চলার পথে – ১৫ (cholar pothe – 15)

চলার পথে – ১৫ (cholar pothe – 15)

সিকিম, পর্ব – ৪

 

১১ অক্টোবর, ২০২১

 

ভোরসকালে উঠে দেখি তখনও মেঘ। মনের দুঃখে আবার শুয়ে পড়েছি, ঘুম ভাঙল মায়ের ধাক্কায়। “ওঠ ওঠ” বলতেই বুঝে নিয়েছি কী হয়েছে, তড়াক করে উঠে বসেই দেখি চোখের সামনে সেই অপূর্ব দৃশ্য।

তবে কিনা, সোনা নয়, ঝকঝকে সাদা এখন। স্বাভাবিক, ছটা বাজে।

কতক্ষণ হাঁ করে বসে বসে দেখলুম।

কিন্তু বেরোনোরও তাড়া ছিল। যেহেতু আজ রাত্তিরটাও আমরা বার্মিকেই থাকব, তাই আজকের প্ল্যান সারাদিন ধরে ঘোরার। আজকের গন্তব্য পেলিং।

গতকাল চন্দ্রর বকুনি খেয়ে আজ আমরা গরমাগরম আলু পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেই জলদি জলদি তৈরি হয়ে গেলুম। চন্দ্র আজ বেজায় খুশি-খুশি মেজাজে ছিল। যেতে যেতে গল্প জুড়ল আসন্ন দশেরা আর তার সঙ্গে জড়িত নেপালী রীতিনীতির। নেপালীদের সেদিন কপালে টিকা লাগাতেই হবে, তাও এমনি না, বাড়ির বড়োদের হাত থেকে। চেনা পরিচিত সবার ঘরে গিয়ে গিয়ে এই বড়োদের থেকে তিলক নিতে হবে, আর খেতেও হবে। এলাহী আয়োজন হয়, মাংস মিষ্টি ইত্যাদি আর ছাং – সেদিন কাউকে না বলা যায় না, তাই সর্বত্র অল্প করে হলেও মুখে কিছু দিতেই হয়। ওকে দশ-বারো ঘর যেতে হয় এমন, খেতে খেতে পেট ফেটে যাবার উপক্রম হয়… বলতে বলতে ছেলেমানুষের মতো হাসছিল। আমরাও বললুম আমাদের বিজয়ার প্রথা, অমনই বড়োদের প্রণাম করা আর কোলাকুলি, অমনই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুগনি আর মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজ। কথায় কথায় ভাইফোঁটা/ভাইদুজ এল, সেও দেখি একদম আমাদের মতোই নিয়ম, ফোঁটা পরাবে, মালা দেবে, মিষ্টি খাওয়াবে… তবে হ্যাঁ, যে সে ফুলের মালা নয়, শওপত্তি আর মখমলি-ই চাই। এ দুটো একেবারে আউট অফ সিলেবাস, অনেক কষ্টে বোঝা গেল শওপত্তি হল গাঁদা ( একশো পাপড়ি, এই অর্থে), মখমলি-টা অজানাই রয়ে গেল।

কথায় কথায় বেশ অনেকটা এসে গেছি। দূর থেকে হাত তুলে দেখাল চিয়াভঞ্জন – নেপাল বর্ডার। পাহাড়ে আমাদের চোখে সবই প্রায় একরকম দেখায়, তাই খুব যে ভালো করে কিছু বুঝলুম বা দেখলুম তা নয় – কিন্তু দেখানোর আগ্রহটা ভারি চোখে পড়ল।

এরপর গাড়ি দাঁড়াল ডেন্তাম ভ্যালির ধারে। নিচে উপত্যকায় ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। আমাদের চারজনের একটা একসঙ্গে ছবি উঠল এইখানে।

একটু দাঁড়িয়ে আবার এগিয়ে চললুম। এবার এসে দাঁড়ালুম একটা বিশাল ঝর্ণার নিচে। বিশাল মানে, বিশাল! অঝোরে ঝরছে, জল ছিটকে আসছে রাস্তার উপরে। ছাঙ্গে ফল্‌স্‌।

পাহাড়ের সামনে যদি নিজেদের অকিঞ্চিৎকর মনে হয়, তাহলে ঝর্ণার সামনে এসে মনে হয় বিষাদবিহীন। মনের সব ভার ধুয়ে ভেসে বেরিয়ে যায়, হলই বা তা সাময়িক।

এর পর গেলাম স্কাইওয়াক। সে এক নতুনধারার ব্যাপার। বিরাট এক বুদ্ধমূর্তি, তার সামনে দিয়ে লম্বা চওড়া এক স্কাইওয়াক বানিয়েছে – এর বৈশিষ্ট্য হল, দুধারের দেওয়াল এবং মেঝে সব কাচের তৈরি। ফলে হাঁটার সময়ে খানিকটা সরাসরি আকাশেই হেঁটে বেড়াচ্ছি গোছের ফিলিংস হয়।

(‘মিশন: পৃথিবী’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানবেন, এইরকম একটা সিকোয়েন্স ছিল তাতে ডেমা তাশি আর ইয়েৎসে সোগিয়ালকে নিয়ে। ফলে বেজায় রকম ‘দেজা ভ্যু’ হচ্ছিল এখানে হাঁটতে গিয়ে।)

এরপর আরও একটা ঝর্ণা দেখা হল। রিম্বি নদীর উপর রিম্বি ফল্‌স্‌। সেও রীতিমতো সুন্দর, ভরপুর আর উচ্ছল।

