আয়না

গলির গলি তস্য গলি।
না, ঠিক পুরোনো কলকাতা বলা চলে না। সে তো ছিল চিনুদের আগের বাড়ি, শ্যামবাজারের কাছে। সে কলকাতার চৌহদ্দির সীমানা এদিকে ছিল  বাগবাজার। টালার ট্যাঙ্ক পেরোলেই কলকাতার বাইরে। সিঁথি থেকে দমদম অবধি বিস্তীর্ণ অঞ্চল গড়ে উঠেছে আরো পরে, যখন কলকাতা আড়মোড়া ভেঙে তার হাত পা ছড়াতে শুরু করল। এসব তখন মশায় ভরা দুর্গম স্থান বনেদী কল্কাত্তাইয়াদের কাছে। যত না একতলা দোতলা বাড়ি, তার চেয়ে বেশি পড়ে থাকা ফাঁকা জমি। সেখানে বিকেলে পাড়ার ছেলেরা বল পেটায়, মেয়েরা রুমালচোর খেলে, মাসিমা কাকিমা বৌদির দল গা ধুয়ে চুল বেঁধে এসে গোল হয়ে বসে গুলতানি করে।
সেরকম সময়ে, এক বন্ধুর সাহায্যে খোঁজ পেয়ে, চিনুর দাদু এই বেণী কলোনির গলির ভেতরে খুপরি জমিটা অবিশ্বাস্য শস্তা দামে কিনে ফেলল। কাকা বউ আনার পর থেকে বস্তির দু কামরা ঘরে দাদু ঠাকমা বাবা মা চিনু এতজনের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না সেও একটা কথা। রোজ রোজ খাটিয়া পেতে বস্তির গলিতে গিয়ে শোয়া বাবার পক্ষে খুব সুখের ছিল না নিশ্চয়।
তাছাড়া, বয়েস বাড়ছিল। ঘরামীর কাজ আর পেরে উঠছিল না দাদু। এদিকে বস্তির ভাড়া বাড়ে বছর বছর। বাজারে জিনিসের দাম বাড়তেই থাকে। সেই সঙ্গে উত্তরোত্তর বাড়ছিল কাকীর চোপা। শেষে যেদিন ঝগড়ার জেরে মা ঠাকমা সারাদিন না খেয়ে রইল, চিনু মুড়ি খেল ভাতের বদলে, সেদিন রাত্রে বাবা মোড়ের দোকান থেকে রুটি ডিম তড়কা নিয়ে এল সবার জন্য, আর খেয়েদেয়ে শুতে চলে যাবার আগে দাদু এ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাবাকে বলল, দুটো মাস যেমন করে পারিস চালিয়ে নে চিত্ত, আমি তার মধ্যেই বাড়িটা দাঁড় করিয়ে দেব।
মা ধোয়া বাসন তুলছিল। ঠাকমা বিছানা পাতছিল তাদের। চিনু এককোণে উবু হয়ে বসে মেঝেতে পিঁপড়ের লাইন দেখছিল। সেই প্রথম ডিম তড়কা খেল সে, রগরগে ঝাল কষা গন্ধটা তখনো ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
দাদুর কথায়, সেটা ঝিমিয়ে পড়ে হঠাৎ কচুরিপানা ঝাঁঝি ভরা পুকুরের ঝিম গন্ধ ভেসে এল।
তারপর দু না আড়াই মাস দাদু কাজে না গিয়ে সিঁথি এল রোজ। এক এক দিন চিনু বায়না করত সঙ্গে যাবে, দেখবে কেমন করে বাড়ি তৈরি হয়। দাদু পাত্তা দিত না, ও ছোট বাচ্চার জায়গা নয়। জেদ করলে নিত হয়তো, কিন্তু চিনু জেদ করতে ভয় পেত। মেজাজ টং হয়ে থাকত বুড়োর, কথাগুলো তিরিক্ষি।
তারপর একদিন দাদু সবাইকে নিয়ে এল দেখাতে। এক কাঠা মত জমি। তাতে ইঁট গেঁথে, টালির ছাত করে, পাশাপাশি দুটো ঘর, পিছনদিকে রান্নাঘর, একটেরে কলতলা পায়খানা। খানিক জমি টুকটাক পড়ে আছে, গাছ লাগানো যাবে। পাঁচিল দেওয়ার মত যথেষ্ট ইঁট ছিল না, তাই স্রেফ দু থাক ইঁট দিয়ে সীমানা নির্দেশ। দু কোণায় দুটো গাছ, শিউলি আর পেয়ারার। কে কবে লাগিয়েছিল কে জানে। দাদু কাটায়নি, আছে থাক। গাছ দুটো দেখে দাদুর তিরিক্ষি মেজাজের জন্য রাগটা কমে গেছিল চিনুর।
তার দু না তিনদিন পরেই, পাঁজি দেখে, কলকাতার পাট উঠিয়ে ওরা চলে এল এখানে। পাছে যাবার সময়ে দেখাসাক্ষাৎ করতে হয়, কাকারা তাই আগের দিনই চলে গেছিল কাকার শ্বশুরবাড়ি। বরং সামনের ঘরের মোতির মা দিদিমা কান্নাকাটি করেছিল ঠাকমার হাত ধরে, এদ্দিনের পাশাপাশি বাস তো!
