আঁকিবুঁকি

আঁকিবুঁকি

অনেকেই হয়তো জানেন, আমি টুকটাক ছবি আঁকি। শখেই স্রেফ, কারণ ছবি আঁকার প্রথাগত কোনো পাঠ আমার কখনোই ছিল না সেই অর্থে। মা-মাসিমণিদের কাছে এবং স্কুলে লাইন টানা, লাইন ধরে রং করা, ব্রাশের একমুখী স্ট্রোক এসব ছোটবেলায় আর পাঁচটা বাচ্চার মতই শিখেছিলুম। হিজিবিজি আঁকা, যাকে বলে ‘ডুডলিং’, সেই অভ্যাসটা বরাবর ছিল, বিশেষ করে মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবার বা ক্লাসের পড়া শোনার সময়ে। আই. এস. আই. এর খাতাগুলো খুঁজলেই দেখা যাবে, পাতার ডানদিকটা জুড়ে বিভিন্ন কাটামুণ্ডু, চুলের ডিজাইন, জামার ভাঁজ, জানলার গ্রিল, পুকুরের ধাপি ইত্যাদি দিয়ে ভর্তি। কিন্তু তাকে তো আর আঁকা বলে না!
আঁকা বলার মত কিছু যেটুকু হয়েছে, সে শুরু করেছিলুম এই ‘ইনফাইনাইট পেইন্টার’ অ্যাপটা হাতে পাওয়ার পর। এর আগে একাধিক অন্য পেইন্টিং অ্যাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছিলুম, কিন্তু কোনোটাতেই সেভাবে আকর্ষণ গড়ে ওঠেনি। এইটে, কোনোভাবে, যাকে বলে “ক্লিক” ক  রে গেল। সেই সময়টাও টলোমলো ছিল, ঝাপটা সামলে জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি সবে, রং নিয়ে খেলতে মজা পেয়ে গেলুম।
গতকাল, ফেসবুক জানাল, আনাড়ির সেই রংতুলিচর্চার তিন বছর পূর্ণ হয়েছে।
তিন বছর! সময় যে কোথা দিয়ে চলে যায়! তিন বছর আগে প্রথম যে ছবিটা এঁকেছিলুম, সেটা দেখলে এখন হাসি পায়, কিন্তু একইসঙ্গে বড় মায়া হয়। ‘আঁকিবুঁকি’ অ্যালবামের সেই সূত্রপাত। এখন তাতে ৩০০র বেশি ছবি জমা পড়েছে টুক টুক করে এই দু বছরে। আঁকতে আঁকতেই শিখেছি, ভুল শুধরোতে চেষ্টা করে একই ছবি বার বার করে এঁকেছি, নতুন কম্পোজিশন খুঁজেছি, মুড অনুযায়ী ছবির মধ্যে গল্প উঠে এসেছে নানারকম। দুর্গাপুজোর সিরিজ, ঘরবসত সিরিজ এবং অবশ্যই শিবতাণ্ডব সিরিজ, তারপর হালফিলের  হরিণ, মায়াশহর, নিজের সাইট করার পর সেতু সিরিজ – কত মানসিক চাপ, সুখদুঃখ, যন্ত্রণা, আনন্দ, কান্না-হাসি, প্রেম-বিরহ ধরা আছে ছবিগুলোতে সে আর এখন আলাদা করে বলতেও পারব না, কিন্তু এইটুকু জানি আঙুলের টানে রং দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে ছবি ফুটিয়ে তোলার আনন্দটা  – এইটা আজ আমার এক মস্ত আশ্রয়।
এই পুরো যাত্রায়, অসংখ্য মানুষ আমার পাশে থেকেছেন। নিয়মিত তাঁদের উৎসাহ দেওয়া, ভালো লাগা, প্রয়োজনে ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে দেওয়া, পরামর্শ – প্রত্যেকটি আমায় সাহস দিয়েছে পরদিন আবার একটা ‘অন্যরকম’ কিছু আঁকার। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে খুব ইচ্ছে করছে আজ, শুরুর দিকে আলাদা করে ইনবক্সে আমায় নিঃস্বার্থ ভাবে ছবির বেসিক ব্যকরণ শিখিয়েছেন অদিতি, কত ছবি বার বার একটু করে পালটেছি আর জ্বালিয়েছি সেমিমাকে –“বল্ না এটা এমন রাখব, না অমন করব” (এ অবশ্য এখনো করি নিত্য নিত্য), আমার স্কুলের বন্ধুরা অকুণ্ঠ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে গেছে প্রতি পদে, আশীর্বাদ জানিয়ে ভরসা দিয়ে গেছেন মানস জ্যেঠু; উদয়দা, রাজর্ষি, মোহর, চয়ন, রাজাদা, সৈকতদা এইসব সিরিজের কোনও কোনও ছবিকে সম্মানিত করেছেন তাদের লেখা দিয়ে (আরেকজনের লেখা এখনও ডিউ আছে 😊)। আমায় তুমুল গর্বিত করে রাজাদা তাঁর কবিতার বইয়ের কভার করিয়েছেন আমার ছবি দিয়ে, বিভিন্ন সময়ে অগ্রজ সাহিত্যকরা নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছেন আন্তরিক ভালোবেসে – ত্রিদিবদা, চুমকিদি, সৈকতদা, হিমাদ্রিদা, অমিতাভদা, বিপুলদা – এর বেশি আর কী-ই বা চাইতে পারি!
(কাউকে ভুলে গেলে সে আমার জেলিফিশ মেমরির দোষ, এই জেনে ক্ষমা করবেন।)
আর একজনের কথা না বললে এ লেখার মানেই হয় না। এই সময়ের অগ্রগণ্য, স্বনামধন্য সেই শিল্পীকে আমি মনে মনে আমার আঁকার গুরু বলে মানি। যে লাগাতার ভরসা ও খুঁটিনাটির পাঠ ওঙ্কারদার কাছে পেয়ে এসেছি, এখনও পাই – তা ভাষায় ধরা সম্ভব নয়। নিজের দাদাকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু দেওয়া যায় না, সে চেষ্টাও করছি না। (আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি ছবি আঁকতে শুরু করার আগে অবধি উনি আমায় চিনতেনও না, তাতে নিজের দাদা হয়ে উঠতে আটকায়নি!)
আজ তিনটে ছবি পরপর দিচ্ছি।
এই হল সেই প্রথম, না ভেবেচিন্তে, অত্যন্ত কাঁচা হাতের, নতুন খেলা পেয়ে শিশুর উল্লাসের মত সরল ভালোলাগায় জড়ানো ছবি, তিন বছর আগে যা এঁকে ফেলে মনে হয়েছিল, “বেশ তো মজার!”।
এটা সেরকমই এক কম্পোজিশন, ঝড়ের আকাশ, একলা গাছ – এটা এক বছর আগে আঁকা।
আর এইটি আজ, এইমাত্র আঁকলুম। একলা গাছ, ঝড়ের বদলে দিনান্তের শান্তি নেমেছে। থাক, স্মৃতি হয়ে।
খুব সামান্য হলেও, কিছুদূর এগোতে পেরেছি হয়তো এই তিন বছরে। আশা করি আবার পরের বছর যদি এরকমই কিছু আঁকি, তবে তাতে ছাপ থাকবে আরেকটু পূর্ণতার, আরেকটু নিপুণতার, আরেকটু নিজস্বতার। আপনারা যাঁরা পাশে ছিলেন, আছেন – আগামীতেও এইভাবেই থাকবেন, এটুকুই চাই।

Leave a Comment