চলার পথে – ১০

চলার পথে – ১০

সদ্য, একটা আদ্যিকালের ছবি ফেসবুকে কে জানি ভাসিয়ে তুলেছে। সেইটে দেখে মনে পড়ে গেল এই ট্রিপটার কথা।

এটা একটা অনন্য অভিজ্ঞতা ছিল। তার আগে বা পরে, কখনওই এরকম ট্রিপ করা হয়নি আর।

বেশ অনেককাল আগের কথা। মুম্বই এসেছি বছর তিনেক হবে। অফিসে একটা এমন প্রোজেক্ট জয়েন করলুম যেটা সুবিশাল ও অনন্ত মোডে চলে। মানে টিম বিরাট, একটা ফ্লোরের প্রায় আধখানা নিয়ে, আলাদা ডিসি-র মধ্যে গমগম করছে, আর আগেই বেশ কিছু বছর চলেছে, আমি যখন জয়েন করলুম তার পরেও।

কাজের চাপও ছিল তদ্রূপ। এইখানে কাজ করাকালীনই আমি নিয়ম করে রাত এগারোটা নাগাদ শেষ বেস্ট-এর বাসটা ধরতুম। বেস্ট বুঝলেন তো? বৃহন্মুম্বই ইলেক্ট্রিক্যাল সাপ্লাই অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট, মুম্বইয়ের সব লাল বাস যার অধীনে। প্রাইভেট বাস টাস নেই, এরাই রাস্তা দাপিয়ে বেড়ায়।

ওই অতক্ষণ ধরে লাগাতার একসঙ্গে কাজ করার ফলে ঘটনার ঘনঘটা ছিল যাকে বলে! কাজের ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে ঝগড়া, টিম লিডদের খটাখটি, মড্যুলে মড্যুলে গুঁতোগুঁতি রেষারেষি, ইন্টিগ্রেশনের বাগ নিয়ে চাপান উতোর, আবার প্রোডাকশন ইস্যু এলে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ গতিতে বাগ-বিতাড়ন – সবরক ভ্যারাইটিরই সম্পর্ক ছিল, যেমন সব পোড়খাওয়া আই টি প্রোজেক্টেই থাকে। তার সঙ্গে ছিল লাঞ্চ ভাগাভাগি করে খাওয়া, বোরডম কাটাতে টুক করে উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত বল লোফালুফি করে নেওয়া দূরের কিউবিকলের টেস্টারটির সঙ্গে, দিওয়ালি ডেকোরেশনে বস-কে ভুলিয়েভালিয়ে ভাগিয়ে দিয়ে তার কম্পিউটারটাকেই কান আর শুঁড়ওয়ালা গণেশ বানিয়ে দেওয়া, ভারতবর্ষের প্রায় সব রাজ্যের রেসিপি পরস্পরের সঙ্গে, স্যাম্পল সহযোগে  শেয়ার করা, দল বেঁধে বাইরে খেতে বা শপিং ম্যলে ঘুরতে যাওয়া, এমনকী লাঞ্চের পর জনে জনে এসে একজনের ডেস্ক খুলে অবারিতভাবে পানমশলা নিয়ে যাওয়া অবধি। পুরো সংসার পেতে বসা হয়েছিল, এখন ভাবলে মনে হয়। সেসব ড্রয়ারে তখন কী না থাকত সম্মিলিত প্রয়াসে – খিদে পেলে এর থেকে চানাচুর, তার থেকে বিস্কুট, এখান থেকে ক্যাডবেরি তো সেখান থেকে হজমিগুলি জুটে যেতই। সব থাকত, সব – সেফটিপিন, ছুরি, কাঁচি, টর্চ থেকে দাবার ছক আর ঘুঁটি পর্যন্ত। এমনকী একবার সদ্য কেটে আসা চুল বারবার চোখে পড়ছে, অসুবিধে হচ্ছে দেখে পাশের তরুণটি নির্বিকারভাবে তার ড্রয়ার খুলে একটা হেয়ারব্যান্ড বার করে দিয়েছিল।

এই টিম থেকে একদিন ঠিক হল, বেড়াতে যেতে হবে। শুক্রবার কীসের যেন ছুটি ছিল – লং উইকেন্ড, অতএব চলো!

