চলার পথে – ১৭ (cholar pothe -17)
সিকিম, পর্ব-৬
১২ অক্টোবর, ২০২১
অবশেষে এটাও হল আজ। সকালে উঠেই দেখা গেল, আকাশের গায়ে সোনা জমাট বেঁধে রয়েছে। জানলা খুলে, খাটে কম্বল জড়িয়ে বসে কতক্ষণ যে সে দৃশ্য, রং পালটে সাদা হয়ে আসা অবধি, দেখলুম!
আজ এখান থেকে বেরিয়ে পড়ব আমরা। ব্যাগ গুছোনো, ব্রেকফাস্ট সারা, রেডি হওয়া। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মেরে তখনও স্পষ্ট হয়ে জেগে থাকা কাঞ্চন দেখা।
চন্দ্র এসে হাজির হল, মালপত্তর নিয়ে রওনা দেওয়া গেল, তাড়াতাড়িই।
গতকালের দুটি জিনিস লিখতে ভুলেছি, এখন বলে নিই।
এক হল, পরশু রাত্রে দেখা গেল, আমাদের যা যা লাগতে পারে যথাসর্বস্ব ওষুধ আনা সত্ত্বেও বাপির একটা বিশেষ ওষুধ – যা অবশ্য বহুকাল দরকার হয়নি – আনা হয়নি। সেটা, পাহাড়ি জায়গায়, ঠাণ্ডায় এখন একটু দরকার হয়ে পড়েছে।
হোম স্টের মালিক স্বরূপবাবুকে ফোন করে যা জানা গেল, তাতে প্রায় মাথায় হাত। এই ছোট্ট গ্রামে কোনও ওষুধের দোকান তো নেই-ই, ধারেকাছেও কিছু নেই। একমাত্র উপায় পরদিন পেলিং যাবার পথে খোঁজ করা।
চন্দ্রকে বলে রাস্তায় খোঁজ করতে করতেই যাওয়া হচ্ছিল। নেই, কোথাও ওষুধের দোকান বলে কিছু নেই। সাধারণ সর্দি কাশি জ্বরের ওষুধ যদি বা মুদির দোকানে পাওয়া যায়, তার বাইরে আর কিছু পাবার কোনওই চান্স নেই।
আমরা যত টেনশনে, চন্দ্র তার চেয়েও বেশি। রিম্বি ফলসের পরই গাড়ি নিয়ে এক জায়গায় দাঁড় করাল, সেখানে নাকি সরকারী ডিস্পেন্সারি আছে – যদি খোলা থাকে, যদি পাওয়া যায়!
নেমে আশপাশের লোককে জিজ্ঞাসা করতেই একজন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের ফোনে ফোন করে কনফার্ম করে দিল, খোলা আছে, সিস্টার আছে এখন। তাদের দেখিয়ে দেওয়া রাস্তা ধরে গেলুম সেই ডিস্পেন্সারি। গাড়ি চলার রাস্তা থেকে উঁচু উঁচু গোটা চল্লিশ সিঁড়ি ভেঙে এক ছোট্ট চাতাল, সাইনবোর্ডে মেডিক্যাল লেখা টিনের ঘর। ঘরের সামনে চাতালে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে দুই কর্মঠ দেখতে মহিলা সাদা পোশাকে। বুঝলুম এঁরাই সিস্টার।
বললুম সব। মাথা নাড়িয়ে বললেন, এটা তো নেই। এখানে সরকারের দেওয়া কমন ওষুধপত্র শুধু থাকে, তাতে এসব নেই। নিচের হাসপাতালে গিয়ে দেখতে হবে, ওখানে পাওয়া যাওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে সেম কম্পোজিশনের অলটারনেট ওষুধের নামও বলে দিলেন, যেটা পাওয়ার চান্স বেশি।
সে হাসপাতাল আবার পুরোই উলটো দিকে, অন্য রাস্তায়। হেলিপ্যাড থেকে বেরোনোর পর চন্দ্র চলল গাড়ি নিয়ে সেই দোকানের খোঁজে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, হেডলাইট জ্বালিয়ে সেই অন্য দিকের রাস্তায় কতদূর গিয়ে ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম অবশেষে। ঝিমঝিম করছে অন্ধকার। আশপাশের সব দোকান শাটার নামিয়ে বন্ধ করে ফেলেছে। এইটিতে টিমটিমে আলোয় এক ভদ্রলোক ঝিমোচ্ছেন।
কপাল ভালো, বলামাত্র সেই ওষুধই বার করে দিতে পারলেন। নিশ্চিন্তমনে বাড়ি ফেরা গেল তারপর।
না, এই বাড়তি ঘোরাঘুরির জন্য চন্দ্র এক পয়সাও এক্সট্রা নেয়নি।
আর অন্য ব্যাপারটা হল, সেই যে নেপালী আচার কিনেছিলুম? নাম না জানা ফলের?