এখানে এসে ঠাকমা খুব খুশি হয়েছিল মনে হয়। এটা গোছাচ্ছে, ওটা বানাচ্ছে, লঙ্কার চারা পুঁতছে। মাও এসে এক সপ্তাহের মধ্যে দুবাড়ি কাজ ধরে ফেলল, দুমাস ঘুরতেই সেটা বেড়ে পাঁচ বাড়ি হল। খালি বাবারই প্রথম প্রথম এত দূর থেকে কাজে যেতে অসুবিধে হচ্ছিল খুব। তারপর কাদের যেন ধরেকরে একটা দোকান খোলা গেল শীতলাতলা থেকে খানিক এগিয়ে, বড় রাস্তার কাছাকাছি। পান বিড়ি সিগারেট ডিম পাউরুটি বিস্কুট চানাচুর। বলতে নেই, শুরু থেকেই দাঁড়িয়েও গেল। সময়মতো খুলেছিল বলে বোধহয়, তখন সবে ওইদিকে পর পর বাড়ি উঠছে।
এই গুছিয়ে বসতে বসতে মাস ছয় কাটল। এখন সপ্তাহে দুতিন দিন মাছটা ডিমটা, দোকানের উদ্বৃত্ত পাউরুটি এক আধবার, অবরে সবরে গরম জিলিপির চল হয়েছে। কারেন্ট নেই বাড়িতে, কিন্তু জলের লাইন লেগে গেছে, আর পাশের টিউবওয়েল থেকে জল টানতে হয় না। চিনুর আট বছর পূর্ণ হয়ে গেল, মা মুখার্জি ডাক্তারের বাড়ি থেকে চেয়ে ভাল গোবিন্দভোগ চাল এনে পায়েস করে দিল চিনুকে। ঠাকমা দুবার চেয়ে খেল।
পরদিন ঠাকমা হুট করে মরে গেল।
কি কিছুই বোঝা গেল না। ডাক্তারবাবু এসেছিলেন, সাট্টিফিকেট দিলেন হার্ট অ্যাটাক। ভাল থাকলে কারো হার্ট অ্যাটাক হয়? কে জানে! ওসব তো বড়লোকদের রোগ। নাকি ওরা একটু বড়লোক হয়ে গেল বলে এমন হল, ওই বস্তির ঘরে ঝগড়া করে, বালতি বালতি জল টেনে, পাউরুটির বদলে পান্তা খেয়ে থেকে গেলে বুড়ি হয়তো এসব ব্যামোর খপ্পরে পড়ত না!
