চলার পথে – ১৮ (cholar-pothe-18)

সিকিম, পর্ব – ৭
কত উঁচু নিচু রাস্তা পেরিয়ে চলছে গাড়ি। জঙ্গল ঝুঁকে পড়েছে মাথার উপর। এদিকটায় দেখি রাস্তা অত ভালো নয় – চন্দ্র জানায় ছিল ভালোই, কিন্তু রিসেন্ট বৃষ্টিতে সব ভেঙেচুরে গেছে। এ রাস্তায় বড়ো গাড়ি আসতে পারবে না, এত সরু। ওয়াগনার বা অমন ছোটো গাড়িই ভরসা। একেক জায়গায় রাস্তা এত সরু, বা এত ভাঙাচোরা, এত বিশাল বিশাল গাড্ডা – দেখে বুক ধুকপুক করে। চন্দ্র নির্বিকার ভাবে আস্তে আস্তে ফার্স্ট গিয়ারে চালিয়ে সেসব জায়গা পেরিয়ে যায়, মুখে আশ্বাস দেয় যত খারাপ দেখতে লাগছে অতটাও নয়…।
রেশি পেরিয়ে একটা পাহাড় কেটে লম্বা টানেল পেয়েছিলুম বলেছি কি? বেশ বড়ো, ভিতরে অন্ধকার। চন্দ্র দেখাল, পাহাড় কেটে কেটে রেললাইন বানানোর কাজ চলছে, শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি ট্রেন আসবে সেসব হয়ে গেলে।
মনটা খারাপ হল। ট্রেন আসবে, ট্যুরিস্ট আসবে, হোটেলের পর হোটেল গজাবে পাহাড় কেটে কেটে। এই নিরিবিলি নিভৃতির সৌন্দর্য ঘুচে গিয়ে ঘিঞ্জি শহর ছেয়ে ফেলবে চারদিক।
কী মনে পড়ল? লবটুলিয়া, নাঢ়া বইহার। আহা, যে বয়সে পড়েছিলুম, সে বেদনা তখন বোঝার বয়স ছিল না। আজ বুঝছি।
চটকা ভাঙে চন্দ্রর কথায়। পাশের এক সরু রাস্তা দেখিয়ে বলে, এইখান দিয়ে নেমে গেলে গরম জলের ঝোরা আছে। আমরা বলি তাতপানি। ঐখানের জলে স্নান করলে সব ব্যথা বেদনা অ্যালার্জি হাঁপের টান সব সেরে যায়।
পড়েছি তো এমন সব ন্যাচারাল হট ওয়াটার স্প্রিং-এর কথা লীলা মজুমদারের লেখায়। পাথরের খাঁজে খোঁজে ওষুধের গন্ধ মাখা জল বগ-বগ করে ফোটে। পাহাড়িরা ওতে কাপড়ের পুঁটলি বেঁধে আলু সেদ্ধ করে কিনা সেটা আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি যদিও।
রাবাংলা হয়েই আমাদের যাওয়ার রাস্তা। কথামতো, রাবাংলা বুদ্ধ পার্কে এসে দাঁড়াল গাড়ি। বিশাল বুদ্ধমূর্তি, রাত্রে নাকি পুরো সোনার মতো জ্বলজ্বল করে। সামনে সুন্দর সাজানো ঘন সবুজ বাগান, পিছনে আদিগন্ত খোলা নীল আকাশ। অপরূপ সুন্দর।
তারপর আরও অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এসে পৌঁছলুম বোরং গ্রামে, মঞ্জিলের হোম স্টেতে। আগামী দু রাত্রের আস্তানা আমাদের।
রাস্তার পাশে দোতলা বাড়ি মঞ্জিলদের, তার লাগোয়া দুটো ঘর মুখোমুখি আমাদের জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। একদম নতুন হোম স্টে, এক বছরও হয়নি চালু হয়েছে।
কাঠের মেঝে, কার্পেট পাতা। একফালি করে বারান্দা।
কিন্তু এদিকে মঞ্জিল বা তার বাবা মা কেউ নেই হাজির। মঞ্জিলের মা কী যেন কাজে গেছে, আর মঞ্জিল গেছে শিলিগুড়ি। যারা আছে, সেই কাকা এবং কাকার ছেলে কেউই বিশেষ রান্নাবান্না জানে না, ফলে আমাদের কী খেতে দেবে তা নিয়ে অথৈ জলে পড়ে গেছে।
কিন্তু আমাদের যে পেটে আগুন জ্বলছে! ও কাকা, ও কাকার ছেলে, ও মঞ্জিল!