সে যে কী প্রচণ্ড ভালো খেতে কী বলব! খুলে একটু টেস্ট করতে গিয়ে, এক সন্ধ্যায়ই মা আর আমি মিলে পুরোটা খেয়ে ফেলেছিলুম। বাপি এসব অচেনা খাবার দাবার ছুঁয়ে দেখে না বিশেষ, আর তিতিরের পক্ষে একটু বেশি মশলাদার ঝাল – ফলে আমার আর মায়ের ভাগে বেশি বেশি পড়েছিল। আমরা যে তাতে বেজায় খুশি হয়েছিলুম, বলা বাহুল্য!
গতকাল ফিরেই আমি বোঁ করে ছুটলুম সেই দোকানের সন্ধানে। সঙ্গে তিতিরকেও নিয়ে গেছিলুম, কারণ আমার সব দোকানই প্রায় একরকম লাগছে আর সব দোকানদারেরই সেই এক ভাঁজ পড়া চোখ আর কালো জ্যাকেট আর একগাল হাসি মনে হচ্ছিল। দুজনে মিলে শেষমেশ দোকানটা স্পট করতে পারলুম, ঢুকেই ঝুলন্ত আচারটা দেখিয়ে বললুম, এইটে কাল নিয়ে গেছিলুম না?
দোকানদার হ্যাঁ বলতেই বললুম, এরকম যত প্যাকেট আছে সব দিয়ে দাও।
বেচারা জীবনে নির্ঘাৎ এমন খ্যাপা খদ্দের দেখেনি, নিজের ভাষায় কী সব বলে হেসে উঠল, তাতে পাশের দোকানের মহিলা, সামনের রাস্তায় দাঁড়ানো ছোকরা সবাই এসে আমাদের দেখতে লাগল। হাবেভাবে বুঝলুম ওদের আচার আমাদের পছন্দ হয়েছে বলে ওরা বেজায় সন্তুষ্ট হয়েছে।
কিন্তু খুঁজেপেতে মোটে দু প্যাকেট পাওয়া গেল। তাই নিলুম, সঙ্গে আরেকটা অন্য রকম আচার দেখাল, সেটাও নিয়ে নিলুম দু প্যাকেট। তারপর মেয়ে বলল, ‘স্প্রাইট!’ – অতএব তাও নিলুম একটা। দাম টাম দিয়ে, আচারগুলো ব্যাগে ভরে দুজনে হাত দোলাতে দোলাতে ঘরে ফিরে এলুম।
ফিরে এসে সবে জুতোটা খুলেছি – উফ সারাদিন গাড়িতে বসে বসে পায়ে কী ব্যথা গো – কন্যা আবার ভারি মোলায়েম গলায় বলল, ‘স্প্রাইট?’
