চলার পথে — পর্ব ২

চলার পথে — পর্ব ২

গতবারে লিখেছি মদমহেশ্বরের কথা।  তারপর গেছিলুম আরেকবার, বছর দুই পরে। এবারে যাত্রা তুঙ্গনাথ আর কল্পেশ্বর, পঞ্চকেদারের আর দুটি (পঞ্চকেদারের গল্প আছে চলার পথে-পর্ব ১ এ)। সেই রকম, বা তার চেয়েও বেশি নির্জন অপরূপ রাস্তা, পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে কেটে চাষের জমি, বাড়িগুলোর টিনের চাল বড় বড় ফ্ল্যাট পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা যাতে ঝড়ে উড়ে না যায়,  পথে গ্রামে কোথাও কারো বাড়িতে, কোথাও স্কুলঘরে রাত কাটানো, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা, মোটা মোটা রুটি আর আলুর সবজি, ঘুম থেকে উঠে পাহাড়ি পথে হেঁটে গিয়ে ঝোরার জলে মুখ হাত ধোওয়া। যেমন নীল আকাশ, তেমন সবুজ প্রকৃতি।

এবার, কল্পেশ্বর থেকে নামার পথে এল বৃষ্টি। তুমুল পাহাড়ি বৃষ্টি। ঢালু, এবড়োখেবড়ো, পাথর ফেলে ফেলে বানানো ওই রাস্তায় এমনিই সারাক্ষণ সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হয়, সেখানে অঝোর বৃষ্টিতে চলার চেষ্টা করা যে কী বিপজ্জনক, বুঝতেই পারছেন। একটা ছোট্ট গ্রাম দেখতে পাওয়ামাত্র এক বাড়ির দাওয়ায় আশ্রয় নিলুম সবাই।

বেশি না, মিনিট দশ হবে। পিছনে খুট করে দরজা খুলে গেল, গুটিকয় বাচ্চাকাচ্চা উঁকি মারল, এবং তাঁদের পিছন থেকে গৃহস্বামী বললেন, ভিজে যাচ্ছেন, ভিতরে এসে বসুন।

সত্যিই পুরো ভিজে গেছিলুম, শীতও করছিল। একটু ভদ্রতা করা হয়েছিল, ভদ্রলোক পাত্তাই দিলেন না, আমরাও সুড়সুড় করে ভিতরে ঢুকে কাঠের মেঝেতে পাতা চাটাইতে বসে পড়লুম।

পাহাড়ি মানুষদের আতিথেয়তা সুবিদিত, অমনি সে এক প্রবল আপ্যায়নের ধুম পড়ে গেল। ভিজে রেনকোট ইত্যাদি খুলে নিয়ে যাওয়া হল, আংটায় আগুন জ্বেলে আনা হ’ল, তারপর গ্লাসে গ্লাসে চা এল। এই চা বলতে আরেকটা গল্প মনে পড়ল, পরে বলব। তো আমরা তো আরাম করে বসেছি, হঠাৎ চমকে উঠেছি, বুঝলেন। বাচ্চাগুলোর মধ্যে একজন বিনুনি বাঁধা মেয়ে, শুরু থেকেই আমার পাশ ঘেঁষে বসে ছিল, করেছে কী, ওই আংটার আগুনে হাত তাতিয়ে নিয়ে, সেই হাত দিয়ে আমার পিঠে সেঁক দিতে শুরু করেছে। শীতে কাঁপছিলুম, সেটা দেখেছে বলে। চোখাচুখি হতেই লাজুক হেসে দ্বিগুণ উৎসাহে আরো করতে লাগল।

সে যে কী আশ্চর্য অনুভূতি! চেনা নেই শোনা নেই, আজকের পর জীবনে আর দেখা হবার সম্ভাবনা নেই – এইটুকু সময়েই এত আপন করে নিতে পারে কেউ!

ওদিকে বৃষ্টিও পড়েই যাচ্ছে মুষলধারে। গৃহস্বামী ও তাঁর গিন্নি আমাদের সব আপত্তি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে খিচুড়ি বসালেন, নিজে সামনে বসে থেকে যত্ন করে খাওয়ালেন, মিলিটারিতে কাজ করেন, ছুটিতে এসেছেন এখন –  টুকটাক গল্প শোনালেন। তারপর যখন অবশেষে বৃষ্টি থামল,  আমরা চলে আসব, তখন বহু অনুরোধ সত্ত্বেও কিচ্ছুটি নিতে রাজি হলেন না,  খালি হাত জোড় করে জিভ কেটে বলেন “অতিথিসেবা করেছি।”

এই পুরো সময়টা সোনু নামের সেই মেয়েটি আমার সঙ্গে সেঁটে ছিল। তখন আমি একেবারেই ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলি, তাই কথা হচ্ছে খুব অল্প। কিন্তু সেও জড়িয়ে আছে, আমিও মাথায় হাত বুলোচ্ছি খালি। বিদায়পর্বে চোখ ছলছল, ছাড়তেই চাইছে না। তখন অনেক কষ্টে, চিঠি লিখব প্রমিস করে, ঠিকানা নিয়ে, নানা প্রবোধ দিয়ে বিদায় নিতে হল

 তখন অনেক সাধনার পর কানে কানে বলেছিল ওর চুড়ি পরতে খুব ভালো লাগে। কলকাতা ফিরে সেই ঠিকানায় চিঠির সঙ্গে চুড়ি, হার, ছোট্ট বাহারি ব্যাগ এরকম নানা কিছু পাঠিয়ে দিতে পেরেছিলুম, প্রাপ্তিস্বীকারও এসেছিল স্কুলের বালিকার অসমান গোল গোল হিন্দি হস্তাক্ষরে। আরো এক দুবার চিঠি চালাচালি হয়েছিল মনে হয়, তারপর যোগাযোগ হয়নি আর।

আচ্ছা বলুন তো, এই মানুষগুলোর মধ্যেই কি আসল দেবতার বাস নয়? তুঙ্গনাথ কল্পেশ্বরে দেবতাত্মা হিমালয় দর্শন করে আমার কী পুণ্য হয়েছিল তা জানি না, কিন্তু এই যে ভারতবর্ষের আত্মা দর্শন করে ফেলেছিলুম এই ট্রিপে – এর কি কোনো তুলনা হয়?

Leave a Comment