চলার পথে – ২৫ (cholar pothe – 25)
কুমাই-চারখোল-তাকদা ভ্রমণ—পর্ব-৪
২৪ মে, ২০২২, মঙ্গলবার
আজ এক লোকাল ড্রাইভার কাম গাইডকে ডাকা হয়েছে। এই রাস্তায় বিজনদা নার্ভাস বোধ করছেন, আর চেনেনও না তিনি এদিকটা তত। এ-ও কিন্তু কৌশিকেরই ব্যবস্থা, আমায় একটুও মাথা ঘামাতে হয়নি। বলেছি কি তার নেচার ক্যাম্প ও প্রতিদিন নতুন নতুন গেস্ট আসার ব্যস্ততার মাঝেও সে খেয়াল করে দুবেলা ফোন করে খোঁজ রাখছে সব ঠিক আছে কিনা? আজ ব্রেকফাস্ট করতে বসার পর কুক বিজনদার নাম্বার চেয়ে নিলেন, তিনিই তখন জানালেন এমন সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে, আমরা যাতে ভালোভাবে ঘুরে আসতে পারি সেজন্য কৌশিক আর চিরাগ দুই বন্ধু আলোচনা করে সব ঠিক করে নিয়েছে।
বলা বাহুল্য, আমায় কিছুই এক্সট্রা দিতেও হয়নি এর জন্য।
সেই লোকাল ভদ্রলোক, রূপেশ, একদম কাঁটায় কাঁটায় নটায় এসে গেলেন। আমরা দুর্দান্ত আলু পরোটা আর আচার দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে তখন রেডি হয়ে খরগোশের খাঁচার সামনে ঘুরছিলুম। ফিট চনমনে আর নম্র হাসিমুখের রূপেশভাইকে দেখেই মনে হল আজ বেড়ানোটা হেব্বি হবে।
সত্যিই, জায়গা হিসাবে এই তিনটের মধ্যে চারখোলকে আমি সেরা বলব, কিন্তু ঘোরাটা সেরা হয়েছিল এই দিনই।
প্রথম গন্তব্য রক গার্ডেন। পাহাড়ে লোকাল ড্রাইভার যে কত বড়ো অ্যাসেট তা আবার টের পেলুম, ওই একই খড়বড়ে খাড়াই রাস্তায় আজ গাড়ি চলল কত অনায়াসে। মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যে পৌঁছে গেলুম সেখানে।
রাস্তার পাশে ইয়াব্বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই। অজ্ঞাত কারণে সেগুলোর সাদা দিয়ে আউটলাইন করা। প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে সে সাদা সাদা লাইন কেমন যেন অস্বস্তিকর লাগল আমার। যেমনটি ছিল থাকলে কী ক্ষতি ছিল কে জানে! আদিম প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়াবে, এমন তুলি মানুষের কি আছে! যাইহোক, ছবি তোলা হল সেখানে।
চক দেওয়া রক
রক গার্ডেনের অভিযাত্রীরা
শীর্ষে তিতির
বাঁদিকে বিজনদা, ডানদিকে রূপেশ
তারপর রূপেশ বলল, এখানকার সবচেয়ে বড়ো পাথরটা দেখতে যাবেন?
সে আবার কই? না, নিচে, জঙ্গলের মধ্যে, চোখের আড়ালে। আমি তো এক পায়ে খাড়া, আর তিতির আমি কিছু বলার আগেই হাঁটা লাগিয়েছে। চললুম তিনজনে গুটি গুটি ধাপ বেয়ে নেমে। বাঁশঝাড় ক্যাকটাস আর অ্যালোভেরার ঝোপের মধ্যে দিয়ে নামতে নামতে নামতে নামতে গিয়ে পৌঁছলুম গাঁয়ের উঠোনে, এদিকে বারান্দায় বুড়োমানুষ বসে ঝিমোচ্ছেন, ওদিকে খোলা বাথরুম গোছের ঘরে এক মহিলা এক হাণ্ডা কাপড় কাচছেন।
পাথর কই ভাই?
