক্লুডিং হিউজ ক্যাশ বেনিফিট।

অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, স্কিপ করে যেতে ভয়ানক লোভ হচ্ছে তাঁর। গেমটা এত আকর্ষণীয়। শেষ হয়ে যাবে ভাবতেই মনটা কেমন বিদ্রোহ করে উঠছিল।

গেমই তো!

ইনক্লুডিং হিউজ ক্যাশ বেনিফিট – এটা আরেকবার পড়লেন তিনি। জোশ আসছিল। স্কিপ বাটনের দিকে হাত বাড়ালেন।

গন্ধটা শুধু নাকে নয়, গালেও চড় মারার মত এসে ঝাপটা দিল।

এটা কী করছেন তিনি?

গেমটা কেন খেলছিলেন? মনে হচ্ছিল এর সঙ্গে বাবুনদের হারিয়ে যাওয়ার যোগ আছে, তাই না? গেমটায় জিততে পারলে হয়তো ওরা নিরাপদে ফিরে আসবে! তাহলে, আর কিছুর প্রশ্ন আসে কোথা থেকে! তাঁর নিজের অন্যান্য বেনিফিটের কথা আদৌ মাথায় আসছে কেন তাঁর?

বিচলিত ভাবে ভুল করে মেইন স্ক্রীনের বাটন টিপে ফেলেছিলেন। আবার গেমটায় ফেরত যেতে ব্যাপারটা ঘটল।

পুরোনো ট্যাব, এমনিই একটু স্লো হয়ে যায় মাঝে মাঝে, তায় এতক্ষণ টানা খেলেছেন। হয়তো তাতেই গরম হয়ে গিয়ে স্ক্রিন ফ্রিজ করে গেছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।

তাতেই চোখে পড়ল ওঁর।

৫০% দায়িত্ব, ৮৫% মন খারাপ, ৪১% সাহস, ৮৪% লোভ।

চোখের সামনে লেখাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠে পালটে গেল।

৬৩% বুদ্ধি, ৭১% সাহস, ৬৪% জেদ, ৯৮% উচ্চাশা।

পালটে যেতে থাকলে তাঁর মনের ভাবনাগুলোও। এইমাত্র যা যা বুঝেছিলেন, ভেবেছিলেন সব আবার কেমন অবান্তর লাগতে শুরু হল আবার।

কিন্তু ফুলের গন্ধটা তখনো নাকে লেগে ছিল বলেই হয়তো এবার আর ব্যাপারটা বুঝতে ভুল হল না অরিন্দমের।

গেমটা তাঁর মনের মধ্যে ঢুকে মানসিক অবস্থা মেপে এনে দেখাচ্ছে না।

গেমটা তাঁর ভাবনাচিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ওটার ইচ্ছামত মানসিক অবস্থা তাঁর মনে চারিয়ে দিচ্ছে। কী করে তিনি জানেন না, কিন্তু এটাই হচ্ছে এ নিয়ে তাঁর আর সন্দেহ নেই।

এটাকে জিততে দেওয়া যাবে না! অসম্ভব!

দাঁতে দাঁত চেপে, মনের মধ্যে ভেসে আসা সব প্রম্পটকে অগ্রাহ্য করে, ‘কন্টিনিউ লাস্ট লেভেল’ টিপলেন অরিন্দম।

দরজাটা আচমকা খুলে যাওয়ামাত্র ছুট মেরেছিলেন তিনজন মিলে। আলোটার কাছাকাছি আসতেই মাটি কেমন পায়ের তলা থেকে আপনি সরে গেল, তিনজন পাশাপাশি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য এক টানে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলেন উজ্জ্বল, চোখ ধাঁধানো আলোটার দিকে।

আওয়াজটা মৃদু হল এই বার। আবার মুখ থুবড়ে পড়েছেন। আস্তে আস্তে মুখ তুললেন শোভনা।

বাদামী টালি বসানো মেঝে। ঘিয়ে রঙের দেওয়াল। ডোরাকাটা পর্দা উড়ছে একটু একটু। দেওয়ালে চেনা পেন্ডুলাম ঘড়ির বিল্লিটা ল্যাজ নাড়াচ্ছে।

বাবুনের ঘর। শোভনা আর বাবুনও ওর পাশে উঠে বসছে।

অরি খাটে বসে ছিল, ছুটে আসছে এবার। কী বলছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ইশ, এত বড় ছেলে এমন করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে বলে খুব লজ্জা করছিল শোভনার, কিন্তু তিনি নিজেও হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন বলে কিছু বলে উঠতে পারলেন না।

ট্যাবের উপর “ইউ উইন” লেখাটা ব্লিঙ্ক করতে শুরু করল এবার। তার নিচে খুব হালকা রঙে তখনো পড়া যাচ্ছিল, ১০০% ভালবাসা।

সব মুছে গেল তারপর। আপনা আপনি হোম স্ক্রীন চলে এল, যার কোত্থাও আর সেই আইকনটা নেই। গোলের মধ্যে গোল, তার মধ্যে ক্রস দেওয়া সেই আইকনটা, যার নীচে ওইরকম ম্যাড়মেড়ে রঙ দিয়েই লেখা ছিল “মেজ অফ লাইফ”।

Recent Comments

Leave a Comment