চলার পথে – ১৬ (cholar pothe – 16)

চলার পথে – ১৬ (cholar pothe – 16)

সিকিম, পর্ব-৫


 

সারাদিন ধরে পেলিং-এর ধারেকাছে এত রকম দেখেশুনে বেশ একটা ভরপুর আনন্দ মনে জমে উঠেছিল, বুঝলেন। এর পরেও যে আরও কিছু স্পেশাল বাকি আছে, সে একটুও আঁচ করতে পারিনি। চন্দ্র যখন বলল আজ আরও একটা মনাস্ট্রি যাব, সেটা কী  জিজ্ঞাসা করতেও ভুলেছি, সে-ও মনে হয় ইচ্ছে করেই বলেনি।

একদম মনাস্ট্রির সামনে গাড়ি থামিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল, ‘যাইয়ে। পেমিয়াংসি।‘

বলে কী! সিকিমের সবচেয়ে পরিচিত মনাস্ট্রি! ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ পড়া বাঙালির  কাছে তো সুপরিচিত। হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নামা হল সব।

ঢোকার দরজা পিছনদিকে। পাশ বরাবর কারুকার্য দেখতে দেখতে গিয়ে, সেই গেটে উঁকি মারলুম। অমনি ভিতরে প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত এক লামা হাসিমুখে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

জুতো খুলে পা রাখতেই চোখ আর মন একসঙ্গে ধাঁধিয়ে গেল যেন। হলঘরের মতো উপাসনাকক্ষটির দেওয়াল জুড়ে আগাগোড়া ছবি আঁকা। উজ্জ্বল রং, লাল, নীল, হলুদের সঙ্গে সঙ্গে তাতে সোনালী রঙের ছড়াছড়ি। সেই সঙ্গে উপর থেকে ঝুলছে বিশাল বিশাল সব অপূর্ব ছবি আঁকা থাঙ্কা আর গোল চিমনির মত দেখতে নকশা করা কাপড়ের কী যেন। কোথাও চাঁদের আলো, কোথাও ড্রাগন আগুন ঝরাচ্ছে। সব কিন্তু সুন্দর ব্যালান্স করে, জবরজং নয়, স্বর্গীয় একটা দীপ্তিতে ঘরটা ভরিয়ে তুলেছে।

কয়েকটি থাম এবং সিন্দুকের মত দেখতে, গালিচা দিয়ে ঢাকা বসার বড় বড় সীট দিয়ে জায়গাটা তিনভাগে ভাগ করা। সরাসরি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ানো যায় বিরাট গৌতম বুদ্ধর মূর্তির সামনে। তাঁর ডানপাশে একইরকম বড়ো আকারের অবলোকিতেশ্বর মূর্তি, অন্যদিকে রিনপোচে, অর্থাৎ গুরু  পদ্মসম্ভব। এঁদের সামনেই বিরাট পিতলের থালা জুড়ে প্রদীপ জ্বালাচ্ছিলেন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ লামা। আমাদের দেখে হাসলেন, হাত নেড়ে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললেন, আসুন, ঘুরে দেখে যান। শুধু কিছু স্পর্শ করবেন না আর ছবি তুলবেন না।

এ দুটি নিষেধ আগেই দেখেছি অবশ্য।

মুগ্ধ হয়ে দেখছি বুদ্ধমূর্তির সোনালি ঝকঝকে নিটোল রূপ, থামের গড়ন, গালচের শোভা, সিংহাসনের মতো ভারি আর বড়ো কাঠের চেয়ারের কলকা কাটা হাতল… আরেক কমবয়েসী লামা পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে উঠল, ‘উপরেও আছে। রিনপোচের প্রেয়ার হল, মিউজিয়ম…’

‘উপরে? আমরা যেতে পারি?’

একগাল হাসি নিয়ে বলল, ‘যাও না, যাও। দেখে এসো। ঐ সিঁড়ি দিয়ে চলে যাও।‘

আগের বৃদ্ধ লামাও মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘যাও যাও। দিস ভেরি ওল্ড। সিক্সটিন ফরটি সেভেন। দেখে এসো সব।‘

মেয়ে আর মা-কে নিয়ে গুটিগুটি উঠে পড়লুম সিঁড়ি দিয়ে।

পা রাখতেই বুঝলুম এই কাঠের সিঁড়ি মোটেই হালফিলের নয়। যেমন মজবুত পাথরের মত শক্ত, তেমনি মসৃণ মোমের মত পালিশ করা এ সিঁড়ি দিয়ে কত শত বছর ধরে ওঠানামা করেছে মানুষ, কে জানে!

