চলার পথে – ১৪ (cholar pothe – 14)
সিকিম, পর্ব – ৩
————————
১০ অক্টোবর, ২০২১, রবিবার – আগের পর্বের পর থেকে
রমিধামে ওঠার চেয়ে নামাটা আরেকটু তাড়াতাড়ি হল, এবার সবাই একসঙ্গেই এলুম অন্য রাস্তাটা দিয়ে। খানিকটা নেমে আসার পর সেই ঘরবাড়ির জায়গায় এলুম। এবার দেখি চন্দ্র আরেকজনের সঙ্গে বেজায় গল্প জুড়েছে। সাগর গুরুং নামে সেই ভদ্রলোক বললেন, এইটে হল অরিজিনাল সেই সাধুদের জায়গা, যাঁদের নামে সাধুধাম। এখানে নির্জনে তপস্যা হোম যজ্ঞ ইত্যাদি করতেন তারা। তাঁদের সেই ছোট্ট মন্দির এখনও আছে এখানে, তাছাড়া তাঁদের গুরুর মূর্তি আছে।
বলে ফেললুম, দেখতে পারি?
অমনি কী খুশি আর ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠল সবাই। হাঁকডাক করে চাবি আনিয়ে, আমাদের প্রায় হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সমস্ত খুলে দেখালেন। পাথরের ছোট্ট দেবদেউল, বলে না দিলে মন্দির বলে বুঝতেও পারা যেত না, সেই আদ্যিকালের কাঠের চৌকাঠ, মধ্যে কত পুরোনো পুরোনো পাথর কোঁদা চেনা অচেনা মূর্তি, বিশাল বিশাল শঙ্খ, ঘন্টা।
এই প্রাচীনত্বে হস্তক্ষেপ করতে কেমন যেন ইচ্ছে করল না, তাই ভিতরে গিয়ে আর ছবি তুলিনি। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলুম শুধু। এসব জমাট বেঁধে থাকা সময়ের সামনে নিজেদের বেজায় অকিঞ্চিৎকর লাগে।
বেরোনোর পর সাগর বললেন, আরও আছে, আমাদের মিউজিয়ম, দেখবেন আসুন।
আমি তো মিউজিয়ম শুনলে যাবই যাব! সে যতই ছোট্ট, হাতে গোনা জিনিসের হোক না কেন। এমন দুর্গম স্থানে, এত কঠিন জীবনযাত্রার মধ্যেও এসব যে এঁরা বংশপরম্পরায় এমন যত্ন করে রেখেছেন, সেটাই তো এক বিশাল ব্যাপার!
ছোট্ট ঘর আরেকটা, তার মাটিতে যজ্ঞ করার বেদী। একপাশে তাক করে সব পুরোনো বাসন কোসন রাখা। ওঁদের প্রাচীন পূজাসামগ্রী সব। বিরাট বিরাট ধাতুর থালা, হাঁড়ি, পানপাত্র। একটা পানপাত্র আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন – বাবা রে, এমনিই তুলতে হাত টনটন করে উঠছে, এতে পান করা একটা ব্যাপার তো! আমার দশা দেখে সবাই হেসে কুটিপাটি!
বীজ থেকে তেল নিষ্কাশনের স্থানীয় যন্ত্র দেখালেন, শিলের মত পাটা পাথরের গায়ে খাঁজ কেটে কেটে কীভাবে সে তেল সংগ্রহ করা হত, তা-ও।
এই ছবিতে ডানদিকের জন চন্দ্র গুরুং, আর বাঁদিকে রোগা লম্বা চশমা পরা মানুষটি সাগর।
এখান থেকে আমরা চলে গেলুম রিঞ্চেনপং। ৫৫৭৬ ফুট উঁচু ছবির মতো সুন্দর একটা জায়গা। সবার প্রথমে যাওয়া হল রিসাম মনাস্ট্রিতে।
সবুজ গালচের মত মাঠের একপাশে ছোট্ট রঙচঙে মনাস্ট্রি। ডানদিকের নিচের ধাপের মাঠে লামারা কাচা পোশাক-আশাক শুকোতে দিচ্ছে। বাঁদিকে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়ে ঝিলমিল করছে লম্বা লম্বা পতাকা। মনাস্ট্রি সেদিন বন্ধ ছিল, আমরা তার দেওয়ালে গাঁথে সারি সারি জপযন্ত্র ঘোরাতে ঘোরাতে প্রদক্ষিণ করলুম। শেষে এসে একটা বিরাট বড় প্রেয়ার হুইল,তাতে এমন ব্যবস্থা করা যে এক পাক ঘুরে এলেই একটা লাঠির ধাক্কায় আপনাআপনি ঘন্টা বাজে। এইটে বাপির খুব পছন্দ হয়েছিল।
এর সামনে দাঁড়িয়েই মাটিতে একটা জোঁক দেখা গেল। সেই বিশেষ অদ্ভুত চলন, শরীরের মাঝ থেকে ভাঁজ করে তুলে তুলে।
পরবর্তী গন্তব্য ডাকবাংলো। ছিমছাম সুন্দর ব্রিটিশ আমলের বাড়ি, চারদিকে টানা কাঠের বারান্দা। বাংলোর হাতা জুড়ে নানারকম গাছের বাগান। ভারি পছন্দ হয়েছিল জায়গাটা, কিন্তু থাকা যায় কিনা সে প্রশ্নের উত্তরে চন্দ্র বেজায় হেসে জানাল মোটেই না, এখানে সিকিমের প্রাইম মিনিস্টার এসে থাকেন মাঝে মাঝে।