ওই উঠোন পেরিয়ে, ছ-সাতটা ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়ির পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে গিয়ে, তাদের পিছন দিয়ে মোড় নিয়ে, আরো খানিক জঙ্গলের মধ্যে উঠে-নেমে এসে পৌঁছলুম সেই সবচেয়ে বড় পাথরে। দেখলে অবাক হতে হয়। বিশাল। সমীহোদ্রেককারী।
বড়ো পাথর
তারই পাশে আরেকটা বেশ বড় পাথর, কোনওকালে মাঝ থেকে আড়াআড়ি ফেটে দু টুকরো হয়ে গেছে।
দ্বিধাবিভক্ত পাথর
কালো, ইতিউতি শ্যাওলা বা ফার্ন আঁকা শরীর, চারদিকে গাছের ভিড়, এমনকী মাথার উপরেও আকাশ দেখা দায় এত ডালপালার সবুজ ছাউনি সেখানে… নিঃশব্দ চিরে একটা দূরের পাখির ডাক…
এই আমাদের দেশের আসল সৌন্দর্য। এই আদিম, অকৃত্রিম প্রকৃতি।
খুব ভালো লাগছিল ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে।
ফেরার সময়ে অন্য কোন দিক দিয়ে শর্টকাট করল রূপেশ, অত খাড়া নামতে হয়তো পারতুম না কিন্তু উঠে গেলুম দিব্যি। গাড়িতে উঠে রংলি রংলিয়ট চা বাগানের শোভা দেখতে দেখতে চললুম পরের দ্রষ্টব্য হ্যাঙ্গিং ব্রিজের দিকে। পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে চায়ের চাষ হয়ে আছে বহুদূর অবধি।
হ্যাঙ্গিং ব্রিজ
হ্যাঙ্গিং ব্রিজটায় এখন আর পারাপার হয় না, দুই মুখ বন্ধ করা জাল দিয়ে। ১৯১৮ সালে তৈরি সে সেতু ছিল পুরোই কাঠ আর দড়ির, কিন্তু এত মজবুত যে তার উপর দিয়ে পথিক তো বটেই, ঘোড়সওয়ার বা এমনকী ঘোড়ার গাড়িও যাতায়াত করত। পরে লোহার তার দিয়ে তাকে শক্তপোক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু তার পরেও অবস্থা ক্রমে খারাপ হওয়ায়, আর দুই প্রান্তের মধ্যে গাড়ি যাতায়াতের প্রয়োজন বাড়তে থাকায় তার পাশে পাঁচ-ছ বছর আগে নতুন ব্রিজ হয়েছে, যার উপর দিয়ে পার হল আমাদের গাড়ি।
নতুন ব্রিজ, গাড়ি যাওয়ার
পায়ে হেঁটে সেই ব্রিজ পেরিয়ে নেমে যাওয়া গেল পুরোনো ব্রিজের দোরগোড়ায়।
হ্যাঙ্গিং ব্রিজের দোরগোড়ায়
বন্ধ জালের সামনে দাঁড়িয়ে চেয়ে ছিলুম দীর্ঘ সেতুর দিকে, মনে মনে কল্পনা করছিলুম- ঘোড়া চলেছে দোলায়মান সেতু বেয়ে, ঘোড়ার পিঠে মাথায় পাগড়ি সওয়ার… খট খট আওয়াজ হচ্ছে কাঠের উপর ঘোড়ার খুরের… যেন বা সেটা অনুমান করেই রূপেশ মৃদুস্বরে বলল, দেখুন কত নিচে… একটাও দড়ি ছিঁড়ে কিছু উলটোপালটা হলে আর…
অনেক নিচে, এবং পাথর ছড়ানো চত্বর। পড়লে যে কী হবে বুঝতে অসুবিধে হয় না। গায়ে কাঁটা দেয় ভাবলে।
সেতু
নিচের পাথর
আবার চলা। ঘন জঙ্গল। পথের পাশে বাঁদরের দল বসে আছে। গাড়ি গিয়ে দাঁড়ায় একটা চা বাগানের ধারে।
চা বাগান
নামতেই দেখি পাতা তোলার কাজে সাময়িক বিরতি দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন একদল স্থানীয় মহিলা। ছবি তুলব বলতেই বেশ সুন্দর হাসিমুখে পোজ দিয়েছিলেন সবাই, কিন্তু সে ছবিটা আর খুঁজে পাচ্ছি না। অগত্যা এইটেই রইল।
কাজের ফাঁকে
