চলার পথে – ২০ (cholar pothe – 20)

চলার পথে – ২০ (cholar pothe – 20)

সিকিম , পর্ব- ৯

নতুন রালং মনাস্ট্রিতে ঢুকতে না পেরে মনটা একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, মিথ্যা বলব না। সেই পেমিয়াংসি দেখে অবধি আশাটা অন্যরকম হয়ে গেছে কিনা! স্বল্পবাক ড্রাইভার কী বুঝলেন কী জানি, পুরোনো মনাস্ট্রিতে ঢুকে দুই বাচ্চা লামাকে ডেকে কথা বলে কনফার্ম করলেন যে এটা খোলা আছে, যাওয়া যাবে। তারপর ওদেরকেই বললেন গাইড করে দেখিয়ে দিতে।


ছোট্ট দুই ছেলে, একজন লাজুক, তার বছর সাত-আট হবে, অন্যটি একেবারেই কচি, বছর ছয় হবে কিনা সন্দেহ – কিন্তু সে কী বিজ্ঞের মতো হাবভাব! হিন্দি খুবই কম জানে, তাই ভুরু কুঁচকে মাথা নেড়ে হাত দেখিয়ে আমাদের উপর আদেশ নির্দেশ চলল তার। এদিকে উৎসাহও খুব, একটু দাঁড়িয়ে পড়লেই কোমরে হাত দিয়ে অসহিষ্ণু মাথা ঝাঁকুনি, এসো এসো!
বাবা রে, তোরা একে ছানা, তায় এখানের মানুষ। তুরতুর করে হাঁটিস, চোখের পলকে চড়াই পেরোস। আমরা একে সমতলের ল্যাগব্যাগে মানুষ, তায় এতক্ষণ গাড়িতে বসে বসে হাঁটু জ্যাম হয়ে গেছে, আমরা বুঝি অমন পারি?
কিচ্ছু বোঝে না, খিলখিল করে হাসে খালি দুটিতে বলার ধরণে।

 

 