দাদু ভীষণ পালটে গেল তারপর। বাড়িতে প্রায় থাকেই না, সারাক্ষণ দোকানের সামনে নড়বড়ে বেঞ্চে। কথা বলার কেউ জুটে গেলে পুরোনো দিনের গল্প করে, নইলে রাস্তার লোক কুকুর রিকশা দেখে। মা কাজে বেরিয়ে গেলে চিনুকে দেখার কেউ নেই আর বাড়িতে, তাই সেও দাদুর সঙ্গে এসে বেঞ্চে বসে থাকা ধরল। একা ঘরে প্রাণ হাঁপাত।
তখন বাবার টনক নড়ল চিনু বড় হচ্ছে, স্কুলে দেওয়া দরকার। ডিম নিতে এসে সাহাদা আর সিগারেট কিনতে এসে দত্তবাবুও খুব বকাবকি করলেন এই নিয়ে। চিনু সিঁথি শ্যামসুন্দর বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল।
ছাই নীল জামা আর নেভি ব্লু প্যান্ট পরা ওর মত এক দঙ্গল ছেলে। ওর মত বলাটা ভুল হল। চিনুর ক্লাসের বাকি ছেলেরা কেউই ওর মত শান্ত, ভীরু নয়। এরা একেবারে ডাকাবুকো গুণ্ডা, সারাদিন হইহুল্লোড় গালিগালাজ। কথা কাটাকাটি বাড়লেই হাত চালানো। এই পরিবেশে চিনু যে কি করে চার বছর কাটিয়ে দিল নির্বিঘ্নে কে জানে, হয়তো অতিরিক্ত শান্ত বলেই ওর দিকে কারো চোখ পড়েনি।
তদ্দিনে বাড়ির জমিতে বেশ লঙ্কা লেবু ফলছে। পেয়ারা গাছটায় মরুক্কে কষাটে পেয়ারা হয় বটে, কিন্তু শিউলিটা ঝেঁপে ফুল দেয়। সাদা হয়ে থাকা মাটির দিকে চেয়ে থেকে দাদু বিড়বিড় করে, “অ চিনু, তোর ঠাকমা শিউলি ভালবাসত খুব, বুজলি! বলত কাশফুল না, শিউলি ফুলে পুজো আসে কলকেতায়।” কারেন্ট এসেছে পাড়ায়, চিনু মিটমিটে লন্ঠনের বদলে মিটমিটে ডুমের আলোয় পড়াশুনো করে। বাবা দাদু কেউই অঙ্কগুলো বোঝাতে পারে না। মা সন্ধের রান্নার কাজটা ছেড়ে দিয়েছে, ঘরের রান্নাবান্না থাকে তো। বাবার দোকানে ছোট্ট ট্রানজিস্টর এসেছে, ম্যাচের কমেন্ট্রি হয়, কোন এক গাঁয়ের বধূর গান হয়।
আর চিনুর ক্লাস ফাইভ হয়।
ক্লাস ফাইভ মানে বাবলা। নিতাই। গত দুবছর ধরে এই দুই মক্কেল এখানেই আটকে আছে। অশোক স্যারের অঙ্কের বেড়া টপকে সিক্সে যাওয়াটা আর হচ্ছে না। সেই ক্ষোভ পুরোদমে উপচে পড়ে তাদের সারাদিনের সন্ত্রাসে।
প্রথম দিন থেকেই চিনু তাদের টার্গেট হয়ে গেল। দোষটা ওরই। প্রাক্তনী হবার সুবাদে এরা যখন নতুনদের জ্ঞান দিচ্ছে কোন স্যার কত হারামী আর কি করে তাদের বাঁশ দিতে হয়, নিজের অজান্তেই চিনু লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নামিয়ে ফেলেছিল। বাকিরা হাসছিল, এদের বুদ্ধির তারিফ করছিল। চিনু, খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বতন্ত্র হয়ে চোখে পড়ে নিতাইয়ের।
যে শব্দগুলো ওর উদ্দেশ্যে ধেয়ে এসেছিল, এবং তারপর থেকে প্রতিদিন আসে, তার সামনে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে চিনু। অন্তরাত্মা শুকিয়ে আসে, এমনকি খুব নিরীহ জবাবও ঢোঁক গিলে গিলে বলার সাহস আর পায় না। যদি মারে ওরা? চিনু মার খেতে ভয় পায়।