মা তখন বুদ্ধি দিল, চাল ডাল সবজি নুন হলুদ দিয়ে খিচুড়ির মত কিছু একটা বসিয়ে দিক, আর সঙ্গে ডিমের ওমলেট। প্রেশার কুকার তো আছে, ওতেই দিব্যি হবে। কাকা এই পরামর্শে বেজায় খুশি হয়ে এত্ত বড়ো করে ঘাড় নেড়ে চলে গেল রান্না করতে।
এইখান থেকে চন্দ্রকে বিদায় জানাতে হল। বাকি রাস্তা অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করবে মঞ্জিল।
ফ্রেশ হয়ে খেতে গিয়ে দেখা গেল, হয়েছে তো দিব্যি, খালি বেচারা ডাল দিতে হয় বোঝেনি, নয় ভুলে গেছে। ফলে খিচুড়ি না হয়ে একটা মাখো মাখো পোলাও গোছের হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা। ওমলেট ছাড়াও পাঁপড় ভেজেছে, বড়ো বড়ো চাকা করে পাহাড়ি শসা কেটেছে – তার এক একটার ব্যাসই হবে দু ইঞ্চি – আর ছোট্ট বাটি করে দিয়েছে ডল্লে খোরসানি, ঝালস্য ঝাল লঙ্কা। কানা উঁচু চকচকে কাঁসার থালা বাটি সাজিয়ে রাখা, কাচের গ্লাসে হালকা গরম জল – পাহাড়ের লোকেরা কেউ ঠাণ্ডা জল খায় না দেখি।
খিদের মুখে সে যে কী অমৃত!
খেয়ে উঠে, ঘরের পাশের রোদ-ছায়া বারান্দায় গিয়ে দেখি তাতে একটা ইজি চেয়ার পাতা আর সামনে ১৮০ ডিগ্রি খোলা সবুজ ভ্যালি। একদিকে এদের কাঠ রাখার টিনের শেড। অন্যদিকে মুরগির ঘর- মুরগিগুলো খুঁটে বেড়াচ্ছে, মোরগটা মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটে ডাকছে। কীসব পোকা ডাকছে ক্রুর্রররররর করে খুব মিহি গলায়।
একটা এই জায়গার উপযুক্ত বইও পেয়ে গেলুম খাটের পাশের টেবিলে রাখা।
মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, আমি রোদ ঢলে না আসা অবধি বই হাতে ওখানেই বসে রইলুম।
বিকেলে হাঁটতে বেরোলুম সবাই, যে যার মতো। তিতির আর আমি রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলুম হোম স্টে পিছনে ফেলে।
কী ছোট্ট জায়গা। সব শুদ্ধু বারো-চোদ্দটা বাড়ি হয় কি না হয়। একটা ডেয়ারি, তার সামনে রাশি রাশি দুধের ক্যান। আরেকটা হোম স্টে আছে এখানে, ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার লজ। এটাই বেশি পরিচিত, সুন্দরও বেশি। কিন্তু এখানে থাকার ঘর খাবার জায়গা সবই পাহাড় বেয়ে বেশ খানিকটা নিচে নেমে উঠে – যেটা বাপির পক্ষে সম্ভব হত না। তবে না থাকলেও, গিয়ে ঘুরে বেড়াতে কোনও বাধা নেই। এমনিতেও, আমরা ছাড়া কোনও ট্যুরিস্ট নেই আপাতত কোথাওই। আমরা নেমে ফুল দেখে, দৃশ্য দেখে খুশি মনে চলে এলুম।
আরও খানিকটা হেঁটে, সূর্য ডোবার তোড়জোড় করছে দেখে ফিরে এলুম সেদিনের মতো। ফেরার পথে পেয়ে গেলুম এই দৃশ্য।
তিতির বলেছে ডগি, আমি বলেছি ড্রাগন। আপনার কী মনে হচ্ছে মেঘটা দেখে?
{ক্রমশঃ}