বসে আঁকো

বসে আঁকো

কিছুকাল আগে, ফেসবুকের একটি গ্রুপ ‘রেড স্টিচ বুটিক’-এর তরফ থেকে আমায় একটি অতি কঠিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গ্রুপের বাচ্চাদের – আহা মানে, বাচ্চারা আর গ্রুপে কী করে থাকবে, মানে, গ্রুপে থাকা বড়োদের বাড়ির বাচ্চাদের জন্য একটা ‘অঙ্কন প্রতিযোগিতা’র আয়োজন করা হয়েছিল। আমায় বলা হয়েছিল তার বিচার করতে।

ভ্যালা রে বিপদ! নিজেই তো আঁকতে শিখিনি এখনও, আমি আবার কী বিচার করব! তাছাড়া, বাচ্চাদের আঁকা ছবি কখনও ওভাবে বিচার করা যায়? শিশুদের যে ভালোবাসা মিশে থাকে ওই আঁচড়গুলোয়, সে যদি অপটু হাতেও হয় , তবু ভালোবাসাটির দাম কিছুমাত্র কমে না। ওদের নির্মল মনের যে আনন্দ ধরা পড়ে রঙে রঙে, সে রঙ কিছু অসমান হলেই বা ক্ষতি কী!

আমার তো মনে হয়, বড়োরা কখনওই শিশুমনের ঐ রং, ঐ ভাব পুরোপুরি রসগ্রহণ করতেই পারে না – নিজেরা বেসিকালি বড়ো হবার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে বেজায় নীরস হয়ে যায় তো!

তবু দায়িত্ব মানে দায়িত্ব, তাই নিজের বুদ্ধিমতো পাঁচটি ছবি বেছে নিয়েছিলুম। কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলেছিলুম, “বাকিরা একটুও মন খারাপ করবে না কিন্তু! তোমাদের প্রত্যেকের আঁকা আমার ভারি ভালো লেগেছে। চুপি চুপি তোমাদের বলি, বড়োদের বলে দিও না – আমি বাপু মোটেই এত ভালো আঁকতে পারতুম না ওই বয়সে!”

সত্যিই কিন্তু। আমার প্রথম আঁকা ছবি একেবারে ফ্যান্টাসির উপাদান – ‘কোথাও কেউ নেই, চারিদিকে জঙ্গল – তার মধ্যে একটা মাছ।‘

আজ্ঞে ঠিক পড়েছেন, গাছ নয়, মাছ। বাঘ নয়, ভাল্লুক নয়, হরিণ নয় – একটা আস্ত মাছ তার গায়ের গোল গোল আঁশ আর ল্যাজের ডোরা দাগ নিয়ে মাটিতে বসে (মতান্তরে শুয়ে) আছে, তার চারদিকে প্রচুর জট পাকানো হিজিবিজি লাইন, সেটা জঙ্গল বলে বুঝে নিতে হবে। শুরুতেই দেখুন, সেই যুগান্তকারী ছবির একটা কপি দিয়েছি।

আমার এহেন প্রতিভায় আমার দাদু যে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি, সেটা বুঝি, যখন শুনি আমার আড়াই না তিন বছর বয়সেই অত্যুৎসাহী তিনি আমার হাত ধরে পাশের মাঠের ‘বসে আঁকো’ কম্পিটিশনে নিয়ে হাজির করেছিলেন। সেই অজ্ঞাত ছবিটি আজ থাকলে আপনাদের দেখাতুম, দেখতেন কী অপূর্ব অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্ট ছিল সেটা –  কিন্তু যেহেতু নেই তাই অদ্যাবধি বাড়ির লোকেদের হাসাহাসি মুখ বুজে শুনে যেতে হয় মশাই! আমি অবশ্য বরাবরের বীরাঙ্গনা – কারও কথায় কান না দিয়ে রাফ খাতার মার্জিন  ভর্তি করে গাছপালা ঘরবাড়ি পুকুরের সিঁড়ি বাসের হ্যান্ডল ঘরের কড়িকাঠ জানলার খড়খড়ি পাল্লা বাজারে বেগুনের ঝুড়ি এবং রাশি রাশি চুলের ছাঁদের কাটামুণ্ডু এঁকে গেছি স্কুলে, গ্র্যাজুয়েশনে, এমনকি মাস্টার্সের ক্লাসেও। স্রেফ আঁকতে ভালো লাগত বলে।

তাইজন্য আজও আমার মনে হয়, ছবি আঁকার আসল উপাদান হল আনন্দ। অন্তত শিশুদের জন্য তো বটেই। টেকনিক শেখা, নিখুঁত করার চেষ্টা খুব জরুরি অবশ্যই, কিন্তু ঐ মূল কথাটা যেন সেসবের চক্করে আড়াল না হয়ে যায়। নিজের ভালো লাগা পাতায় ধরে ফেললেই, ছবি তৈরি হয়।

সেদিন একটা ছোট্ট উপহার দিয়েছিলাম গ্রুপের জন্য এবং প্রতিযোগীদের জন্য – চটজলদি আঁকা একটা ছবি। সেটি রইল এইখানে। সব শিশুর জন্য আমাদের পৃথিবীটা এমন সুন্দর হয়ে থাকে যেন। 

 

Recent Comments

Leave a Comment