চলার পথে – ১৯ (cholar-pothe-19)

সিকিম, পর্ব-৮
১৩ অক্টোবর, ২০২১
বার্মিকের হোম স্টে চালানো স্বরূপবাবু নিখাদ বাঙালী, ফলে সেখানে এদ্দিন দিব্যি লুচি-ছোলার ডাল, রুই মাছের কালিয়া বা আলু কপির ডালনা গোছের সব বাঙালী রান্নাই খাচ্ছিলুম। এই বোরং-এ এসে প্রথম নেপালী রান্না পাওয়া গেল। মঞ্জিল তখনও ফেরেনি, কিন্তু তার মা ফিরে এসেছেন সন্ধ্যায়। ফলে রাত্রে কুট্টি কুট্টি পিস করা মুর্গা কারি যেটা পেলাম, তার স্বাদ এক্কেবারে অন্যরকম আর দুর্দান্ত ভালো। বড়ো রান্নাঘরের একপাশেই টেবিল আর নিচু ডিভান দিয়ে বড়োসড়ো খাবার জায়গা, আমরা খেতে বসলে পরিবারের আরও অনেকে কেউ এসে পাশে বসছে, কেউ বা তদারকি করে যাচ্ছে, কেউ আবার তিতিরকে ঠাট্টা করে ঝাল লঙ্কা খাওয়াতে চাইছে, হেসে কুটিপাটি হচ্ছে সবাই মিলে তারপর… নরম হলুদ আলো, পাশে টানা দেওয়ালজোড়া ক্যাবিনেটে ঝকঝকে বাসনকোসন। ঘরোয়া, সুন্দর আতিথেয়তা।
ডিনারের সময়ে আরও একজন তদারক করতে আসছিল বার বার। পোষা বাদামী লোমশ কুকুরটি।
পরদিন অ্যালার্ম দিয়ে ভোরে উঠে দেখলাম পরিষ্কার আকাশ, এখান থেকে অন্য একটা অ্যাঙ্গলে কাঙনজঙ্ঘার চূড়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বারান্দা, বাইরের চাতাল, রাস্তা, রাস্তা ধরে খানিক এগিয়ে গিয়েও দেখি, গাছপালার একটু না একটু আড়াল এসে যাচ্ছে, ঠিক ফ্রেমটা হচ্ছে না। এদিকে ততক্ষণে আলো ফুটে গেল। কাজেই এইতেই সন্তুষ্ট হতে হল।
এদিকে, যে মেয়েকে বেলা সাতটায়ও ডেকে ডেকে তুলতে মাথা খারাপ হয়ে যায় এমনিতে, সে আজ ছটায় উঠে পড়েছে। ‘মা, চলো, চলো, ডগিকে বিস্কুট দিতে হবে!’
কালকে গোটা পাঁচ ছয় ডগি পেয়েছে সে হাঁটার পথে, মনে পড়ল বলেছিলুম বটে সকালে এসে তাদের বিস্কুট খাওয়াব। কিন্তু, ইয়ে, বিস্কুট? সে কই?
চিজ বা ক্রিম দেওয়া বিস্কুট তো চলবে না, তাই রেশি থেকে সেই যে খটখটে প্যাঁচ দেওয়া বিস্কুট কিনেছিলুম, তা মায়ের ফিরে এসে চা দিয়ে খাবার জন্য একটা ফেলে রেখে বাকি প্যাকেটটাই কোটের পকেটস্থ করলুম। কিন্তু দাঁড়াও বাপু, অমন সকালে উঠে বেরোলেই হল? এবাড়ির আন্টি (ভদ্রমহিলা না বলা অবধি আমরা ওঁর বয়স বুঝতে পারিনি, ফলে তিতির আন্টিই ডাকছে) আমার আর বাপির চা এবং বেবির জন্য বাহারি কাঁসার বাটি চামচে দুধ-কর্নফ্লেক্স নিয়ে এসে হাজির যে! নাকি তাঁর মেয়ের ছোটোবেলার জিনিস সেসব, সে মেয়ে এখন বাঙ্গালোরে কলেজে পড়ছে।
কয়েক মিনিটে সেসব ফিনিশ করে চল, চল! হনহন করে রাস্তা পেরিয়ে সেই তেমাথায়। এখানে রাস্তা থেকে একটা একটু নিরেস পথ উঠে গেছে উপরে, বোরং মনাস্ট্রির দিকে। গ্রামের সীমানাই বলা যায়, এর পর আর বাড়িঘর দেখি না। আমরা সেখানে আসতেই তারা সব এসে গেল – কালো আর বাদামি মেশানো দুই হাস্কি, একটা বেঁটে সাদা কোঁকড়া লোমের কুকুর, একটা রাগী গোছের দূরত্ব রাখা কালো ডগি আর একটা বেজায় ভীতু কাঁদো কাঁদো মুখের বাদামী কুকুর, এটা সেই ডেয়ারি থেকে সঙ্গ নিয়েছে। তাছাড়া বাড়ির জনটি তো আছেই সারা রাস্তা পাহারা দিয়ে দিয়ে।
