চলার পথে – ১২ (cholar-pothe-12)

চলার পথে – ১২ (cholar-pothe-12)

সিকিম, পর্ব – ১


 

শরৎকালে আকাশে সেই পেঁজা তুলো মাখা ঝকঝকে নীল দেখা দিল কি দিল না, মন বলে ‘চল!’

যখন প্রবাসে ছিলুম, তখন ঘর টানত, কিন্তু আসা হত না। বেড়ানোও হত না। এখন ঘরে বসে সেই কতকাল হয়ে গেল… এবার প্রায় অস্থির হয়েই ঠিক করলুম, যাই।

কোথায়?

কোথায় আবার! পাহাড়। উমার ঘরগেরস্থির আলয়, হিমালয়। অমন করে আর কিছুই টানে না যে!

কিন্তু এত বেলায় এমন ভাবতে বসলে, টিকিট কই?

সে-ও হল তৎকালে। হয়তো এই বেড়ানো হবার ছিল বলেই হল ঠিক। কনফার্মড টিকিট, লোয়ার বার্থ যেমন চাই সব।

তাহলে স্যুটকেস গুছোতে যাই?

সে এক পর্ব, কী বলব! একদিকে বস আমি ‘অ্যা- অ্যা- ক্‌ সপ্তাহোওওও’ থাকব না বলে ক্ষণে ক্ষণে ফোন করে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে, অন্যদিকে শেষদিন অবধি মেয়ের স্কুলের পড়া গুছিয়ে, শুক্রবার বিকেল চারটেয় বেরোনোর আগে ফটাফট সব হোমটাস্ক শেষ করিয়ে আপলোড করে দিতে হচ্ছে। এই ব্যালান্সিং অ্যাক্টের মধ্যে মধ্যে একবার করে দৌড়ে তিনতলা থেকে দোতলায় যাচ্ছি, আলমারি থেকে জামা বাছছি, স্যুটকেশ খালি করে ঝাড়ছি, মেয়ে ট্যাঁকে বেরিয়ে দুজনের মজবুত বুটজুতো কিনে আনছি, ফোন থেকে সব ছবি নামিয়ে স্পেস খালি করছি, ওষুধ কী লাগতে পারে না পারে হিসেব করছি।

সে এক উত্তাল উদভ্রান্ত সময়! এদ্দিন তেমন কোথাও বেরোতে হয়নি, এখন ভালো জামা টামা বার করে দেখি কন্যা ইতিমধ্যে দিব্যি সেসব ছাপিয়ে ‘বয়ো’ হয়ে গেছেন, ফলে লাস্ট মোমেন্ট আবার একদফা শপিং (বেঁচে থাক আমার সিঁথির মোড়ের মার্কেট), মোজার সেট কোনটা যে কার বুঝতে না পেরে সবশুদ্ধু ভরে ফেলা আর তার ফলে এখন আমার সব মোজা কন্যার হস্তগত, বা বলা ভালো পদগত হয়ে গেছে – ও আর ফিরে পাব না। আরও কত কী যে করলুম, ভুল করে সাততাড়াতাড়ি টুথব্রাশ প্যাক করে ফেলে পরদিন ঘুমচোখে ব্রাশ খুঁজে বেড়ালুম, নতুন ইয়ারফোন ফেলে রেখে পুরোনো বাতিল ইয়ারফোন নিয়েই চলে গেলুম, শখ করে একটা নতুন পড়ে থাকা লাল টুকটুকে চাদর নিলুম এবং ট্রেনে উঠে বার করার পর হুঁশ হল সে চাদরটা বেজায় কুটকুটে বলেই এদ্দিন পড়ে ছিল। মানে জেরোম কে জেরোম-এর কথা মনে পড়ে যাবার মতো ঢের কাণ্ডকারখানা হয়ে গেল এই এক সপ্তাহে।

কিন্তু শেষ অবধি, শুক্রবার সন্ধ্যায় পোঁটলা-পুঁটলি আণ্ডাবাচ্চা সব নিয়ে ট্রেনে ওঠা হল। স্যুটকেস, ব্যাগ, ঝুলি, স্লিপিং ব্যাগ, তিতির আর তার দাদুমণি-দিম্মাকে যে যার জায়গায় সেট করে দেবার পর ধুপুস করে নিজের জায়গায় বসতেই ট্রেন নড়ে উঠল, আর বুকের মধ্যে সেই বাঁশি বেজে উঠল যা মানুষকে পথে টেনে নামায়।

রাতের ট্রেন। খেয়েদেয়ে শুতে যা দেরি। রাত্রে তিতির একটা স্লিপিং ব্যাগ পাবে কথা হয়েছে, সেই আনন্দে সে রেকর্ড টাইমে খাওয়া শেষ করে ফেলল। আনন্দ কেন? আরে, স্লিপিং ব্যাগ একটা মহা মোলায়েম মজার ব্যাপার। তিতির তো তিতির, চান্স পেলে আমিও তার মধ্যে ঢুকে পড়তে ভারি ভালোবাসি!