ক্লাসের ছেলেদের গলা পালটাচ্ছিল। বাবলার ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা ঘন হচ্ছিল। খালি চিনুর রিনরিনে গলাটা বদলায় আর না। সবাই হাসে, ওকে চিন্ময় না বলে চিন্ময়ী বলে ডাকে, এমনকি ভূগোলের দিলীপ স্যারও একদিন থর মরুভূমি পড়াতে পড়াতে মুচকি হেসে ফেলেন সে ডাক শুনে। তাই দেখে সাহস পেয়েই হয়তো, স্যার বেরিয়ে যাওয়া মাত্র “দেখি তো এটা সত্যি কি” বলে অতর্কিতে ওর প্যান্টের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করে বাবলা। কোনরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে পালায় চিনু, পিছন পিছন ভেসে আসে সবার হো হো হাসি আর নিতাইয়ের সিটি।
রাতে জ্বর আসে চিনুর। বইপত্র ছড়িয়ে বসে দেখে বাইরে ঝিমঝিম করছে অন্ধকার। এলোমেলো জোনাকি উড়ছে। রান্নাঘরের খুন্তির  আওয়াজ। মায়ের চুড়ির রিনঠিন। বাবার ট্রানজিস্টরে আজ মান্না দে। রাস্তা দিয়ে যাওয়া সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, রিকশার ভ্যাঁপ্পো ভ্যাঁপ্পো। দাদুর কাশি।
ভাল করে শুনতে পায় না চিনু। খালি খালি তীক্ষ্ণ তীব্র সিটি বাজে কানে। গায়ের চামড়ায় মরুভূমির বালি কিরকির করে। রাত্রে বোধহয় হিসি করতে উঠতে ভুলে যায়, সকালে দেখে প্যান্ট চটচটে ভিজে। লুকিয়ে লুকিয়ে ধুয়ে শুকোতে দিয়ে দেয়।
দিয়ে এসে আবার শুয়ে পড়ে। মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মা কপালে হাত দিয়ে বলে, “বেশ তো জ্বর, আজ যাসনে। ভাতও খাবিনি, সাবু করে রেখে যাব ‘খন।”
বাবা দোকান যায়। মা কাজে বেরোনোর আগে আবার মাথায় হাত দিয়ে দেখে, জ্বর কম দেখে একটু নিশ্চিন্ত হয়। দাদু উসখুস করে করে বলে, “তুই চুপ করে শুয়ে থাক, আমি নয় এট্টু দোকানটা ঘুরে আসি। একা কি পারে চিত্ত! এসময়টা ভীড়ের সময়।”
বেরোতে বেরোতে আবার প্রবোধ দেয়, “এই যাব আর আসব রে। তুই যাসনি যেন কোথাও!”
যায়না কোথাও চিনু তবে একা একা ঘরের মধ্যে শুয়ে থাকতেও পারে না। বাড়ির চারদিকেই পায়ে পায়ে অলস ঘোরে। বটের চারা গজিয়েছে একটা পিছনের কোণায়, দাদুকে বলে দিতে হবে যেন তুলে দেয়। লালু কুকুরটা হ্যা হ্যা করতে করতে কোত্থেকে এল একবার কিন্তু কাছে এল না, শিউলি গাছটা অবধি এসেই কেমন ছটফট করে পালিয়ে গেল আবার। ব্যাটা এলে ভাল হত, কিছুটা সময় কাটত চিনুর। মন ঘোরাতে ছোট্ট পাঁচিলটার ওপর দিয়ে ব্যালান্স করে বাড়িটা চক্কর কাটবে ঠিক করল চিনু। সেই সেবার সিঁথির মোড়ের সার্কাসে যেমন দেখেছিল, ব্যালান্সের খেলা। ধরা যাক ও দুহাতে নিতাই আর বাবলাকে ব্যালান্স করে হাঁটছে।
টলমল করে হাঁটতে হাঁটতে শিউলি গাছটার কোণায় এসে দাঁড়াতেই চোখ ঝলসে গেল।
 
এই ফোকরটা, এত ওপরে বলেই হয়তো চোখে পড়েনি এদ্দিন। আজ পাঁচিলে দাঁড়িয়ে ওর ঠিক সামনে গর্তটা পষ্ট দেখতে পায় চিনু। আলো ঝলকাচ্ছে সেখান থেকেই। ঠাকমার সাপ বিছে সংক্রান্ত সব সাবধানবাণী উপেক্ষা করে হাত ঢুকিয়ে দেয় ও।
একটা আয়না। পুরোনো, ধুলো পড়া, কাঠের ফ্রেমের লম্বাটে গোল আদ্যিকালের আয়না একটা। ফ্রেমে লতাপাতা ডিজাইন। চিড় খেয়েছে এক জায়গায়।
কে রেখেছিল অমন আজব জায়গায়?
