চলার পথে – ১১ (cholar-pothe-11)
সেই যে বাসে বসে বসে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, সে ঘুম ভাঙল একদম সকাল সাতটা। প্রায় মালওয়ান পৌঁছে গেছি তখন। রাতের রাস্তায় প্রেমসে টেনে চালিয়েছে ড্রাইভারদাদা, ফলে খাওয়াদাওয়ার জন্য যা সময় খরচ হয়েছে সব মেক আপ হয়ে গিয়েও তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে।
বুকিং করা ছিল। এম টি ডি সি র রিসোর্টে জায়গা পাওয়া যায়নি, তাই পাশেই একটা হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে, ওখানেই ব্রেকফাস্ট খেয়ে হুড়মুড় করে গিয়ে পড়া হল মালওয়ান বীচে। ঠিক যেমন সোনালি ছবিতে দেখে আশা করেছিলাম তেমন না, আরবসাগরের কালো বালির বীচ।
তারপরের বর্ণনা সব তালগোল পাকিয়ে গেছে – যেতে বাধ্য! পনেরো ষোলো জন অমন গেছো ছেলে মেয়ে মিলে বীচ দাপাতে থাকলে কিছু মনে রাখা যায় না। ভিজছি, সে ভেজা জামা আবার গায়ে শুকোচ্ছে, এই মন্দার আর কার্তিক মারপিট লাগিয়ে দিল, এই অপর্ণা আর সোনিয়া বালির উপর পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে হুশ করে দৌড় মারল যতদূর চোখ যায়, এই লাফ মেরে জল পেরোতে গিয়ে প্রিয়া দুম করে থেবড়ে পড়েই গেল বা!
বালির মধ্যে একটা ডিঙ্গিনৌকা রাখা ছিল। ছেলেগুলো তরতর করে গিয়ে চড়ল তার উপর। তাই দেখে কয়েকটা মেয়েও হামচে-খামচে, ঠেলেঠুলে, টেনে ইত্যাদি উপায়ে উঠে পড়ল সেখানে। তারপর আর কেউই নামতে পারে না… সে কী হাসাহাসি… শেষে ধপাধপ লাফ টাফ দিয়ে বস্তার মত বালির উপর পড়েছিল এসে।
এখন ফিরে ভাবলে অবাকই লাগে। এসব লোকে কলেজবেলায় করে। অফিসে, যেখানে কিনা পলিটিক্স আর রেষারেষির রমরমা হয় শুনি, সেখানকার অমন দায়িত্ব টায়িত্ব নিয়ে কাজকর্ম করা লোকজন এরকম অনাবিল বন্ধুও হয়ে যেতে পারে!
কিন্তু গেছিল। সত্যিই গেছিল।
খাওয়ারদাওয়ার কথা আর এদ্দিন পরে মনে নেই। তবে বিশুদ্ধ মালওয়ানি রান্না ছিল এটা মনে আছে – টকটকে লাল আর গরগরে ঝাল। আমি তখন একদম ঝাল খেতে পারতুম না, টক দইয়ের ভরসায় ম্যানেজ করেছিলুম।
তারপরের দিন যাওয়া হয়েছিল তরকার্লি। দিনের দিন গিয়ে আবার ঐ হোটেলেই ফিরে আসা।
এবং এবার দেখলুম সোনালি বালুবেলা কাকে বলে। অনেকগুলো বীচ দেখেছিলুম সেদিন স্থানীয় নৌকো ভাড়া করে, একটা থেকে আরেকটা, সেখান থেকে আরেকটা। একটা মনে আছে, প্রায় সাদা ধবধব করছে বালি। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই, শুধু কিছু সীগাল ছাড়া। অসম্ভব সুন্দর। অসম্ভব মায়াবী। প্রায় যেন কোনও অন্য জগৎ। সূর্যাস্তের সময়ে রক গার্ডেন। এবড়োখেবড়ো পাথরে ভরা চত্বরে ফেনিল সমুদ্রের সে কী ঝাঁপাঝাঁপি!
