চলার পথে- ২৯ (cholar pothe-29)

চলার পথে- ২৯ (cholar pothe-29)

উত্তরবঙ্গ ডিসেম্বর, ২২ (কালিম্পং-পেডং-মুন্সং-দার্জিলিং) – পর্ব ৩

 

দিন ২ (২৫ ডিসেম্বর, ২০২২) – আগের পর্বের পর থেকে

——————————————————————-

আজমল খুব পাকা হাতের ড্রাইভার। গাড়ি চালায় যেন মাখনের মধ্যে ছুরি চলছে, ঝাঁকুনি লাগে না বললেই চলে।

তবে ছেলেটি যে আরও কী, সে পরিচয় পরে পেয়েছিলুম।

আপাতত আমরা চললুম জলপ্রপাত দেখতে। কোথায় কোথায় যাব, তা আঙ্কল, মানে হোমস্টের যিনি মালিক (এবং রান্নাবান্নাও নিজের হাতে সব করেন), সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময়েই। গাড়িটা তাঁদের নিজেদের, আজমল স্থানীয় ছেলে যে এরকম ড্রাইভার কাম গাইড হিসাবে কাজ করে।

“কী জলপ্রপাত গো? নাম কী?”

ভারি সুন্দর লাজুক একটা হাসি আজমলের। হেসে বলে, “নাম ছাঙ্গে।“

সিকিমের কথা মনে পড়ে যায়, বলে উঠি, “অ্যাই, ছাঙ্গে মানেই তো ফল্‌স্‌ নেপালীতে! সব ফল্‌স্‌-ই তো ছাঙ্গে!”

আজমল হেসে স্বীকার করে, তাই বটে! পরে কৌশিকের থেকে শুনি ওটা ‘ডুকা ফল্‌স্‌’। কাছেই ডুকা  আদিবাসীদের গ্রাম আছে, ডুকা গ্রাম, সেই নামে।

সে গ্রাম যদিও আমাদের লিস্টে ছিল না, কিন্তু কপালে থাকলে আটকায় কে! আর, বলেইছি তো আজমল ছেলেটি শুধুই ড্রাইভার বা গাইডের বেশিই কিছু!

ডুকা ফলসের দিকে যাবার পথে রাস্তায় দুজন লোক দাঁড়িয়ে। সঙ্গে একদম গেঁড়ি গেঁড়ি দুটো বাচ্চা, গাড়ি দেখে ডেকে কী যেন বলল। আজমল গাড়ি থামিয়ে বলল, “দিদি, নেব?”

আমি প্রথমে বুঝিনি, ভেবেছি কিছু বিক্রি করছে ওরা। আজমল বুঝিয়ে দিল, লিফট চাইছে, অনেকটা রাস্তা যাবে এখনো। ছেলেটা খুব বাচ্চাদের ভালোবাসে, বুঝলাম মুখ দেখে।

আমরা রাজি হলুম বলা বাহুল্য। তিনজনেই সামনে উঠতে যাচ্ছিল, কিছুতেই আমাদের পাশে বসবে না লজ্জায়… বকে ঝকে অবশেষে একটা বাচ্চা পিছনে আমার পাশে এল। অন্যজন তার বাবার কোলেই বসল, আর মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। যেই ধরা পড়ে যাচ্ছিল, মানে চোখাচুখি হচ্ছিল, অমনি লজ্জায় লাল হয়ে সামনে তাকাচ্ছিল।

পাশের জন তুলনায় কম লাজুক, সে একটু বাদেই আমাদের দিকে চেয়ে একগাল হেসে হেসে কী সব বলতে লাগল। ভাষাটা বুঝি না, তাই কিছুই বুঝছিলুম না। আন্দাজ হল নিজের স্কুল নিয়ে কিছু বলছে।

“কোন ক্লাসে পড়ো বাবু?”

জানা গেল দুজনেই ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সেই অনুপাতে নিজেদের প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ-অভিজ্ঞও ভাবেন, বোঝাই যাচ্ছিল। হেঁটে হেঁটে বেদম হয়ে গেছে দুটোই, গালগুলো পুরো লাল হয়ে উঠেছে।

রাস্তা তখনো ফলসে পৌঁছয়নি। বাবা, এতদূর হেঁটে আসত? ফলস দেখতে আসছিলি নাকি রে?