যেই রাখুক, দেখতে খাসা কিন্তু। জামায় ধুলো মুছতে মুছতে ঘরে ঢোকে চিনু। এদিক ওদিক তাকিয়ে এটা টাঙানোর মত কিছু হুক খোঁজে।
খটাখট খটাখট খটাখট…
কড়া নাড়ছে কে এই অসময়ে? পরক্ষণেই আঁতকে উঠে চিনু বোঝে আওয়াজটা ওর হাতে ধরা আয়নাটা থেকেই আসছে। এ আবার কী! তুলে দেখতে গিয়ে আরেকটু হলেই হাত থেকে ফেলে দিচ্ছিল, জোর সামলাল কিন্তু সে ধাক্কায় নিজেই ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল।
 
আয়নার ভেতরে একটা জংলী পথ। নাম না জানা ঝুঁঝকো গাছ দুপাশে। সেই পথ দিয়ে একটা ছেলে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। বা বলা ভালো, আসছিল, এখন সামনে এসে পড়েছে, ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে ঘোড়াটাকে বাঁধছে একটা গাছে। এটা কি তবে আয়না নয়, ছোট টিভির মত কিছু? সিনেমা হচ্ছে? ছেলেটার পরণে পাজামা পাঞ্জাবি। মাথায় পাগড়ি। ইশ, কেমন জবরজং কস্টিউম। নির্ঘাৎ পুরনো সিনেমা কোন।
ছোকরা ঘোড়া বাঁধা শেষ করে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর চিনুর পিলে চমকে দিয়ে বলে “দিচ্ছিলে তো ভেঙে আরেকটু হলে? কি সর্বনাশটাই হত তাহলে? অমন অনড্বানের মত ধাক্কা মারছিলে কেন মায়াদর্পণে?”
চিনুর হাত পা লতানো পাইপ, মাথার চুল পেরেকের মত খাড়া, গলা শুকিয়ে গোবি মাঞ্চুরিয়ান – আরে ধুর গোবি মরুভূমি, চিনুর বুকের মাঝে হাতুড়ি শাবলের দমাস দমাস। জিভ দিয়ে চারবার ঠোঁট চেটে, খুঁ খুঁ করে গলা সাফ করে চিনু ফ্যাসফেসে গলায় বলে, “তুমি কে? মায়াদর্পণ আবার কী?”
পাগড়িসুদ্ধু টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলে, “আমার নাম কুমার অরিন্দম প্রতাপ নারায়ন চৌধুরী। আর মায়াদর্পণ জানো না? যার মধ্যে তুমি বন্দী হয়ে আছ।”
মাথা ফাথা গুলিয়ে একশা হয় চিনুর। সে বন্দী হয়ে আছে? নাকি এই কুমার কি যেন কি নারায়ণ চৌধুরী বন্দী হয়ে আছে তার হাতের আয়নাটায়?  কি বলবে বুঝতে না পেরে বেকুবের মত প্রশ্ন করে, “তুমি এলে কি করে?”
“না এসে উপায়? এই মায়াদর্পণের ভার বংশানুক্রমে আমাদের যে! ওতে কেউ হাত বোলালেই আমার প্রাসাদে শ্বেত ঘন্টা বাজে, আমি বুঝি কোন বিপন্ন মায়াদর্পণের মধ্যে আমার সাহায্য চাইছে। তা বলো তোমার কি বিপদ?”
বিপদ! কই না তো!
তাই বলে চিনু ছেলেটাকে। যতই অরিন্দম নারায়ন প্রতাপ না প্রতাপ নারায়ণ চৌধুরীর মত গালভরা নাম বলুক, চিনু এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে ছেলেটা ওরই বয়েসী। কিন্তু তার জবাব শুনে ভারী বিরক্ত হয় সে ছেলে, “এ হতেই পারে না। মায়াদর্পণ তোমায় দেখাচ্ছে মানে তুমি ভীষণ কোনো বিপদে আছ, সাহায্য দরকার। শুধু তোমার নিজের না, বাড়ির কারো বিপদও হতে পারে। ভাল করে ভাবো।”
চিনু চিন্তা করে। বাবা আজকাল মাঝে মাঝে নেশা করছে। দাদুর কাশিটা বাড়ছে। পেয়ারাগুলো খাওয়া যায় না। অঙ্কগুলো ক্রমশ আরো শক্ত হচ্ছে। এগুলোকে কি বিপদ বলা যায়?
 
সে ছেলে ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে তার দিকে। হাত দুটো কোমরে। অসহিষ্ণুভাবে একটা পা ঠুকছে মাটিতে। আচ্ছা, রাজপুত্তুরদের এত রোগা পাতলা চেহারা হয়? যদিও মুখখানা ভারি মিষ্টি, এত সুন্দর তরতরে নাক মুখ চোখ জন্মে কোন ছেলের দেখেনি চিনু। বাবলারা কী বলত একে দেখলে!
বাবলা।
এমন জলজ্যান্ত বিপদের কথা তার মাথা থেকে উড়েই গেছিল? কিন্তু…এ জিনিস কি কাউকে বলা যায়? হাসে যদি শুনে?