রাস্তার ধারের এক দোকানে লাঞ্চের অর্ডার করে দিয়ে চলে যাওয়া হল খেচোপেরি লেক। এই লেকের ব্যাপারে একাধিক গল্প চলিত আছে, কিন্তু সবেরই মোদ্দা কথা হল এটি অতি পবিত্র জলাশয়। বৌদ্ধগুরু পদ্মসম্ভবের কিছু ধর্মীয় শিক্ষাদানের কথা পাওয়া যায়, আবার কাছাকাছি কোনও এক গুহায় শিবের তপস্যার কথাও শোনা যায়। এমনও বলা হয়, এ লেকের কাকচক্ষু জল নাকি দৈববলে সর্বদা পরিষ্কার থাকে, চারিদিক ঘিরে থাকা সবুজ বনানীর একটা গাছের পাতা জলে খসে পড়লেও কোনও না কোনও পাখি গিয়ে ঠোঁটে করে তা তুলে আনে।

গাড়ি থেকে নেমে বেশ খানিকটা হাঁটা হল। গতকাল চন্দ্র আমাদের হাঁটার শম্বুকগতি,মানে ওদের হিসাবে, দেখে বেশ হেসেছিল। আজ এখানে খুব হিসেব টিসেব করে বলল, আধা ঘন্টা তো লাগবেই তোমাদের।

সে হিসেব খুব ভুল ছিল না, লেক দেখে ফিরে আসতে আসতে এক ঘন্টা পেরিয়ে গেল বটে। রাস্তাটা লম্বা, একটু এবড়ো খেবড়োও।

কিন্তু আসল জায়গায় গিয়ে সে যে কী হতাশ হলুম বলার নয়।  কোথায় অপার্থিব স্বচ্ছ সুন্দর জলাশয়ের দৃশ্য দেখব ভেবে এলুম এতখানি – আর দেখছি গুচ্ছের কাঠ পাথর দিয়ে তৈরি খানিক রেলিং, টিনের ছাত দেওয়া লম্বা ঘেরা গ্যালারি না কি মুণ্ডুমাথা, এদিক দিয়ে তার ঝুলছে, সেদিক দিয়ে লোহার খাম্বা উঠেছে দৃষ্টি আড়াল করে। লেকটা বেশ বড়ো, এই সব মনুষ্যনির্মিত হাবিজাবি উপড়ে তুলে ফেলে দিলে যে আবারও অপার্থিব সুন্দর লাগবে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সে আর কে কাকে বোঝাবে! ঐ টিনে ঢাকা উদ্ভট স্ট্রাকচারে গুঁতোগুঁতি করে গাদা গাদা ট্যুরিস্ট জলের মাছকে সয়াবিনের দানা খাওয়াতে ব্যস্ত। আসার পথে ঠোঙা করে সে দানা বিক্রি হচ্ছিল বটে, এখন মনে পড়ল। সেসব পেরিয়ে শেষ প্রান্তে যাবার চেষ্টা করে দেখা গেল লেক ঢেকে সাদা পর্দা টাঙিয়ে স্থানীয় কয়েকজন ধুপধুনো দিয়ে কীসের পুজো করে যাচ্ছে গম্ভীরভাবে। পুরো লেকটার ছবি তোলার মতো একটাও ভালো জায়গা খুঁজে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলুম।

এই লেক আমি আগে আরেকবার দেখে গেছি, ২০০২ সালে। এসব কিচ্ছু ছিল না তখন, ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে নির্জন টলটলে জলাশয়খানি, সত্যিই কাচের মতো স্বচ্ছ জল – সে সৌন্দর্যের এই দশা হয়েছে দেখে সত্যিই কান্না পেয়ে গেল!

ফিরে এলুম যত তাড়াতাড়ি পারি। খিদেও পেয়ে গেছিল জব্বর ততক্ষণে। কিন্তু এখন খেতে নেমে গেলে কাঞ্চনজংঘা ফল্‌স্‌ মিস হয়ে যাবে, তাই সেটা দেখে নিয়েই যাওয়া স্থির হল।

এইখানে একটা যা মজার ব্যাপার হল না! তিতির তো বেজায় উপভোগ করেছে, আমরাও মজা পেয়েছি। হল কী, দূর থেকে যখন ঝর্ণা দেখা ও শোনা যাচ্ছে, গাড়ি চালাতে চালাতেই চন্দ্র হঠাৎ সমস্ত কাচ তুলে দিল। কেন, বোঝার আগেই দেখি আমরা ফলসের নিচে দাঁড়িয়ে আর গাড়ির উপর ঝরঝর করে অঝোরে জল পড়ছে, সামনের কাচ পুরো ঝাপসা করে জলের ঢেউ খেলছে যেন।

একটু দাঁড়িয়ে থেকে, তারপর ওয়াইপার চালিয়ে সামনের ভিশন সাফ করে আস্তে আস্তে গাড়ি আবার এগোল। আগেকার দিনের বড়ো বাড়ির বৌদের সেই পালকিশুদ্ধু গঙ্গাস্নান করার মতো আমাদেরও গাড়িশুদ্ধু  ঝর্ণায় অবগাহন হয়ে গেল!

এটাও বেজায় সুন্দর ঝর্ণা। এখানে বেশ কিছু ট্যুরিস্ট ছিল, বলা বাহুল্য প্রায় সবাই বাঙালী।

 

অনেকক্ষণ দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু খিদেটাও যে জানান দিচ্ছে! কিছু পরে তাই বাধ্য হয়েই এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে উঠে পড়তে হল গাড়িতে। ফেরার পথে আবারও ন্যাচারাল কার ওয়াশ হল।

সেই অর্ডার করে যাওয়া দোকানে ফিরে এসে, গরম গরম ভাত, ডাল, ডিমের কারি, স্যালাড, পাঁপড় দিয়ে লাঞ্চ সেরে আবার গাড়িতে ওঠা হল।

 

(ক্রমশঃ)

Leave a Comment