না। জানা যায়, তারা মাসির বাড়ি গেছিল। নিচের গ্রামে। এখন নিজেদের বাড়ি ফিরছে। বাবা এসে নিয়ে যাচ্ছেন।

অতীব ভদ্র মৃদুভাষী লোকটি এতক্ষণে মুখ খোলেন। সেই প্রথম ডুকা গ্রামের কথা শুনি তাঁর কাছে।

ফল্‌সের সামনে এসে তাঁরা বিদায় নেন। বাকিটুকু নিজেরাই চলে যাবেন। ছবি তুলব বলতেই হই হই করে পোজ দিয়ে দেন তিনজনে। এবং বার বার অনুরোধ করে যান ওঁদের গ্রামে ঘুরতে যেতে।

দিব্যি ফল্‌স্‌। ছিমছাপ সুন্দর। খালি যদি ওই জলের পাইপটা না থাকত! বলতে গিয়ে দেখি তাই দিয়ে আজমল মনের আনন্দে গাড়ি ধুচ্ছে।

এই যে, সে গাড়ি ধুচ্ছে।

পাহাড়ে জলকষ্ট কী জিনিস, সে তো জানি। তাই শোভায় ব্যাঘাত হলেও, ও পাইপ এদের কত কাজে লাগে ভেবে আর কিছু বললাম না। নিজের এদিক ওদিক ছবি তুললাম।

আজমল নিজেই এগিয়ে এসে ফোন চেয়ে নিয়ে ছবি তুলে দিল বেশ কিছু।

রাস্তাটা বেশ লাগছিল। কিছুটা আরও এগোনোর পর মনে হল, আর কবে আসা হবে ঠিক কী! দেখেই যাই না গ্রামটা?

যেই না ভাবা! কিছুটা গাড়িতে, কিছুটা পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম সেখানে। পথে ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাচ্চা দুজন কী বেজায় খুশি হল, এমনকী তাদের বাবাও ধন্য হয়ে গেছে এমন উচ্ছ্বসিতভাবে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দেখাল সব। কী সুন্দর একটা স্কুল, খেলার মাঠ, ধারে ধারে ঘর।

সামনের পাহাড় নাকি সিকিম।

চমৎকার একটা হোমস্টেও আছে দেখি একপাশে। মালিক বাঙালী। ছবি নেব বলতে সানন্দে রাজি হলেন।

এবং তিতিরের প্রিয়… কুকুর! ইনি আবার ভারি আহ্লাদী, হাত সরালেই উঁ-উঁ করে আরো আদর করতে বলছিলেন।

সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া হল পাইনবন ও সাইলেন্ট ভ্যালি।

তবে, পাহাড়ি মানুষদের একজন গ্রুপ সেখানে ক্রিসমাস উপলক্ষে পিকনিক করছিল। ফলে সাইলেন্ট ভ্যালি-টা একেবারেই সাইলেন্ট ছিল না।

পায়ের নিচে সত্যি সত্যি গালচের মতো পুরু হয়ে জমে আছে পাইনের ঝরা পাতা। শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়ি সুরে গান, রান্নার জোগাড় হচ্ছে, বাসনপত্রের টুংটাং… দুজন মেয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে, একটা বাচ্চা এই শীতেও হাতকাটা গেঞ্জি পরে কোমরে হাত দিয়ে ডনের মতো দাঁড়িয়ে আছে, একটা ঝুপুস লোমের কুকুর খুব লাফালাফি করছে আর খালি খালি কেমন পায়ে পা জড়িয়ে উলটে যাচ্ছে… ইয়াবড় এক ডেকচি নিয়ে যেতে যেতে এক আঙ্কল একগাল হাসলেন আমাদের দেখে, চোখগুলো প্রায় নেই হয়ে গেল হাসির চোটে…

বেশ জায়গা। বেশ লোকগুলো। ডাকলেই থালা পেতে বসে পড়তুম ওদের সঙ্গে, কিন্তু রান্না হতে ঢের দেরি।

তার বদলে আমরা উঠে এসে পাশের একটা পাহাড়ে চড়লুম। সেটার নাম টাম নেই কিন্তু সেও বেশ সুন্দর, খালি একদম… একেবারে চূড়ার কাছে কিছু গরু চরছে।

তাই দেখে উৎসাহিত হয়ে আমার কন্যাও তড়বড় করে উঠে গেল।

তারপর আমার ফোন কেড়ে নিয়ে সে কী কারিকুরি! এখানে দাঁড়াও, অমন করে হেলান দাও, এইটে হাতে নাও… এসব করে এমন একটা শাহজাহান মার্কা ছবি তুলে দিল আমার।  যদিও হাতের ফুলটা লাল হওয়ায় জামার সঙ্গে মিশে গেছে, আর শাহজাহানের কোমর থেকে এরকম করে ঢিলে পাৎলুন ঝুলে পড়ত কিনা সেটা কোথাও লেখা নেই।

এইখানে বেশ খানিকক্ষণ সময় ছোটাছুটি ঘোরাঘুরি করে আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলুম। এইবার যাওয়া হল আলাগড় মার্কেট। আমার শপিং করার তত ঝোঁক নেই, তাই আর নামিনি। গাড়িতে বসে বসেই দেখলুম দোকানপাট- রংবাহারি শীতের পোশাক থেকে রংচঙে সবজিপাতি, হাসিমুখ দোকানদার, ঝিমোনো কুকুর।

পথে একটা ক্রস পড়ে।

তারপরে যাই শেষ দ্রষ্টব্য, একটা মনাস্ট্রি দেখতে।

যাবার পথে পড়ে একটা মস্ত মাঠ। সবুজ।

তা, এরকম মাঠ তো পাহাড়ি পথঘাটে কতই না! এইটের কথা আলাদা করে বলার কী আছে?

