চলার পথে – ১৩ (cholar-pothe-13)
সিকিম, পর্ব – ২
১০ অক্টোবর, ২০২১, রবিবার
==================
‘কাঞ্চন’ দেখার আশায় অ্যালার্ম দিয়ে শুয়েছিলুম, কিন্তু সক্কাল সক্কাল ঘুম ভেঙে উঠে সেই আশায় এক ঘটি বরফ গলা জল পড়ল। মেঘ, ঘন সুতীব্র স্থির মেঘের চাদর।
স্থির?
মোটেই না। চোখের সামনে সে মেঘ ছুটে এসে সব ঢেকে দিল। এই যে ছবি দুটো দেখছেন পর পর, এ দুটো এক জায়গায় একভাবে বসে ঠিক এক মিনিটের ব্যবধানে তোলা।
ঐ মেঘ, নাকি কুয়াশা বলব, নাকি ফগ – এই আশ্চর্য রহস্যময় আবরণে মোড়া জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, এ যেন আমাদের মরপৃথিবী নয়, এই মুহূর্তে ওখানে অন্য জগতের বাসিন্দারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের দিকে তাকানোর মতো শক্তি আমাদের নেই, তাই এই কুয়াশার যবনিকা পড়ে গেল মঞ্চে।
কিন্তু ঘড়ির কাঁটা এসব ভাবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে না। রেডি হয়ে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বেরোলুম, তবু চন্দ্র-র বকুনি খেতে হল লেট করেছি বলে।
আজ আমরা প্রথম যাচ্ছি রমিধাম, সাধুধামও বলে লোকে। এটা হল কাছাকাছি একটা হাইকিং পয়েন্ট। যাবার পথে দেখলুম সাদা জামা কালো প্যান্ট/স্কার্ট পরা স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়ে, হেঁটে চলেছে। কদ্দূর ভাই স্কুল?
চন্দ্র হেসে বলল, দেড় কিলোমিটার হবে! এখানে তো লোকে আরামসে দু তিন কিলোমিটার হেঁটে চলে যায় রোজ।
সিকিমের রাস্তা ভারি সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রাস্তার ধারে ধারে ছেলে মেয়ের দল ঘাস কাটছে। পোষা গরু ছাগলের জন্য এটা রোজের কাজ ওদের। বুনো ঘুঘু বসে আছে রাস্তায়, গাড়ির আওয়াজ পেলে উড়ে যাচ্ছে ফুড়ুৎ করে।
বেশ খানিকটা চড়াই উঠে, গাড়ি এসে থামল রমিধাম যাওয়ার পায়ে হাঁটা রাস্তার নিচে। বাপির পক্ষে এতটা হাঁটা সম্ভব নয়, তাই গাড়ির পাশেই একটা চাতালে পাথরে বসে রইল। চন্দ্র ব্যস্ত হয়ে ভারি যত্ন করে খাবার জল, জ্যাকেট গুছিয়ে দিয়ে, এমনকী বৃষ্টি এলে আঙ্কল যাতে না ভিজে যান তাই গাড়ির চাবিও ধরিয়ে দিল হাতে। আগেও দেখেছি, পাহাড়ের মানুষদের আন্তরিকতা, অল্প সময়ে বিদেশীদের আপন করে নেবার ক্ষমতা অতুলনীয়।
তারপর আমরা তিন কন্যা বীরবিক্রমে চন্দ্রর সঙ্গে পাহাড়ে চড়তে লেগে পড়লুম। এই দেখুন সে রাস্তার এক ঝলক।
আগাগোড়া পরিষ্কার এমন বাঁধানো, জায়গায় জায়গায় দরকারমতো সিঁড়ি, ঘন জঙ্গলের ছায়ায় ছায়ায় প্রায় ঘন্টাখানেক হেঁটে ওঠা। সে যে কী ভালো লাগার ব্যাপার, না গেলে বোঝা অসম্ভব! অনেকটা উঁচু, মাঝে মাঝে বেশ খাড়াই – এক একবার দম ফুরিয়ে আসছে ঠিক কথা, কিন্তু নেশার মতো হেঁটেই চলেছি। একেকবার দাঁড়িয়ে পড়ে ভিউ দেখছি, রাস্তার পাশের ফুলের ছবি তুলছি।
এক জায়গায় এসে রাস্তা দুভাগ হল, একদিকে সিঁড়ি, অন্যদিকে স্লোপ ধরে উঠে যাওয়া। চন্দ্র বলল, সিঁড়িটা খাড়াই পথ – আন্টি পারবে না, অন্যটা রয়েসয়ে উঠবে তবে লম্বা বেশি। আমি আর তিতির তখন জোশে, বললুম আমরা সিঁড়ি দিয়ে যাই তবে!