আবার মনে পড়ে, ঘুরে ঘুরে, জলে ভিজে, কোনও একটা মন্দির দেখে ক্লান্ত শরীরে সেই নৌকাচালকেরই পরিচিত এক ছোট্টো টালির বাড়ির বাইরে বেঞ্চে বসে টাটকা ভাজা বড়াপ্পাও আর আগুন গরম গুচ্ছের দুধ চিনি দিয়ে কষে ফোটানো ‘ঘাটি’ চা দিয়ে অনিয়মের লাঞ্চ করা। দৌড়াদৌড়ি করে ব্যথা পা ছড়িয়ে বসে আছি আমরা, বেঞ্চে, মাটিতে, বেড়ার পাশের একটু ধাপিতে… এত ক্লান্ত কথা বলতে ইচ্ছে নেই, এত আনন্দিত কথা বলার প্রয়োজন নেই… সামনে গুটিকয় গাছের ঝিরঝিরি পাতার আড়ালে আস্তে আস্তে রোদ পড়ে আসছে, উঠোনের একপাশে মুরগি চরছে একটা একা একা…
এরকম অঞ্জলি ভরে ওঠা দিন শেষ হয়েছিল আরেক দফা আনন্দের মধ্যে। হোটেলে ফিরে, ফ্রেশ হয়ে, হোটেলের ছাতে চলে যাওয়া হল সবাই মিলে। মাটিতে দু তিনটে এমারজেন্সি লাইট গোছের কিছু আলোর চারদিকে ঘিরে বসা একদল বন্ধু –এখন বন্ধু ছাড়া আর তো কিছু বলা যায় না – যেরকম আনন্দের ঘন্টা দুই সময় কাটাল, পরে আর কখনও কোনও অফিস পার্টিতে সেই লেভেল আর ছুঁতে দেখিনি।
না, আমাদের সেদিন কোনও ড্রিঙ্কস লাগেনি মৌতাত আনতে। ঝিনচ্যাক বাজনা বা ডিস্কোফ্লোরও লাগেনি এঞ্জয় করার জন্য। আমাদের ফ্লোরের সজ্জা ছিল মাথার উপরের কালো আকাশে তারার ঝিকিমিকি আর বাজনা ছিল পাশ থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের গর্জন। আর আমাদের মৌতাতের জোগান দিচ্ছিল এই পরিবেশে, পর পর ভূতের গল্প, হাসির গল্প, কোরাসে গান, গানের লড়াই, ডাম্ব শ্যারাড, ধাঁধা।
মানুষের মস্তিষ্ক ও হৃদয় যখন উপভোগ করতে পারে, তখন পার্থিব উপকরণ সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।
পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে ফেরার পালা। সেই বাস, সেই একই রুট। কিন্তু এবার দিনের বেলা, তাই স্পীডও তত নয়, চারদিকে ধীরেসুস্থে দেখতে দেখতে যাওয়ারও সুযোগ হচ্ছে। লাঞ্চ পথেই হল, ওরকমই কিছু হোটেলে। তার খানিক পর হল কেলো। বাসের ইঞ্জিন গোঁ গোঁ গাঁ গাঁ করে কেমনধারা দাঁত ছরকুটে থেমে গেল।
সে এক টিপিক্যাল মহারাষ্ট্রের রাস্তা। সরু, আঁকাবাকা, ঝকঝকে পরিষ্কার, মোড়ের মাথায় অশ্বত্থটি হেলে পড়েছে রাস্তার উপর, তার পিছনদিকে গোটা দুই দোকান, চায়ের ঠেক।
ড্রাইভারের আদেশে আমরা সবাই নেমে পড়লুম বাস থেকে, তিনি তার হেল্পার ও ঐ চায়ের দোকানে বসে থাকা কিছু উটকো লোককে নিয়ে ইঞ্জিনের তোয়াজে রত হলেন।
দাঁড়িয়ে, বসে, চা খেয়ে, পায়চারি করে করে যখন পায়ের সুতো খুলে যাবার উপক্রম হয়েছে তখন অবশেষে বাস ঠিক হল। আবার হুড়মুড় করে উঠে পড়লুম সবাই, বাড়ি ফেরার টান প্রবল হয়েছে ততক্ষণে। আমার স্টপ বোম্বে ঢোকার শুরুর দিকেই ছিল, নেমে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ঘরের পানে পা বাড়ালুম।
বাস চলে গেল, আমার সঙ্গে রয়ে গেল সমুদ্রতীরে কুড়োনো দুটো পাথর, আর দুদিনের অসম্ভব এক আনন্দের স্মৃতি।