এর মধ্যেই আলাপ হয়ে গেছে আশপাশের লোকজনের সঙ্গে। সামনের সীটের দিদুন শিলিগুড়িতে ভাইয়ের কাছে যাচ্ছেন, তা বাদে আর সবাই বেড়াতে যাচ্ছে, কেউ দার্জিলিং, কেউ গ্যাংটক, কেউ রিশিখোলা। ওইটুকু কম্পার্ট্মেনটে অলরেডি তখন পাহাড়ি হাওয়া বইছে।

ঘুমে-আধোঘুমে রাত কেটে গেল। সকালে উঠে ব্রাশ টাশ করে এসে বসতেই দিদুন তিতিরকে ডেকে দেখালেন, ঐ দ্যাখো এগুলো চা-গাছ, চা তুলছে – আর এই হল আনারসের ক্ষেত। তিতিরের সঙ্গে সঙ্গে আমিও গলা বাড়িয়ে দেখলুম বেঁটে বেঁটে ত্যারাব্যাঁকা চা গাছ আর মাথায় ঝুঁটি আনারসদের।

নামলুম ষ্টেশন, ন’টা বাজে হবে তখন। গাড়ি ছিল দাঁড়িয়ে, কুলির সাহায্যে বাইরে এসে, গাড়িতে উঠে রওনা দেওয়া গেল সরাসরি আমাদের প্রথম থাকার জায়গা –  হী-বার্মিক-এর দিকে। স্ট্রিয়ারিং-এ বসে ফিটফাট শক্তপোক্ত কদমছাঁট চুলের মাঝবয়েসী চন্দ্র গুরুং, আমাদের আগামী তিনদিনের সারথি।

হী আর বার্মিক (বানান যদিও burmiok, স্থানীয় উচ্চারণ দেখলুম বার্মিক্‌) দুটো পাশাপাশি গ্রাম। পুরোটা মিলিয়ে এতটাই বড়ো, যে এদিকে কয়েক পা, আর ওদিকে তার চেয়ে কয়েক পা বেশি হাঁটলেই বাড়িঘরের চৌহদ্দি শেষ। তখন শুধু পরিষ্কার আঁকাবাঁকা রাস্তা, একদিকে খাদ আর অন্যদিকে সবুজ পাহাড়।

কিন্তু হাঁটাহাঁটির কথা তো পরে! আগে তো গিয়ে পৌঁছই! উরি বাবা, সে কী সময় লাগল সেদিন আমাদের যেতে! রাস্তা খারাপ ছিল, বৃষ্টি হয়ে; সেইসঙ্গে পুজোর জ্যাম। সরু রাস্তা, কতবার দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হল এক এক করে গাড়ি পার হবার জন্য। একবার এদিকে গাড়ি ছাড়ছে, একবার ওদিকের। তখনই খেয়াল করলুম, কী অসম্ভব ধৈর্য আর ভদ্রতা পাহাড়ি মানুষদের, কী ডিসিপ্লিন! কোনও পুলিশ লাগে না, কোনও তর্কাতর্কি বা ‘আমি-আগে-যাব’ মার্কা অসভ্য ঠেলাঠেলি নেই – পুরোটা সুষ্ঠুভাবে হয়ে যাচ্ছে নিজেদের বোঝাপড়ায়।

লোহাপুলে ‘নাস্তা’ সেরে, মেল্লি ব্রিজ পেরিয়ে সিকিম বর্ডার ক্রস করলুম। দাঁড়ানো প্রহরী চোখ পাকিয়ে দেখে নিল সবাই মাস্ক পরে আছে কিনা। জোড়থাং পেরোনোর পর রাস্তা আরও পাহাড়ি হয়ে উঠল, উঁচু-নিচু, ঘুরে ঘুরে ঘুরে…

চন্দ্রভাই দেখিয়ে দিল পাহাড়ের ঢাল জুড়ে ফুলঝাড়ু গাছ। তিতিরের দিম্মা চিনিয়ে দিল সিগনেচার স্পাইডার – এই মাকড়শা জাল বুনে তার মাঝে একটা জিগজ্যাগ প্যাটার্ন করে, সাধারণত সেটা দেখে মনে হয় X, যেন বা কেউ সই করল – তাই থেকে এই নাম। বেশ বড়ো সাইজের মাকড়শা।

তার পর শুরু হল পাহাড়ের বিখ্যাত হেয়ারপিন বেন্ড। তিতিরকে কথাটা শেখালুম বটে, কিন্তু খানিক বাদেই দেখি মেয়ে সেটা ভুলে গিয়ে বলছে, “মা ঐ আরেকটা সেফটিপিন আসছে!”

এসব জ্যাম, খারাপ রাস্তা, ‘সেফটিপিন’ ইত্যাদির চক্করে বেশ একটূ লেট করেই এসে পৌঁছলুম আমাদের বুক করা হোম স্টে-র দরজায়। ছোট্ট দোতলা বাড়িটা, অন্তত প্রথম দেখায় তাই মনে হয়েছিল, পরে জানা গেল রোড লেভেলের নিচেও আরও তিনটে ফ্লোর আছে যাতে মালিক নিজে থাকেন, ওপরের ফ্লোর দুটো শুধু ট্যুরিস্টদের জন্য। অতক্ষণের জার্নির পর হা-ক্লান্ত দশা তখন, ফ্রেশ হয়েই খেতে বসা গেল। যে ঘরে ছিলুম, তার একদিক জোড়া কাচের জানলা। শুনলুম, আকাশ পরিষ্কার হলে ওখান থেকে সরাসরিই সেই তাঁকে দেখা যায়। কিন্তু সেদিন শুধুই সামনে ঢালের সবুজ আর আকাশের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ দেখা যাচ্ছিল।

সামনের বারান্দায় দাঁড়ালেও অবস্থা তথৈবচ।

সেদিন স্নান করে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা নামল। নতুন জায়গা, তায় সদ্য এসেছি। বেরোনোর ইচ্ছে হল না আর, কফি, পকোড়া, সঙ্গে আনা তাস আর পূজাবার্ষিকী সহযোগে সন্ধ্যা কাটানো গেল।

 

(ক্রমশঃ)

Recent Comments

Leave a Comment