এতজনের সামনে ঐ এক প্যাকেট আর কতটুকুই বা। তবু তিতির ছোটো ছোটো টুকরো করে করে যতক্ষণ পারে চালাল। তারপর ল্যাজ নেড়ে, আর গায়ে হাত বুলিয়ে – আহা তিতির কেন ল্যাজ নাড়বে, কী করেই বা নাড়বে, ওটা ডগিরা করছিল, তিতির খালি হাত বুলিয়েছে – আরও কতক্ষণ খেলা হল।
ব্রেকফাস্টে আজ ম্যাগি হল। পাহাড়ে এসে একবার অন্তত ম্যাগি না খেলে মনে হয় না, কী যেন বাদ গেল? ঝিরিঝিরি করে কাটা গাজর আর বাঁধাকপি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা ম্যাগি এত্ত বড় বাটিতে। আরেক কাপ চা। দিল খুশ হয়ে গেল খেয়ে।
ইতিমধ্যে মঞ্জিল কাল অনেক রাতে এসে পৌঁছেছে, সকালে এসে দেখা করে গাড়িটাড়ি নিয়ে কথা বলে গেছে। সেইমতো নটায় এক গাড়ি আর ড্রাইভার এসে দাঁড়াল, লোকাল সাইটসিয়িং-এর জন্য।
গাড়ি চলল হোম স্টে পিছনে ফেলে। সেই তেমাথা পেরিয়ে গেলুম। নিরিবিলি গাছে ঢাকা রাস্তা। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল এক লম্বা ব্রিজের সামনে। হ্যাঙ্গিং ব্রিজ বা বার্মিলি ব্রিজ – অনেক নিচে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে বয়ে চলেছে বার্মিলি নদী। এত উপর থেকেও তার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ভারি সুন্দর ব্রিজটি। হেঁটে পেরোলাম আমরা। দুধারের রেলিং আর তারের ফাঁকে সিগনেচার স্পাইডারদের বড়ো বড়ো জাল, তাতে রোদ পড়ে চিকমিক করছে নকশা। আমরা ছাড়া কোথাও কেউ নেই, বার্মিলির লাফঝাঁপের শব্দ ছাড়া কিচ্ছু নেই।
এসব জায়গা ঘুরে ফিরে আসার অনেক পরেও, আরেকটা আমি গায়ে সোয়েটারটা আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে একা একা হেঁটে যায়, যেতেই থাকে… অনেক বছর পরে যদি আবার এখানে ফিরে আসি, হয়তো সে হাসিমুখে পাশে এসে দাঁড়াবে আবার।
এবার মনাস্ট্রি দেখব। রালং মনাস্ট্রি। এটি আবার দুটো আছে – পুরোনো আর নতুন। আমরা প্রথমে গেলুম পুরোনোটা পার হয়ে কিছুটা উপরে উঠে নতুনটায়। এটা তৈরি হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানো সুন্দর মনাস্ট্রি, কিন্তু দুঃখের বিষয় কোভিডের কারণে এখন ভিতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
আমরা আশপাশে ঘুরে দেখলুম খানিকক্ষণ, কয়েকজন লামা মিলে রাস্তা সারাই করছেন, ঠুকছেন ভাঙছেন কীসব, আরেকজন একটা ছোট্ট কুকুরছানার সঙ্গে খেলা করছেন। রোদ উঠেছে ভালোই, প্রাচীরের গায়ে সারি সারি জপযন্ত্রগুলোর রং ঝলমল করছে। এক জায়গায় বেশ কিছু শিলালিপি, কিন্তু কেউ নেই যে জিজ্ঞাসা করব সে নিয়ে।
আরেকটু এগোতেই জোরালো বাজনার আওয়াজ ভেসে এল মনাস্ট্রির ভিতর থেকে,সেই সঙ্গে সমবেত মন্ত্রপাঠ। লামাদের প্রেয়ার চলছে।
(ক্রমশঃ)