চলার পথে – পর্ব ৫

চলার পথে – পর্ব ৫

জাপানের গল্প (২)
টোকিও বড্ড সুন্দর শহর। এত ছিমছাম, পরিপাটি সাজানো, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত। অথচ বেজায় স্থানাভাব, এইটুকু-টুকু জায়গায় কতরকম কায়দা করে যে স্পেস ম্যানেজমেন্ট করা – না দেখলে ভাবা যায় না! আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল সার্ভিসড অ্যাপার্ট্মেন্টে, তাতেই ছোট্ট সাজানো কিচেন ছিল নিজে রান্না করে নেবার জন্য। সক্কালবেলা রেডি হয়ে বেরিয়ে টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে এ গলি, ও গলি দিয়ে, এখানে রাস্তা ক্রস করে, ওখানে স্কুলটার পাশ দিয়ে এক্সট্রা নিঃশব্দে হেঁটে অফিস চলে যেতুম। সারা রাস্তা পাশের বিভিন্ন শেপে সাজানো ফুলগাছ দেখতে দেখতেই কেটে যেত। সেই প্রথম দেখি, রাস্তা পেরোলে দুপাশের গাড়ি থেমে যায়। প্রথমদিন সিগনাল না বুঝে হুট করে রাস্তায় নেমে পড়েছিলুম, বাঁদিক থেকে আসছিল ধুমসো ট্রাক, এমনি যা ট্রাক দেখি তার চেয়ে ঢের বড়ো আর ঢের বেশি মারকুটে দেখতে – আমি তো ভয় পেয়ে থেমে গেছি, ও মা, দেখি সে ট্রাকও দাঁড়িয়ে আছে, নট নড়নচড়ন। আমি বিদেশী বুঝে, ট্রাক থেকে ঝুঁকে পড়ে হাত নেড়ে ড্রাইভার ইশারায় চলে যেতে বললেন। এপারে এসে থ্যাঙ্কু বলতে গিয়ে আরেক চমক, দেখি একগাল হাসিতে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ড্রাইভারটি একজন মহিলা।
আমি চিরকালের ন্যালাক্যাবলা, কিন্তু কী করে জানি না ঠিক যেখানেই গিয়ে পড়ি, বন্ধু হয়ে যায় কিছু। সেই ঘোর ফর্মাল ব্যাঙ্কের সারাক্ষণ কোমর ঝুঁকিয়ে বাও করে বেড়ানো জাপানী লোকজনের মধ্যেও কয়েকজনের সাথে দোস্তি জমে গেল কদিনের মধ্যেই। আমার উত্তেজিত হয়ে গলা চড়িয়ে তড়বড় করে কথা বলে ফেলার অভ্যেস আর গোল-গোল বাঙালি অ্যাকসেন্টের ইংরিজি তারা দিব্যি তাদের ফুটিফাটা ইংরিজি, দরকারে ইশারা ইঙ্গিত আর সারাক্ষণ হাসিমুখ দিয়ে দিব্যি কাউন্টার করতে লাগল। তাদের কল্যাণে আমি মল্ট বিয়ারের উপকারিতা থেকে, ওদের কলেজে কীভাবে ক্লাস হয় থেকে, সকারের প্র‍্যাক্টিশ কেমন করে হয়, কিমোনো কেন একা একা পরা অসম্ভব, বিয়েতে কজনকে ও কাকে কাকে নেমন্তন্ন করতে হয় অবধি সব শিখে গেলুম। মাসখানেকের মধ্যেই দেখি তারা সিগারেট ব্রেক নিলে আমায় ডেকে নেয় সঙ্গে – আজ্ঞে না, ওটি খেতুম না, তবে আড্ডাটি পুরোদস্তুর উপভোগ করতুম। অফিসের পর সন্ধেয় বেরিয়ে হয়তো কেউ বলে বসত, আমার কেনাকাটা আছে, চলো সঙ্গে, তোমায় সুপারমার্কেট দেখাই। আমিও দিব্যি লাফাতে লাফাতে চলে যেতুম, এই এখন যেমন ম্যল হয়েছে সেইরকম ব্যাপারস্যাপার – বেজায় নতুন তখন আমার জন্য – একধারে খাদ্যের স্যাম্পল নিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিষ্টি মেয়ে, হয়তো বা দুম করে তার থেকে দুটো ডিশ তুলে একটা আমায় ধরিয়ে দিত  “খাও খাও, আমি খুব ভালোবাসি” বলে। চৌকো চৌকো কী যেন, সস দেওয়া। খেয়ে নেবার পর জানতে পারতুম সেটা স্কুইড, কিংবা অক্টোপাস।