দোতলায় উঠে গুটিকয় দরজা, কোনদিকে যাব বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে আছি সিঁড়ির মাথায়,  বাঁদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল আরেক লামা – বিনীতভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে হাত নেড়ে সেই ঘরে আসতে বলল।

গেলুম।

একপাশে রিনপোচের মুর্তি। বাকি ঘর জুড়ে দেওয়াল ঘেঁষে ছোট ছোট ডেস্ক ও বসার জায়গা। কিছুটাতে চার্চের প্রেয়ার ডেস্কের মতো, তবে অত উঁচু না। এখন সেই সব জায়গায় বসে আছেন বিভিন্ন বয়সের লামারা। কমবয়সীই বেশি। তাদের সবার সামনে নানা রকম বাদ্যযন্ত্র – ড্রাম, শিঙা, ঘন্টা আরও কত কী অজানা ধরণের।

আমরা ঘরে ঢুকছি যখন তখন সেগুলো সমবেতভাবে বেজে উঠল। জোরালো আওয়াজ, প্রথমে একটু চমক লাগে, কিন্তু তারপর বোঝা যায় একটা ধীর লয়ের ছন্দ মেনে কখনও এটা, কখনও ওটা বাজছে, সব মিলিয়ে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো একটা সুর ভরে উঠছে ঘর জুড়ে।

সে সুরের অনুরণন ছড়িয়ে যাচ্ছে পাশের বাগানে, সামনের চত্বরে, নিচের উপত্যকায়। সুরের ধাক্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছে যেন সব গাছপালা, আনন্দে।

কখন এক সময়ে সেই প্রেয়ার থামল। যে লামাটি আমাদের ডেকে এনেছিল, সে-ই উল্টোদিকের আরেকটা দরজা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ঐটে আমাদের লাইব্রেরি।

আহা গো! কী দেখলুম! কী দেখলুম!! ক্যামেরা লাগবে না, সে ছবি আমার মনে চিরকালের মতো তোলা হয়ে রয়েছে। লম্বাটে ঘরটি, ছোট দুটো দেওয়াল জুড়ে সিলিং থেকে আমার কোমর অবধি আগাগোড়া ধ্যানী বুদ্ধের ছবি আঁকা সারি সারি। প্রতিটি ছবি ফুটখানেক লম্বা , অবিকল একরকম, একইরকম নিখুঁত তাদের প্রত্যেকের মুখের ডৌল, কাপড়ের ভাঁজ, চুলের দাগ। খুঁটিয়ে দেখেছি, কোথাও এতটুকু আলাদা পাইনি, যেন কেউ কপি পেস্ট করে গেছে পরপর।

অথচ চারশো তিয়াত্তর বছর পুরোনো এই মনাস্ট্রিতে, সেসব করার প্রশ্নই নেই। এই এত ছবি সব একটি একটি করে মানুষের আঁকা, হাতে আঁকা!

কী অপরিসীম ধৈর্য, কী অতুল নিষ্ঠা!

দরজার বিপরীতে যে লম্বা দেওয়াল, তাতে একটি টানা কাঠের কাজ করা ঝরোখার মত জানলা। সামনের উপত্যকা বহুদূর দেখা যায় সেখান থেকে। জানলার সামনে এক পাশ করে আবার একটি সিন্দুকের মত কিছু, তার উপর কাচের বাক্সে রিনপোচের ছবি। পাশে লেখা পড়ে মনে হল তাঁর ব্যবহৃত কিছু পবিত্র বস্তু রাখা আছে সেখানে।

কিন্তু এগুলো তো ঘরের গৌণ ব্যাপার। মুখ্য যা, মানে লাইব্রেরি?

সে আছে ঘরের চতুর্থ দেওয়াল জুড়ে, দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁ হাতের দেওয়াল বরাবর। লম্বা দেওয়ালের মাঝামাঝি এক কাচে ঢাকা আসনে সোনালী বৃহৎ বুদ্ধমূর্তি, আর তার দুদিক জুড়ে দেওয়াল জোড়া বিরাট কাচের ঢাকা দেওয়া তাক। দুদিকে ৮*১৬টা করে খোপ।

আর সেই তাক জুড়ে আছে পুঁথি। প্রতি খোপে একটা করে। প্রায় দু ফুট বা তারও বেশি লম্বা, চওড়াটা বুঝতে পারিনি ঠিক তবে ইঞ্চি আট-দশ মতো উঁচু  মনে হল, উপরে নিচে কাঠের পাটাতন দেওয়া, লাল রেশমী কাপড় ঢাকা দেওয়া প্রাচীন, হাতে লেখা পুঁথির ভাণ্ডার।

এক একটায় কাপড় সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, পুঁথির ধার বরাবর সোনালী জলের লেখা বা আলপনা।

চোখে দেখা যাচ্ছে তাদের প্রাচীনত্ব, বোঝা যাচ্ছে সে হলদেটে মোটা কাগজগুলো আমাদের চেনা কাগজ কিছু নয়। নেহাৎ ভাষাটাও অচেনা, নইলে আমায় ও ঘর থেকে ধরেবেঁধে বার করতে হত।

কত সাধকের কত দর্শন, কত ভাবনার ফসল, কত গভীর বিশ্বাসের বাণী ধরা রয়েছে ওই একটি ঘরে! ভাবলেও শিহরণ হয়।