আয়নার মাঝে রাজপুত্তুর বিবেকানন্দ স্টাইলে বুকে হাত বেঁধে তাকিয়ে আছে। ও, আয়না তো না, মায়াদর্পণ! এই একরত্তি সিনেমার হিরো নাকি তাকে উদ্ধার করবে। হাসি পায় ভাবলে।
দোনোমনা করতে করতে চিনু বলেই ফেলে, “বিপদ আছে বটে একটা।”
চোখ ঝলসে ওঠে রাজপুত্রের। সে চোখের দিকে চেয়ে চিনু মেনে নিতে বাধ্য হয়, সত্যি কোন রাজপুত্রই বটে। শত্রু দমন করতে, অন্যকে হুকুম করতেই যার জন্ম।
———–
রাতে ঘুম আসতে চায় না। এপাশ ওপাশ করে চিনু। আয়নাটা তার পড়ার বইয়ের বাক্সে তুলে রাখা। খালি ইচ্ছে করে চুপিচুপি বার করে দেখে। কিন্তু কুমার প্রতাপ, মানে ওই দেড়গজী নাম ধরে তো ডাকা যায় না তাই রাজপুত্তুর এই বলেই ডাকতে বলেছে, মানা করে গেছে কেউ যেন মায়াদর্পণের কথা জানতে না পারে। দাদুর ঘুম পাতলা, ও উঠলেই টের পেয়ে যাবে।
কিছুটা এলোমেলো ভাবে,  কিছুটা রেখে ঢেকে কথাগুলো বলেছিল চিনু। ওর আশঙ্কা ব্যর্থ করে দিয়ে কুমার প্রতাপ একটুও হাসেনি। গম্ভীর মুখে শুনেছে, ইতস্তত করলে জোর করেনি। তবে বাবলার কাণ্ডটার কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে গেছিল, ফস করে কোমর থেকে তলোয়ার বার করে এক পাক ঘুরিয়ে নিল শূন্যে, যেন সামনে পেলে কচুকাটা করে দিত। তারপর কাল স্কুলে গিয়ে কি হয় দেখে এসে ওকে জানাতে বলে চলে গেছিল ঘোড়া ছুটিয়ে।
কিন্তু পরদিনও জ্বর থাকে। মাও সেদিন কাজ কামাই করে ঘরে থাকে, ফলে মায়াদর্পণ হাতে নেওয়া আর হয় না চিনুর। স্কুল যায় তার পরদিন।
হয়তো ও দুদিন কামাই করেছে বলে, হয়তো ওর ঝামরে পড়া মুখচোখে জ্বরের ছাপ স্পষ্ট ছিল বলে বাবলার দল সেদিন ওকে দয়া করে কোন উত্যক্ত করে না। কিন্তু ছুটির পর বেরোনোর সময় গেটের কাছে বাবলা হঠাৎ পাশে এসে ওর ওখানে হাত ঘষে দিয়ে চলে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে চোখের জল সামলায় চিনু। মনে হয় এখন যদি কুমার প্রতাপ তার তরোয়ালটা নিয়ে আসতে পারত!
বাড়ি ফিরেই আয়না বার করে কলতলার পিছনের কোণায় চলে যায় চিনু।
————-
কুমার প্রতাপ আজ ওকে অনেক প্রশ্ন করল। ওর নিজের কথা, বাড়ির কথা, পুরোনো পাড়ার কথা। সেসব জেনে যে কি ভুষ্টিনাশ হবে রাজপুত্তুরের কে জানে! তবে সেসব যদি বা খানিক বলতে পারল চিনু, বাবলা বা নিতাই সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারল না, খালি ‘মনে হয় ওই সচ্চাষীপাড়ার দিকে থাকে’টুকু ছাড়া।
আর কুমার কী বাঁশ দিল ওকে! বলে কিনা কাল গিয়ে ওদের বাড়ির সব খবর নিয়ে আসতে হবে। নইলে নাকি হবে না।
যত্তসব!