তারপর সে যে কী উঠছি আর উঠছি। কিছু সিঁড়ি, কিছু এমনি রাস্তা, আবার সিঁড়ি, আবার ঘোরানো রাস্তা… নির্জন, ঝিঁঝির মতো অজানা পোকার ডাক, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা গাছের ছায়া… তিতিরেরও মজা লেগে গেছে, লাফাচ্ছে, ছুটে এগিয়ে যাচ্ছে, আবার ছুটে এসে জড়িয়ে ধরছে।
একটু একটু ভয় করছিল। বহুকাল তো আমার এত এক্সারসাইজের অভ্যাস নেই, ওজনটাও বলতে নেই, কিঞ্চিদধিক হৃষ্টপুষ্ট বটে! মেয়েটাকে নিয়ে হুট করে এরকম একা চলে এলুম, পারব তো শেষ অবধি?
কিন্তু এখানের জলহাওয়ায় মনে হয় ম্যাজিক থাকে। পারলুম, দিব্যি। এমনকী বিশেষ হাঁপিয়েও গেলুম না। শেষের খাড়া প্রায় সত্তরটা সিঁড়ি একদমে উঠেও না।
তবে তার আগে আরেক কাণ্ড হয়েছিল। চন্দ্র বলেছিল বরাবর একটাই রাস্তা, চিন্তা নেই। কিন্তু এক জায়গায় এসে দেখি রাস্তা দুভাগ। এদিকে খানিক আগে অবধি টুকটাক ঘর চোখে পড়ছিল, লাল জামা পরা মাথায় রুমাল বাঁধা বৌমানুষ ঝাড়ু দিচ্ছিল, মুরগি চরছিল… এখন বেশ খানিকক্ষণ হল কিচ্ছু নেই। এমনকী, ফোন বার করে দেখি ফোনের সিগনালটাও নেই।
চিন্তায় পড়েছিলুম বইকী! তিতির তো ধরেই নিল আমরা হারিয়ে গেছি, এখন জন্মের শোধ এই বনে ঘুরে বেড়াব আর বাঘ ভালুকে গপ্ করে খেয়ে নেবে… তাকে অভয় দিয়ে, এদিকে নিজে মনে মনে খুব ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে ভাবছি কী করা যায়, এমন সময় বিপত্তারণ এসে হাজির হল।
না, মাকে নিয়ে চন্দ্র নয়, এমনকী কোনও মানুষই নয়। একটা কালো ঝুলো-লোম চামর-ল্যাজের পাহাড়ি কুকুর। আমাদের শুঁকে-টুকে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে বাঁদিকের পথ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সে ঘাড় বেঁকিয়ে চাইল।
আর কী চাই? এই তো পথপ্রদর্শক।
সত্যিই আমাদের পুরো রাস্তা গাইড করে নিয়ে গেল সে। খানিক বাদে অবশ্য কুকুরের মালিক, এক রোগা, প্রায় বাচ্চা ছেলেও নিঃশব্দে এসে যোগ দিল আমাদের পাশে। সে-ই জানাল, চিন্তার কোনও কারণ নেই, মা-জীরা ওদিকের রাস্তা দিয়ে আসছে সে দেখে এসেছে, এখনও দেরি আছে ওদের পৌঁছতে।
চূড়ায় নিয়ে এসে, এন্ট্রি ফী কেটে রসিদ দিয়ে, টাওয়ারের রাস্তায় আমাদের এগিয়ে দিয়ে সে বিদায় নিল – কুকুরটি কিন্তু সেই থেকে আমাদের সঙ্গেই রইল, একদম নিচে না নামা অবধি।
তারও একটা ছবি তুলেছি, এই যে –
টাওয়ারটা থেকে সে যে কী ভিউ! পুরো ৩৬০ ডিগ্রি খোলা জায়গা। দূরে দূরে রোদ পড়ছে ইতিউতি। মেঘলা দিন, নইলে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ আরও কত পয়েন্ট দেখা যেত এখান থেকে! তবু, যা দেখলুম তাই অসামান্য, মন ভরিয়ে দেওয়ার মতো।
(ক্রমশঃ)
Dalia Ganguly
October 24, 2021 - 9:42 am ·Monay hochchay jno beriya e Alam Rumidham… Porer ta kobay….protikkhay thakbo
admin
October 31, 2021 - 2:56 am ·থ্যাঙ্কু! পরেরটা দিয়েছি এবার। আরও কয়েকটা পর্ব হবে। 🙂
Rituparna
October 24, 2021 - 1:24 pm ·Khub valo cholche lekha❤❤
admin
October 31, 2021 - 2:57 am ·থ্যাংকু! 🙂
Soumi Das
October 26, 2021 - 3:26 pm ·Khub sundor laglo. Apnara hee burmiok e kon homestay te chilen?
admin
October 31, 2021 - 2:57 am ·অনেক ধন্যবাদ। নাম তো জানা নেই, স্বরূপবাবু চালান।