ঐ লাইব্রেরিটিতে দাঁড়িয়ে যা যা অনুভব করছিলুম, তা লিখতে গেলে এই পরিসরে কুলোবে না, তাই আপাতত এটুকুই থাক।

সেই লামাটি চলে যায়নি, আমার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছিল দাঁড়িয়ে। সরল কৌতুকমাখা মুখটা দেখে লজ্জা পাওয়ার চেয়েও কৃতজ্ঞ বোধ করলুম ঢের বেশি, ভাগ্যিস এরা এমন আতিথেয়তায় ডেকে দেখাল সব।

তবে এখানেই শেষ নয় কিন্তু। এর পর আরও একতলা সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেলুম তিনতলায়। এখানে একটা মূল কক্ষ, তাতে একটা বিরাট, মানে বিশা-আ-ল বড় রথের মতো জিনিস আছে। চৈত্য সম্ভবত, লেখা বিশেষ কিছু ছিল না, লামাটিও আর সঙ্গে আসেনি যে জিজ্ঞাসা করব।

আগাগোড়া কাঠের তৈরি সেই চৈত্যের গায়ে অজস্র মূর্তি খোদাই করা। কোথাও সাধক ধ্যানে বসেছেন, কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে, কোথাও নৃত্যগীত চলছে, আবার কোথাও বা মুখব্যাদান করে বিকটদর্শন সব যক্ষরক্ষ দানবেরা তাড়া করে আসছে শূন্যে।

অনায়াসে আধ ঘন্টা ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা যায়, এমন সে শিল্প। হায়, ট্যুরিস্টের হাতে সে সময় কই! তাছাড়া, শুধু চৈত্য দেখলে, এ ঘরেরও চারপাশে যে অসামান্য সব ছবিতে ভরা, সে কে দেখবে?

এখানে শুধু বুদ্ধ বা অবলোকিতেশ্বরের ছবি-ই নয়, তাঁদের ঘিরে ঘিরে আরও অসংখ্য সাধারণ মানুষের ছবির মধ্যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অসংখ্য চিত্র ফুটে উঠেছে। কাঠ কাটা, জল বওয়া, ঘাস তোলা, জামা তৈরি, পুঁথি পড়া থেকে জুতো সেলাই – কী নেই সেসব ছবিতে! অজন্তার কথা বড়ো মনে পড়ছিল।

বলা বাহুল্যে এখানেও সব ছবি অতি ডিটেলে, অতি যত্নে আঁকা। হাতের বা কাঁধের কার্ভে তুলির টান কী বলিষ্ঠ, আবার ভ্রূ বা সরু গোঁফে কী সূক্ষ্ম!

আজকের মানুষ এই কুশলী নৈপুণ্যে পৌঁছনোর ধৈর্য, অধ্যাবসায় কবে যে হারিয়ে ফেলল!

এই ঘরটিকে ঘিরে, একটা গোল সুড়ঙ্গের মতো প্যাসেজ, সেই হল মিউজিয়ম। বিশাল বিশাল ধাতব পাত্র, বর্মের মত পোশাক, লামাদের লাল হলুদ পোশাক, কাঠের পুতুল, বাদ্যযন্ত্র, কিছু অস্ত্রও যেন চোখে পড়ল। মৃদুমন্দ আলোয়, রাশি রাশি পুরোনো জিনিসের ভিড়ে আর তাদের মধ্যে মধ্যে জমাট বেঁধে থাকা অন্ধকারে একটা গা ছমছমে ভাব ছেয়ে আছে পুরোটায়। কথা আপনি বন্ধ হয়ে যায়, মনে সম্ভ্রম জেগে ওঠে।

নেমে বেরিয়ে আসার পর পরই শোনা গেল, মেঘ সরে কাঞ্চনজঙ্ঘা আবার দেখা যাচ্ছে নাকি। আমরা সত্যি বলতে কী, খুব একটা আগ্রহী ছিলুম না, কিন্তু চন্দ্র বোঁ করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলল হেলিপ্যাড। বাপি যে মনাস্ট্রির ভিতরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারেনি তাতে ওর মনে দুঃখ হয়েছে, অতএব আঙ্কলকে ও হেলিপ্যাড দেখাবেই – ওখানে প্লেন জায়গা, ওঠানামা নেই, আঙ্কল ‘দিল ভরকে’ দেখতে পারবেন।

কদিনের বা আলাপ! এমন কথা শুনলে মন কেমন করে কিনা বলুন?

দ্যাখ না দ্যাখ পৌঁছে গেলুম। সত্যিই ঝলমল করছে সাদা চূড়া। মুগ্ধ দর্শকদের মধ্যে থেকে শুধুই ‘আহা, আহা’ ভেসে আসছে।

 

 

সেদিনের মতো এখানেই ভ্রমণ শেষ হল। অন্ধকার নামতে নামতে ফিরে এলাম বার্মিক, তৃতীয় ও শেষ রাতটি কাটাতে।

(ক্রমশঃ)

Leave a Comment