—————-
পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখে বাবলা নিতাই কেউ আসেনি। এটা সুযোগ বলেই মনে হয় চিনুর। সেকেন্ড পিরিয়ডের পর সামনের বেঞ্চে বসা জয়কে দুম করে জিগ্যেস করেই ফেলে এরা আসেনি কেন।
জয়টা এমনিতে বাবলাদের পিছনে ঘোরা দলেই থাকে। তবে রেজাল্টটা খারাপ করে না। আর এই চার বছরে ওর সাথেই অল্পস্বল্প ভাব হয়েছে চিনুর। হয়তো সেভাবে সরাসরি ওকে কখনো খেপায়নি বলে চিনু সাহস পায় ওকে জিগ্যেস করতে।
জয় বলে, “মায়ের অসুখ বেড়েছে হবে! গেছে হাসপাতালে।”
চিনুর হাঁ মুখ দেখে জয় নিজেই ব্যাখ্যা করে, “আরে জানিস না? ওর মায়ের তো কি বুকের অসুখ কতদিন ধরে, মাসে দুমাসে হাসপাতালে নিতে হয় একবার করে। বাবলার দিদি তো তাই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। ওর একটা ভাই আছে দেখবি ওয়ানে পড়ে, একটা পা একটু টেনে চলে? আদ্ধেক দিন আসে না? সেটাকেও দেখতে হয় তো!”
বাবলার বাবা?
আরে সে তো কবে থেকেই নেই। পালিয়েছে। কি সব চুরিডাকাতির কেসে ফেঁসে গিয়ে জেল এড়াতে পালিয়েছিল, আর আসেনি।
নিতাইয়ের দশা আরো ভাল। তার বাপ মা ভাই বোন কেউ নেই, কোন এক মামার ঘরে থাকে। সবদিন খাওয়াও জোটে না। মামা বহুদিন থেকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ফুলটাইম গ্যারেজের কাজে লাগিয়ে দিতে চাইছে। সেই ভয়েই, নইলে কি আর ও ছেলে শখ করে স্কুলে আসত!
আর কিছু জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হয় না চিনুর। বাবলা বা নিতাইয়ের ওপর রাগটা কমেনি কিন্তু কোথাও যেন একটু মনখারাপ ও দলা দলা জমে। খুব ঝাল মুড়িমাখায় লেবুর রস পড়লে যেমন মিইয়ে যায় ব্যাপারটা।
সেদিন মায়াদর্পণ হাতে বুকের আগল খুলে যায় চিনুর। সব গলগল করে বলে রাজপুত্তুর বন্ধুকে। হ্যাঁ, বন্ধুই ভাবতে ইচ্ছে করে এখন কুমার প্রতাপকে। বাবলার কথা, নিতাইয়ের কথা বলে, নিজের ছোটবেলার বস্তির ঘরের কথা বলে, কাকা কাকির কথা, মোতির মায়ের কথা, এমনকি ওর যে বড় হয়ে অশোক স্যারের মত মাস্টারমশাই হতে ইচ্ছে করে তাও বলে ফেলে মুখ ফুটে।
কুমার প্রতাপ সব শোনে মন দিয়ে। যাবার আগে বলে যায়, “এই যে ওদের চিনলে চিনু, আর তোমার কোন বিপদ হবে না, দেখো।”
——————
বাবলা নিতাই তার পরদিনও এল না। এমনকি তার পরদিনও না। চিনু দেখল অঙ্কগুলো ততটাও শক্ত লাগছে না আর মন দিয়ে শুনলে। রাজপুত্তুর রোজ আসে, এমনিই গল্প করে দুজনে।
তার পরদিন ক্লাসে ঢুকেই বুক শুকিয়ে গেল চিনুর। বাবলা আর নিতাই আজ এসেছে। শুধু তাই নয়, সীটে বসামাত্র তার ঠিক পিছনের ডেস্কে এসে বসল তারা। স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন দেখেও মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল চিনুর।
আজ অঙ্কগুলো সব মাথার ওপর দিয়ে গেল। স্যার যতবার বোর্ডের দিকে পিছন ফিরেছেন চিনু পিছন থেকে চাঁটি বা গাঁট্টা খেয়েছে। সিঁটিয়ে বসে থাকে চিনু, মাথার সাথে সাথে চোখের কোণ জ্বালা করতে থাকে। রাজপুত্রের ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়।
ক্লাস শেষ হয়। স্যার বেরোন। অমনি ক্লাসের সব ছেলে মৌচাকের চারদিকে মৌমাছির মত ঝাঁক বেঁধে আসে বাবলা, নিতাই আর চিনুর চারদিকে। সবার চোখ চকচক করে, ওরা জানে কিছু একটা হতে চলেছে। কিছু একটা প্রবল উল্লাসের।
চিনু কাতর চোখে জয়কে খোঁজে। নেই।
“কি রে হারামী, আমাদের বাপ-মার খবর নিচ্ছিলি কেন? নালিশ করবি?”