যাঃ! এজন্মে তো আর সিকিমের প্রাইম মিনিস্টার বা তাঁর গেস্ট হতে পারছি না, কাজেই এমন মনোরম জায়গায় থাকার ইচ্ছেটা বাতিলই করতে হল! দু চারটে ছবি তুলেই মনে খেদ মেটালুম অগত্যা।
এর পর গেলুম রিঞ্চেনপং মনাস্ট্রি। এইটে ভারি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, যদিও এখানেও ভিতরে যাওয়া গেল না। কোভিডের জন্য অনেক বিধিনিষেধ চলছে, বোঝাই যায়।
এইখানে একটা পয়েন্ট আছে, রবীন্দ্র-বন। গীতাঞ্জলির ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ লেখাটি রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে লিখেছিলেন, কথিত। সে মর্মে একটি ফলকও আছে, তাতে এর ইংলিশ তর্জমা খোদাই করা আছে।
বেজায় গর্ব আর সম্ভ্রম মিশিয়ে চন্দ্র আমাদের জায়গাটা দেখাল,সেই সঙ্গে তার জ্ঞানমতো ‘বহোত বড়া পোয়েট’ রবীন্দ্রনাথের কথাও শোনাল। এই সরল মনের স্পষ্ট শ্রদ্ধা – শহুরে সাজানো কথার ভাষণের চেয়ে বেশি জোরালো মনে হচ্ছিল তখন।
এখানের ভিউও অসাধারণ। পাহাড়ের পর পাহাড়ের সারির মধ্যে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে রঙ্গিত নদী, এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে।
ঐ পয়েন্ট থেকে নামার সময়ে চন্দ্র দেখাল, স্থানীয় শ্মশান। তার পাশে এক বাহারী শোর্তেন, স্মৃতিচিহ্ন। এর মধ্যে সোনা, রুপো, ধূপ আর আরও অনেক বহুমূল্য জিনিস ভরে দেওয়া হয়, মৃতের পরিবারের সাধ্যমতো। সবার পক্ষে এ জিনিস বানানো সম্ভব নয়, আর্থিক এবং সামাজিক কৌলিন্য দুই-ই থাকতে হবে।
এইদিন আর দেখলুম ‘পয়জন লেক’। স্থানীয় ভাষায় বিখ-পোখরি। গল্পটা শোনাল চন্দ্র।
ব্রিটিশরা তখন ভারতে আসীন, সিকিমে ক্রমশ তারা আধিপত্য জাহির করছিল। সিকিমের স্বাধীনচেতা লেপচারা সেটা পছন্দ করেনি। এই নিয়ে সিকিমের চোগিয়াল, মানে রাজার সঙ্গে এক সময় ব্রিটিশদের ঝামেলা শুরু হয়। তখন ব্রিটিশদের একমাত্র পানীয় জলের উৎস ছিল এই লেকটা – লেপচারা খেপে গিয়ে স্থানীয় জড়িবুটি থেকে তৈরি কোনও একটা বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল এই লেকে। এর ফলে আদ্ধেকের বেশি ইংরেজ সৈন্য মারা যাবার পর ব্রিটিশরা বাধ্য হয় চোগিয়ালের সঙ্গে রফা করে নিতে।
এই লেকের জল নাকি আজও বিষাক্ত।
কে জানে কী ছিল এই ভয়ানক মারণবিষ! কত যে এমন অজানা জ্ঞান লুকিয়ে রয়েছে ভারতের কোণে কোণে!
কালুক পেরিয়ে ফিরে এলুম, রাস্তার ধারের পুলিশ বুথের মহিলা কনস্টেবল ঝকঝকে হাসিমুখ উপহার দিলেন। ঘরে ফিরলুম যখন পা টনটন, শরীর ক্লান্ত – কিন্তু মন উপচে পড়ছে সৌন্দর্যের আনন্দে।
লেট লাঞ্চের পর আজ আর বিশ্রাম নিলুম না। বেরিয়ে পড়লুম যে যার মতো হাঁটতে। তিতিরের দাদুমণি ঘরের সামনেই রইলেন, দিম্মা গেলেন ক্যামেরা নিয়ে এদিক ওদিক, আর আমরা দুজন হাত ধরে বড়ো বড়ো পায়ে চলে গেলুম বাড়িঘরের সীমানা ছাড়িয়ে সেই রাস্তায়, যার কথা বার্মিক আসার শুরুতেই বলছিলুম। পথে একাধিক উমনো-ঝুমনো চুলের কুকুর দেখা গেল, এবং তিতির তাদের প্রত্যেককে আদর করল – বলা বাহুল্য।
অন্ধকার হয়ে ঘরে ফেরার পর দেখা গেল দিম্মা এনেছেন ভালো ভালো ছবি, আমি এনেছি ছোট্ট দোকান থেকে র্যান্ডমলি কিনে ফেলা একটা বেজায় স্বাদু অপরিচিত কোনও একটা ফলের নেপালী আচার, আর তিতির এনেছে…
সোয়েটার ভর্তি কুকুরের লোম।
না, তিতিরের মা একটুও বকেনি। এই বয়েসটা তো জীবনে একবারই আসে, নাকি?