বলার এইটুকুই- এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আজমল হাত বাড়িয়ে দেখায়, “এই মাঠে আমরা প্র্যাকটিস করি।“

কী প্র্যাকটিস?

“আর্চারি।“

তারপর প্রশ্ন করে করে জানি, ছেলে আর্চারি করে শুধু না, নিয়মিত কলকাতা যায়, সাইতে প্র্যাকটিস বা কম্পিটিশন করতে। আমি নিতান্ত আনাড়ির মতো জিজ্ঞাসা করি, স্টেট লেভেল কম্পিটিশনগুলো বুঝি?

সে আরও লজ্জা পেয়ে, এবং মৃদু গর্বের সঙ্গে জানায়, না। সে একজন ন্যাশনাল লেভেলের প্লেয়ার।

এই গাড়ি চালানো, গাইডের কাজ করা তার জীবিকা মাত্র।

আজমল আসলে ন্যাশনাল লেভেলের আর্চার। দেশের সম্পদ।

কী যে বলি ভেবে পাই না। আর ছবি তুলতে কিছুতেই রাজি হয় না সে ছেলে, এমনকী মাঠের পাশে দাঁড়ায়ও না, নিজের কথা বলে ফেলে দ্বিগুণ লজ্জা পেয়ে সোজা হুশ করে চলে যায় মনাস্ট্রিতে।

ডুকা ফলসে একটা ছবি তুলেছিলাম অনেক সাধাসাধি করে, সেইটেই রইল এখানে।

মনাস্ট্রিটা বন্ধ। পুরোনো মঠ উপরে, নিচে নতুন মঠের কাজ হচ্ছে। আজমল নিজের ফোনে লাফিয়ে লাফিয়ে ফোটো তোলে, বলে আমি সব পাঠিয়ে দেব ম্যা’ম! আপনি দাঁড়ান!

তিতিরও এখানে যথারীতি এক কুতুয়া খুঁজে পেয়ে যায়।

তারপর ফেরা, পেডং বাজার হয়ে। আজমল নিজের ঘরের রাস্তা দেখায়, নিজেদের দোকান, দোকানে বসা তার ছোটোবোনকে দেখায়, ছেলেমানুষের মতো জানতে চায়, ‘আমি গাড়ি কেমন চালাই ম্যা’ম?’

অসম্ভব তৃপ্তি নিয়ে ফিরি। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ খেতে যাই।

আজ স্পেশাল লাঞ্চ। আগেই আমরা কী খাই না খাই জেনে নিয়ে মেনু করা হয়েছে আজ। পর্ক কষাটা যা খেলুম, জীবনে কোথাও, কোনও নামী রেস্টুরেন্টেও অত ভালো কখনো খাইনি। তিতির অবধি চেয়ে নিয়ে, আঙুল চেটে খেয়েছে। একটুও ঝাল মশলা কিছু না, কিন্তু কী স্বাদ! এছাড়া ডাল, পাঁপড়, পালং শাক, মিক্স ভেজ—এসব তো ছিলই।

আজ মামাজী এসে বসেন খাওয়ার সময়ে—এই হোমস্টের যিনি মালকিন, তাঁর মামা। তিনি আর আঙ্কল মিলে সব রান্নাবান্না কাজকর্ম দেখাশোনা করেন। হাসিখুশি গোপ্পে মানুষ, কলকাতা নিয়ে তাঁর যত প্রশ্ন, তত গল্প নিজেদের ক্রিসমাস পালন নিয়ে। সেইসঙ্গে এটা খাও, ওটা এভাবে খাও, আরও ভাত নাও ইত্যাদি তদারকি।

ঘরে গিয়ে ধপাস্‌ করে পড়ে সে যা ঘুম দিলুম! একেবারে ছটায় আয়ুষ চায়ের জন্য ডাকতে ঘুম ভাঙল। আজ চায়ের সঙ্গে ঘরে বানানো ডোনাট।

আজ রিল্যাক্স করা ছাড়া আর কিছু প্ল্যান ছিল না এর পর। দুজনে দুটো বই নিয়ে যে যার বিছানায় ধপাস্‌ হলুম। সান্টার বইয়ের ম্যাজিক, নাকি পেডিং-এর প্রভাব, না লাঞ্চের এফেক্ট জানি না—তিতির তেড়েফুঁড়ে একটানা পড়ে বইটা শেষই করে ফেলল। রাত্রের খাওয়াদাওয়াও একইরকম জম্পেশ – চিকেন কষা আর আলুভাজা, রুটি— সেরে তৃপ্তির ঘুমে তলিয়ে যাওয়া গেল।

(ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

Leave a Comment