চলো মানে আবার ধারে কাছে নয় – সোজা মালভন-তরকর্লি।

ওরে সে যে বহুদূর! যেতে আসতেই তো ছুটি শেষ!

আর ওরে! যে প্ল্যান করছিল সে ছেলে যেমন হুজুগে, কথা শোনার মধ্যেই নেই এসব ব্যাপারে – তেমনি এফিশিয়েন্ট।

‘রাত্রে ট্রাভেল করব। থার্সডে নাইট। নিজেদের বাস ভাড়া করব। ভোরবেলা মালভন পৌঁছে যাব। সেদিন ওখানে ঘুরব, পরদিন তরকর্লি ঘুরে আসব, তার পরদিন আশপাশে আরও বিচ আছে দেখব, রবিবার সকালে বেরিয়ে রাত্রে বাড়ি। ব্যস!”

সেও বলে দিল ব্যস, আমাদের হাসিখুশি হ্যান্ডসাম ও তেজী বসও ডুগডুগ করে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দিল – সুতরাং হয়ে গেল, ঐ ব্যস!

বাস লাগল না অবশ্য, হাতে গুনে জনা পনেরো ষোলো জনই হল শেষমেশ। টেম্পো ট্রাভেলার নামের সিক্সটিন সিটার মিনিবাস টাইপের জিনিস ভাড়া নেওয়া হল একটা। পুরো ডিসি সরগরম এই ট্রিপ নিয়ে, এমনকী যারা যাবে না তারাও বেজায় উত্তেজিত ও প্ল্যানিং-এ তদ্গত হয়ে পড়ল।

তাদের সসম্ভ্রম ও সামান্য ঈর্ষান্বিত চোখের সামনে এই কদিন আমরা, মানে যারা যাব, বেশ একটা নাক-উঁচু গোছের ভাব নিয়ে চলাফেরা করতে লাগলুম।

অবশেষে সেদিন এসে হাজির হল। অফিস সেরে, ব্যাগ পিঠে নিয়ে লাফাতে লাফাতে টেম্পো-ট্রাভেলারে উঠে পড়া গেল।

অমনি হুশ করে সবার বয়স নাহোক চার পাঁচ বছর করে কমে গেল। লাফালাফি, গান গাওয়া, গানের লড়াই, ডাম্ব শ্যারাড… তার মধ্যে বাস হাইওয়েতে পড়ে হু হু করে ছুটছে, মোড় ঘুরছে, টলে এ ওর ঘাড়ে পড়ছি আর অকারণ হি-হি হো-হো ছড়িয়ে পড়ছে বাসের মধ্যে। বাস-ই বলি বাপু, বুঝে নেবেন – প্রতিবার অত লেখা যায় না!

উঠেছিলুম প্রায় সাড়ে ছটা নাগাদ। রাত দশটার কাছাকাছি এক ধাবা টাইপের হোটেলে এসে দাঁড়ানো হল।

অ্যাঁ? ভেজ যে!

ধুত্তোর, তাই সই। গরম গরম বানিয়ে দিচ্ছে, ঐ ঢের। রুটি, সবজি দু রকম আর মুংদাল-খিচড়ি অর্ডার হল। জানেন নিশ্চয় মারাঠীরা লাঞ্চ ডিনার দুবেলাই রুটি এবং ভাত দুই দিয়েই খায়? যেকোনও একটা খাব বললে খুব আশ্চর্য ও হতাশ চোখে তাকায় –  এবং ধরেই নেয় খাবার পছন্দ নয় বলে আধপেটা খাচ্ছি। ফ্র্যাঙ্কলি, লোককে জমিয়ে রুটি-চিকেন খাওয়ার পর ডাল ভাত খেতে দেখেছি, সেটা না হলে নাকি খাওয়া পুরো হয় না।

যাক, সে যার যেমন অভ্যাস। পুনে আর  মুম্বই মিলিয়ে এতকাল মহারাষ্ট্রে থাকার ফলে আমারও এসব গা-সওয়া হয়ে গেছিল ততদিনে।

কিন্তু সেই সবজি আসার পর টিমের বাকিরা, বিশেষ করে কচিকাঁচাগুলো দেখি মুখ ভেটকে কানাকানি করছে।

কী হল রে?