তারপর চা বাগানে ঢুকে পড়লুম তাঁদের কথায়। বেশিদূর না অবশ্য, একটুখানি এগিয়ে যাওয়া ওই সরু সরু ফাঁক গলে। রূপেশভাই ফোন চেয়ে নিয়ে ছবি তুলে দিল কয়েকটা, এদিকে দাঁড়ান, ওখানে হাত দিন এরকম নির্দেশ-সহ।
চা-পরিবৃত
নাঃ, মজবুতই আছে! আমি টোকা মারলেও পড়ছে না।
আমিও তার একটা বেশ কায়দার পোজে ছবি তুলে নিলুম চা বাগানের সামনে।
রূপেশ
তারপর গেলুম অর্কিড গার্ডেন। এখন ঠিক ফুলের সময় নয়, তবু অল্প কিছু রঙের বাহার পাওয়া গেল।
অর্কিড গার্ডেন
অর্কিড গার্ডেন
অর্কিড গার্ডেন
অর্কিড গার্ডেন
অর্কিড গার্ডেন
ছিল কমলালেবুর গাছও।
অর্কিড গার্ডেনে কমলালেবুর গাছ
অতঃপর গুম্বাদারা। তার আগে, রাস্তায় একটা বেজায় নিরিবিলি অংশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রূপেশ বলল, নিচে চলুন, দারুণ ভিউ।
যে রাস্তা দিয়ে নামলুম
এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে
সত্যি দারুণ। সামনে খোলা উপত্যকার ওধারে সারি সারি পাহাড়, বাঁদিকে নিবিড় জঙ্গল।
সামনে পাহাড়
নিচের দৃশ্য
বাঁদিকে জঙ্গল
খুব লোভ হচ্ছিল এই রাস্তাটায় ঢুকে যেতে, কিন্তু সময় ও সম্ভাব্য লেপার্ডের কথা ভেবে নিজেকে নিরস্ত করলুম।
জঙ্গলে পায়ে চলা পথ
গুম্বাদারাও একটা ভিউ পয়েন্ট। নেপালিতে গুম্বা মানে গুহা, গুম্ফা… আর দারা মানে পাহাড়। দূরে পাহাড়ের গায়ে সে গুহা দেখাল রূপেশ। রাস্তার ধারে বসার বেঞ্চ করা আছে… আর সামনে পর পর সারি সারি চূড়া, এদিকে সিকিম, সামনে কালিম্পং, ওদিকে নামচি…
পাহাড়
আরো পাহাড়
গাড়ির জানলা দিয়ে
খুশি!
ঘুরে ফিরে দেখলুম নানান দিক থেকে। তার মধ্যে একটা উঁচু জায়গায় কিছুতেই আমি উঠব না, আর রূপেশ আমায় ওঠাবেই – তিতির তো আগেই উঠে গেছে লাফিয়ে লাফিয়ে, সেও “মাঁ! তুঁমি পাঁরবে!” করে বায়না জুড়েছে, শেষে একহাতে রূপেশের হাত ধরে অন্যহাতে পাথর-ফাথর গাছের শিকড় যা পেলুম আঁকড়ে কোনমতে টিকটিকির মতো সেই পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে উঠলুম। উঠে ঘোষণা করলুম, আমি কিছুতেই ওখান দিয়ে নামব না, নামলে কুমড়োগড়ান হওয়া অনিবার্য।
“কেয়া?”
“কুমড়ো সমঝতা? কুমড়ো? উয়ো যব গড়াতা হ্যায় না… উসকো কুমড়োগড়ান বোলতা হ্যায়।“
এই হিন্দির ধাক্কায়ই সম্ভবত রূপেশ আমাদের খানিক হাঁটিয়ে অন্য পাশ দিয়ে নামাল। সে ভারি সুন্দর ধাপে ধাপে নামার ব্যবস্থা, খালি শেষে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে একটা জাল সরিয়ে গলে বেরোতে হয়, আর ইয়ে, মাঝে একটা সমান মতো জায়গায় পা দিতে বারণ করল, ওটা নাকি শ্মশান, মৃতদেহ পোড়ায়। সে যাকগে, বেটার দ্যান কুমড়োগড়ান।
“এই তো খাসা রাস্তা ছিল, খামোকা অমন বিতিকিচ্ছিরি করে স্পাইডারম্যানগিরি করালে কেন বাপু?”
তিনি নাকি ‘অ্যাডভেঞ্চার’ করিয়েছেন ‘ম্যাডাম’কে। আমি যত চিল্লাই, সে তত হেসে কুটিপাটি হয়।
সেই পয়েন্ট থেকে নিচে রাস্তা দেখকা যাচ্ছে
তারপর রাস্তার ধারের এক ছোট্ট দোকানে বসা হল। জানলা খোলা, নিচে সেই উপত্যকা আর দূরে পাহাড়। আমাদের জন্য চা এল, রূপেশের জন্য বিয়ার।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)