আমি এদিক দেখলুম, ওদিক দেখলুম। তারপর টের পেলুম বোতল দোকানেই রয়ে গেছে।
আবার জুতো পরে, হনহন করে গিয়ে উদয় হলুম দোকানে। দোকানী প্রথমে আরও আচার চাইতে এসেছি ভেবে আঁতকে উঠেছিল, তারপর যেই বলেছি স্প্রাইট ভুলে গেছি… অমনি তার, পাশের মহিলার এবং সেই অজ্ঞাতকুলশীল ছোকরার – হ্যাঁ, সে তখনও ওখানেই ফ্যা ফ্যা করে বেড়াচ্ছিল – হি-হি করে সে কী হাসি!
বোতল বগলদাবা করে পালিয়ে আসতে আসতে বুঝলুম, এদের বাড়ির ছানাপোনারা আজ এক আচারখেকো ভুলো মহিলার গল্প শুনবে রাত্রে।
যাক, এদ্দিন ছিলুম পশ্চিম সিকিমে, আজ চলেছি দক্ষিণ সিকিমের দিকে। যেতে যেতে কত যে টুকরো টুকরো গল্প হল চন্দ্রর সঙ্গে। ওর বাড়ির কথা, তিতিরের চেয়ে অল্প ছোট ছেলের কথা, কলকাতা তো দূরস্থান, শহর শিলিগুড়ি গেলেও ওর কেমন হাঁপ ধরে যায় আর রাস্তা গুলিয়ে যায় সেসব কথা…
রাস্তার ধারে ধারে যত্রতত্র ঝাড় বেঁধে নানা রঙের কসমস ফুটে আছে। দেখিয়ে বললুম, আমাদের বাড়িতেও শীতে হয় এ ফুল, টবে। আমার খুব প্রিয়। তবে এদ্দিন শুধু পিঙ্ক, ভায়োলেট আর সাদাই দেখেছি।
চন্দ্র হেসে বলল, নেপালীরা এ ফুলকে কী বলে জানেন? বলে ‘আই লাভ ইউ’ ফুল।
অ্যাঁ! সে আবার কী?
বুঝলেন না তো? ওই যে, ফুলটার আটটা পাপড়ি! আর ‘আই লাভ ইউ’তে আটটা লেটার! তাই। ছেলেছোকরাদের কাণ্ড, বুঝলেন না!
গুনে দেখি, সত্যিই তো আটটা পাপড়ি! মজার ব্যাপার বটে।
পথে যেতে যেতেই দূর থেকে দেখা গেল মেগিটাড়া মনাস্ট্রি। লেগশিক ভ্যালি। পাহাড়ের খাঁজে অনেক দূরে ইয়ুকসাম।
‘ইয়ুকসাম মানে কী ভাই?’
নেপালীতে ইয়ুক মানে লামা, আর সাম মানে তিন। তিনজন লামা মিলে, অনেক অনেক বছর আগে ওখান থেকে সিকিম শাসন করতেন। সিকিমের আদি রাজধানী বলা যায়।
পথে রেশি বলে একটা জায়গায় একটু থামা হয়েছিল। চায়ের ব্রেক। ছোট্ট জায়গা। কয়েক ঘর দোকান। একটা মাত্র চায়ের দোকান। বয়ামে খটখটে বেক করা গজার মত বিস্কুট। শোকেসে শোনপাপড়ি, লাড্ডু। নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চে বসে, নীল কাপে লাল চা। ঐ বিস্কুট একটা করে। মেয়ের জন্য শোনপাপড়ি এক বাক্স। দোকানদারের চোখমুখ বলে দিচ্ছে সে স্থানীয় নয়, জিজ্ঞাসা করতে জানা গেল তারা আদতে বিহারের, কিন্তু দাদাজীর আমল থেকে তারা এখানে আছে, সে নিজে এখানেই জন্মেছে বড়ো হয়েছে।
ফুঁ দিয়ে দিয়ে ধোঁয়া ওঠা চা খেয়ে শেষ করে গাড়িতে উঠে বসি আবার। গাড়িও এর মধ্যে জল খেয়ে নিয়েছে।
<ক্রমশঃ>
Sangita Bhattacharya
November 9, 2021 - 2:41 pm ·দারুণ