বলেছিলুম না, শনি রবি একা একাই চুটিয়ে ঘুরে বেড়াতুম? সে এই বন্ধুদের ট্রেনিং-এর ভরসায়। এক শনিবার কিছু না পেয়ে একটা বোট ক্রুইজেই চলে গেছিলুম। ছোট্ট নদী, আমাদের গঙ্গা দেখা চোখের সামনে হাস্যকর রকমের ছোট, কিন্তু দুপাশের ঢালে কী অপূর্ব সুন্দর করে মেইন্টেইন করা ফুলে ভরা বাগান, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ওই যে বললুম বড় সুন্দর শহর, জায়গা এত অপ্রতুল ওদের কিন্তু নিজেদের ঘরে তো বটেই, পাবলিক প্লেসের প্রতিটি ইঞ্চিও ঝকঝকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা থাকে।  আরেক নতুন ব্যাপার দেখে থ হয়ে গেছিলুম – আন্ডারগ্রাউন্ড ওভারহেড দুরকম ট্রেনই চলে ওখানে, মাটির নিচে দু তিন লেয়ার, আবার মাটির উপরেও দু তিন লেয়ার ট্রেন লাইন। আমার ব্যালকনি থেকে দেখা যেত ট্রেন কেমন বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। নীচে সেই ত্রেনের এক ঝলক।

ভাষা কেউই প্রায় বুঝত না। তাতে কুছ পরোয়া নেই – মানুষ যখন ভাষা সৃষ্টি করেনি, তখনও কি আর ভাববিনিময় হত না! আমি তো ওইভাবেই ইঙ্গিতে হাত মাথা নেড়ে নেড়ে নিজের কথা বুঝিয়েই বৌদ্ধ প্যাগোডায় এবং খাঁটি দেশজ শ্রাইনে ধুপ জ্বেলে জাপানী পুরোহিতের আশীর্বাদ নিয়ে এসেছি, গলির ধারের ছোট্ট ঠেলায় টিফিন নিয়ে বসা অজস্র কাটাকুটিতে কুঁচকোনো মুখ আর একগাল হাসির লাল টুকটুকে বুড়িমানুষের থেকে স্টিকি রাইস আর ঝোল ঝোল বোনলেস চিকেন কিনে চামচ চেয়ে নিয়ে  খেয়ে রান্নার প্রশংসা করেছি এন্তার, দোকানের সেলসগার্লদের পটিয়ে কিমোনো কী করে স্টেপ বাই স্টেপ পরতে হয় তার ডেমো দেখে এসেছি, এম্পারার্স গার্ডেনে অচেনা মানুষকে অনুরোধ করে নিজের ছবি তুলিয়েছি। এই এম্পারার্স গার্ডেনের মত স্বর্গীয় ব্যাপার আমি আর দেখিনি। জাপানী গার্ডেনের সৌন্দর্য যে আলাদা সে তো জানা কথা, এ তার মধ্যে সেরার সেরা। রাত্রে নিশ্চয় ওখানে পরীরা ঘুরতে আসে।\

মোদ্দা কথা, কাজের চাপটুকু অভ্যাস করে নেবার পর সবদিক দিয়েই ভারি ফুর্তিতে ছিলুম ওই দুমাস। খাবার পাতে নিয়মিত কাঁচা মাছ আর সামুদ্রিক শ্যাওলাও সামলে নিয়েছিলুম। মনের মধ্যের বাধাটা সরিয়ে দিতে পারলে দিব্যি খেতে। অফিসে পার্টি মানেই তো বিরাট টেবিলজোড়া থালা ভর্তি সুশি বাঁধা ছিল!
গোলমালটা হত একমাত্র পানীয় নিয়ে। মানে ওরা বিয়ার খায় জলের মত। আমার মত ভেতো বাঙালির দ্বারা সে জিনিস সম্ভব নয়। সুতরাং সারাক্ষণ গ্রীন টি খেয়ে কাটাতে হত, সে যে কী বাজে খেতে কী বলব। এখানে এখন যে ফ্যাশনেবল গ্রীন টি পাউচ পাওয়া যায়, সেসব সেই গ্লাস ভর্তি হলুদ তরলের সামনে অমৃত মশাই! পানীয় বলতে মনে পড়ল, শেষদিকে এক সিনিয়র ম্যানেজার তাঁর বাড়ির পার্টিতে আমায় নেমন্তন্ন করেছিলেন। সেখানে এই পানীয় বাবদ বেজায় ফ্যাসাদে পড়েছিলুম, কারণ বাড়িতে জলের বালাই ছিল না বললেই চলে। ফলে প্রথমে সবার সঙ্গে বিয়ার, তারপর খেতে বসে ওয়াইন এবং খেয়ে উঠে জীবনের প্রথম ‘শঁপ্যা’। লিখেছি এটা আগে, ‘অফিসের গল্প’ সিরিজে। আহা, সবই বড়ো ভালো খেতে, কিন্তু পরপর তিনরকম বেশ গোলমেলে ব্যাপার। তবে এমনিতেই লোকে খুব একটা ইংলিশ বোঝে না, ফেরার পথে ট্রেনে যে আমি দরাজভাবে শুদ্ধ বঙ্কিমীয় বাংলায় কথা বলছিলুম, তাতে নিশ্চয় ওদের বা আমার খুব একটা আলাদা করে অসুবিধে হয়নি।
(ক্রমশঃ)

Recent Comments

Leave a Comment