চিনু টের পায় ওর ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে উঠছে। ভয়।
“শালার রস কত্ত! বাবা কি করে, দিদি কি করে, ব্যাটা দেখলে মনে হয় ন্যাকাচৈতন্য, আর তলে তলে পাক্কা শয়তান! আয় দেখি কাছে আয়, রস বার করি তোর!”
চিনুর কান মাথা মুখ গরম হয়ে ওঠে। সে এক এক পা করে পিছিয়ে যেতে থাকলে পিছন থেকে কিছু লোভী হাত তাকে ধরে ফেলে, ধরে রাখে, ঠেলে ঠেলে নিয়ে যায় বাবলার দিকে। বাবলার তখন হাত মুঠো, পিঠ কুঁজো, অল্প অল্প দুলছে হিংস্র চোখে তাকিয়ে।
চিনু সে চোখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকে। তার সারা শরীর টানটান শক্ত হয়ে যায় যেন ফিট হবে, দু হাত মুঠো হয়ে উঠে এসে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করে। সারা পৃথিবী কেমন মুছে যায়, মনে হয় সব মায়াদর্পণে দেখা ছবি।
ঠাসসসসসসসস!
ঘুষিটা চোয়ালের নিচে মোক্ষম লাগল। শরীরটা ঠাস করে লটকে পড়ল মাটিতে। চারদিকের কেউই এতটা ভাবতে পারেনি, একটা সমবেত ‘হিঁইইইহ্‌’  আওয়াজ উঠেই থেমে  গেল। সবাই চুপ, সবার চোখ ঠোঁট কেটে গড়িয়ে পড়া রক্তধারার দিকে।
শুধু চিনু হতভম্ব হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার ধারণাই ছিল না এরকম একটা জব্বর ঘুঁষি সে মারতে পারে। হাতে লেগেওছিল বেশ। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে, প্রায় আনমনা ভাবে সে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। সমবেত ছেলেরা যে সরে দাঁড়িয়ে তার যাবার জায়গা করে দিল সেটাও তার চোখ এড়িয়ে গেল।
হাতটা প্রথমে একটু কলের নীচে ধরতে হবে, তারপর টীচার্স রুমে গিয়ে অশোক স্যার কে বলতে হবে আজকের অঙ্কগুলো যদি একটু ছুটির পর বুঝিয়ে দেন বসে।
———–
বাড়ি এসে জামাকাপড় না ছেড়েই মায়াদর্পণ নিয়ে কলতলার পেছনে ছুটল চিনু। উৎসাহের চোটে খুব জোরে ঘষে ফেলেছিল বোধহয়, প্রতাপের মুখ হাঁড়ি, আয়নার একপাশে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল, চটপট বল, আমার তাড়া আছে।
ওসব মেজাজে বিলকুল পাত্তা না দিয়ে চিনু বেশ রসিয়ে রসিয়ে তারিয়ে তারিয়ে বলতে গেল বাবলাকে জব্দ করার গল্প। কিন্তু ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে প্রতাপ বলল, “সমস্যা যে মিটেছে সে আজকের শ্বেতঘন্টার বদলে স্বর্ণঘন্টাধ্বনি শুনেই বুঝেছি। এবার তো আমায় বিদায় নিতে হবে ভাই!”
বিদায়? মানে চলে যাবে? মানে?!
হেঁটে হেঁটে আয়নার একদম কাছে চলে এল প্রতাপ। আয়না জুড়ে এখন শুধু প্রতাপের মুখ। চিনু এই প্রথম দেখল, রাজপুত্রকে যতটা সুন্দর ও ভাবত, তত কিছুও নয়। নাকটা ওরই মত মোটা, চোখে কাজল না থাকলে মোটেই টানাটানা বলা যেত না, আর পাগড়িটা খুলে হাতে নিয়েছে মনে হয়, চুলগুলো ওর মতই পাতলা পাতলা, পাতা পাতা…
মায়ের ডাকে চমক ভাঙতে চিনু দেখল ওর হাতে ফাটা কাঠের ফ্রেমের একটা পুরোনো আয়না, ও তন্ময় হয়ে নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ।
(পূর্বপ্রকাশিত)
 

Leave a Comment