কলমে – Rajarshee Gupta
রাজকুমার বলে গিয়েছিল, “আসব।”
সে জিজ্ঞাসা করেছিল, “কবে?”
— “যেদিন শ্রাবণসন্ধ্যায় তোমার উঠোনের জুঁইলতায় প্রথম ফুলের সুবাস ছুটবে। সেদিন আসব, তোমাকেও নিয়ে যাব।”
— “ঠিক?”
— “ঠিক।”
— “কিন্তু তুমি আসবে কী করে পথ চিনে? তুমি তো এ গাঁয়ে আসোনি কখনও এর আগে। আজ পথ ভুলে এসে পড়েছ।”
— “ঠিক আসতে পারব। তোমার উঠোনের জুঁইফুল আমাকে পথ চিনিয়ে আনবে।”
— “সে গন্ধ যে বড় চঞ্চলা, বড় খেয়ালী। প্রৌঢ় কদম্বপরিমলের মতো তার দৃঢ় মন নেই যে। সে কি পারবে?”
রাজকুমার অনেকক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলেছিল, “তবে তুমিই পথ দেখাবার ভার নাও।”
তার শান্ত চোখে ঔৎসুক্য জেগেছিল। জেগেছিল আশঙ্কাও। সে বলেছিল, “ভার? আমি যে কোনও কাজের ভার নিইনি কোনওদিন। আমি তো ছোট, কেউ তাই আমাকে কিছুর ভার দেয় না।”
— “বড় হওয়ার সময় এসেছে। আমার প্রতীক্ষায় বড় হও। আমায় পথ দেখানোর মধ্যে দিয়ে বড় হও। সন্ধ্যায় যখন আকাশ থই হারিয়ে ফেলে, সূর্য যায় ডুবে আর চাঁদের ঘুম যখন ভাঙে না, তখন আকাশকে পথ দেখিয়ে একটি তারা বলে, ‘ভয় নেই, এই তো আমি আছি। পথ আছে। আমার আলোয় দেখে নাও।’ তুমি আমার সেই তারাটি হও। রোজ সন্ধ্যায় তুমি একটি প্রদীপ জ্বেলে দুয়ারে দাঁড়িও। তারই আলো জুঁইয়ের গন্ধকে করে তুলবে গাঢ়।”
— “কেমন সুন্দর তুমি বলো রাজকুমার। বেশ, তাই হবে। জুঁইসুবাসের আছে গতি, আর প্রদীপশিখার আছে অন্তর্দৃষ্টি। দুইয়ে মিলে তোমার পথচলা সহজ করুক, আর তোমাকে দ্রুত এনে দিক আমার দুয়ারে। আমি অপেক্ষায় থাকব।”
রাজকুমার চলে গিয়েছিল। না, ঘোড়া ছিল না তার। পরনে ছিল না সোনার সুতোয় বোনা আংরাখা, কোমরে ছিল না বাঁকা তলোয়ার। তার মাথায় ছিল অরণ্যের মহাবটের মতো গম্ভীর জটা আর মুখে ছিল চাঁদের কণার মতো হাসি। লাঠি হাতে তুলে, ঝোলা কাঁধে নিয়ে রাজকুমার চলে গেল।
সেই থেকে সে রোজ সন্ধ্যায় দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে রাজকুমারের প্রতীক্ষায়। প্রতি বর্ষায় তার উঠোনের জুঁইলতায় ফুল ধরে। তার হাতের প্রদীপে তেল ফুরায়, জুঁইফুল শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে। কিন্তু তার প্রতীক্ষার অন্ত নেই। তার চুলের অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করেছে।
তাকে শুধালাম, “কীসের আশায় আজও এমন জুঁইগন্ধী প্রদীপ নিয়ে দুয়ারে দাঁড়াও? কীসের প্রতীক্ষায়?”
সে বলল, “প্রতীক্ষা কেন হবে? প্রতীক্ষা আমার ফুরিয়েছে। আমার ঘরছাড়া রাজকুমারকে ঘরে থেকে পথ দেখানোর আর লোক নেই যে। তাঁর পথ তিনি খুঁজে নিয়েছেন, ঘরও তিনি চেনেন। আমার দুয়ার ছাড়া সে ঘরে আর প্রবেশ করা যায় না নাকি? আমি জুঁইগন্ধী প্রদীপশিখায় তাঁকে সেই দুয়ারের পথ দেখাই।”


















































































































































































































































Leave a Comment