অনুসন্ধান করে জানা গেল, আমরা তো নেমেই ওয়াশরুমে ছুটেছি, সেই ফাঁকে আমাদের বস, যিনি এ গ্রুপে  বয়োজ্যেষ্ঠ, ইচ্ছেমত সবজি বলে দিয়েছে।

আর তার একটা হল ব্যাঙ্গন-ভর্তা। তাঁর প্রিয় ডিশ।

সেই বেগুন দেখেই এদের পিত্তি চটেছে।

তিনি কিন্তু নির্বিকার। নিজের থালায় এক খাবলা তুলেছেন তো বটেই, তারপর আবার জনে জনে ’আরে খাও খাও বহোত আচ্ছা বানায়া’… বলে চামচ ভর্তি করে প্লেটের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন।

সেই পনেরোজনের গ্রুপে নাহোক বারোজনের সেই রাত্রে আচানক বেগুনে অ্যালার্জি ও ডাক্তারের বারণ গজিয়েছিল।

বাকি দুজনের একজন ছিল বসের মতই বেগুনভক্ত আরেক মহারাষ্ট্রিয়ান; অন্যজন আমি।

হ্যাঁ, আমি, কারণ অন্য ডিশটা ছিল পনির। এনিটাইম পনিরের চেয়ে বেগুন আমার বেশি পছন্দ, এবং বেগুন-ভর্তাটা সত্যিই বেশ ভালো বানিয়েছিল।

খেয়েদেয়ে আরেক দফা ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করা গেল। এবার আর খেলাধুলোর এনথু নেই, যে যার ব্যাগ থেকে চাদর বার করে মুড়িসুড়ি দিয়ে সীটেই যথাসম্ভব হেলান দিয়ে ঘুমোনোর জোগাড় শুরু হল। সীটগুলো ছিল টু বাই ওয়ান, আমি একটা একার সীট দখল করেছিলুম। ফলে বাবু হয়ে বসে, নিজেকে কষে পুঁটলির মতো চাদরে মুড়ে ফেলে জানলার দিকে মাথা হেলিয়ে দেওয়া গেল।

ও হরি! ঘুমোবে কে!

শীতকাল ছিল বলেছি কী? মুম্বইতে সেই অর্থে ঠাণ্ডা না পড়লেও, এসব খোলা জায়গায় যে ভয়ানক রকমের পড়ে, সেটা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগলুম। কষে বন্ধ করলেও চলন্ত বাসের কাচের ফাঁক দিয়ে যে হাওয়া হু-হু করে ঢুকছিল, তা আক্ষরিক অর্থেই হাড় কাঁপানো।

যত রাত ঘনাচ্ছে, তত ঠাণ্ডাও বাড়ছে। পিছনের সিট থেকে কার্তিক বা মন্দার কেউ একটা কাঁপা কাঁপা গলায় গান ধরতে বুঝলুম যে কেউই ঘুমোতে পারছে না। সামনের সীট থেকে খিলখিল করে হাসি ভেসে এল, ‘তু চিল্লায়গা তো কুত্তা আ যায়গা’ বলে আওয়াজ দিল আরেকজন। বস ঘুম জড়ানো গলায় বলল, গাইছে গাইতে দে বাপ, এরপর নইলে নাচতে শুরু করবে।

আমি ভাবছিলুম, বেনের পুঁটুলি থেকে কুকুর কুণ্ডলি তো এখনই হয়ে গেছি, চতুর্থ প্রহর এলে কী করব! ভাবতেই ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।

 

(ক্রমশঃ)

Recent Comments

Leave a Comment