নিচে সেরকমই একটা হল, যদিও আকার আয়তন আর সাজগোজে অনেকটাই কম পেমিয়াংশির তুলনায়। সোনালী বুদ্ধের মূর্তি, থালায় ভরা প্রদীপ এখানেও। ধূপের সুগন্ধ, থাঙ্কা, সেইসব গালচে ঢাকা বসার জায়গা।
খুঁটিয়ে দেখছি বলে ভারি মজা পায় গাইডেরা। কার ছবি?
“কর্মাপা।“
আচ্ছা। কোন কর্মাপা?
সে জানে না বেচারারা, অথবা আমার প্রশ্ন বোঝেনি। অথবা হয়তো হিন্দিতে বারো নম্বর কর্মাপা কীভাবে বলবে ভেবে পায়নি।
এই কর্মাপা-র গল্পটা বেশ। বলি?
তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের মূলতঃ চারটে শাখা আছে – নেইংমা (Nyingma), কাজ্যু (Kagyu), সাক্য (Sakya) আর গেলুক (Gelug)। নেইংমা মানে পুরাতন, এটি বজ্রযানী গুরু পদ্মসম্ভবের সৃষ্টি তিব্বতের সর্বপ্রাচীন ধারা। সাক্য ধারা একাদশ শতকের, তিব্বতী ভাষায় সাক্য মানে ধূসর পৃথিবী, অনেকটাই বৌদ্ধ তন্ত্র বিজড়িত। চতুর্দশ শতকে উদ্ভূত গেলুক ধারা অনেকাংশে মূল নেইংমা মতের সঙ্গে বাঙালী বৌদ্ধ মহাশ্রমণ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের শিক্ষাধারা অনুসারী তিব্বতী কদম ঘরানার মিশ্রণ।
আমরা যেটার কথায় আসছি, সেই কাজ্যুর আক্ষরিক অর্থ হল মৌখিক ভাবে চলে আসা ধারা। এর আবার আটটি উপধারা আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধান হল কর্মা কাজ্যু। এঁদের সর্বপ্রধান পুরোহিত, আধ্যাত্মিক নেতাকে বলা হয় ‘কর্মাপা’। এটি এই পদের নাম, প্রথম কর্মাপা-র পর একে একে অনেক নেতাই এই পদে আসীন হয়েছেন, বর্তমানে সতেরোতম কর্মাপা-র যুগ চলছে। তিব্বতের তোলুং উপত্যকার সুরফু মনাস্ট্রি ছিল কর্মাপার আদি অধিষ্ঠানক্ষেত্র, তিব্বত থেকে চলে আসতে বাধ্য হবার ফলে এখন সিকিমের রুমটেক (গ্যাংটকে গণ্ডগোল মনে পড়ছে?) মনাস্ট্রিতে এখনকার কর্মাপা-রা থাকেন।
অনেকটা সরে এসেছি, আবার রালং গুম্ফার গল্পে ফিরে যাই। সিকিমের চতুর্থ রাজা, চোগিয়াল নামগিয়াল একবার মনের দুঃখে (রাজারাজড়াদের মনে কি আর দুঃখ থাকে না? বাঘা গুপির গানে তাল মিলিয়ে কী বলেছিল ভাবুন, ‘তারই বেশি হয়!’) রাজবেশ ছেড়ে সাধারণ বৌদ্ধ পরিব্রাজকের পোশাকে তিব্বত রওনা দিয়েছিলেন। কেউ তাঁকে কোথাও চিনতে পারেনি, কিন্তু দ্বাদশ কর্মাপার সামনে আসামাত্র তিনি রাজাকে চিনে ফেলেন ও রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করেন। মুগ্ধ রাজা খুবই অপ্রস্তুত ও বিব্রত হয়ে পড়েন, কারণ তাঁর সঙ্গে প্রতি-সম্মান জানানোর উপযুক্ত কিছুই ছিল না। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, দেশে ফিরে কর্মা কাজ্যুর সন্ন্যাসীদের জন্য একটা মঠ বানিয়ে দেবেন। ১৭৩০ সালে তৈরি এই পুরোনো রালং মনাস্ট্রি হল সেই রাজার বানিয়ে দেওয়া মঠ, সিকিমের প্রথম কর্মা কাজ্যু ধারার উপাসনাস্থল।
তত্ত্বের কচকচি তো অনেক হল, এবার আমার সঙ্গে মূল কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসুন। জুতো পরছেন কেন কষ্ট করে? এক্ষুণি খুলতে হবে তো আবার, আমরা কক্ষের বাঁপাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা দেখতে যাব না?
চমৎকার পরিপাটি সিঁড়ি, ঘরদোর – এগুলো সংস্কার করা হয়েছে পরে পরে, বোঝাই যাচ্ছে – পের হয়ে আরও একতলা উঠে যাই তিনতলায়।
বুদ্ধদেব বসে আছেন। তার সামনে স্তূপ করে রাখা পুঁথি। সেই কাঠের পাটা, সেই লাল শালু দিয়ে মোড়া, সেই খসখসে, সামান্য লালচে অন্যরকম হ্যান্ডমেড কাগজ।
তফাতের মধ্যে, এখানে কাচের আড়াল নেই। সামনে। হাতের নাগালে।
জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ওগুলি মূল পুঁথি না। ওগুলি এই মঠের উঁচু ক্লাসের (এটা কী বলা উচিত জানি না। মানে যাদের পড়াশুনো অনেকটা অগ্রসর হয়েছে) তাদের অনুলিখন করা কাজ।
‘তুমিও লেখো?’
ভারি লজ্জা পেয়ে ডুগডুগ করে ঘাড় নাড়ায় ছোটো লামা, তস্য ছোটোটি এর মধ্যে কোথায় যেন উধাও হয়েছে। সে এখনও লেখার স্তরে পৌঁছয়নি, পুঁথি পড়তে শিখছে শুধু।
বললে বিশ্বাস করবেন না জানি, তবু,সে নিজে হাতে সেই পুঁথির একখানি খুলে আমাদের দেখায় কলমের অপূর্ব টানগুলো।

 

সেখান থেকে বেরিয়ে প্রদক্ষিণ করি আমরা তার পিছু পিছু। ভারি উৎসাহ নিয়ে নিচে তিরতির করে বয়ে চলা নদীটিকে দেখায়, কিন্তু নাম বলতে পারে না। জিজ্ঞেস করায় ঘাড় নেড়ে হাসে, বলে ‘রিভার। রিভার।‘ ব্যস!
সত্যিই তো। নদী তো নদী-ই, তার আবার নাম কী!

আমার মায়ের কাছে ভারি আদর খাচ্ছে দেখি সে। টুক করে একটা ছবি তুলে নিই। নিজের নাম বলে ‘কর্মা সোনম’, মিটিমিটি হাসে, ফোনে নিজের ছবি দেখে হাসিতে চোখ বুজে যায় প্রায়।

নেমে আসি আবার। বিদায় জানাই ছোট্ট গাইডকে। গাড়ি ফেরার পথ ধরে। যেতে যেতে দেখতে পাই গুম্ফার নতুন পতাকা তৈরি হচ্ছে, সেই যে লম্বা ঝিলিমিলি সারি সারি পতাকা থাকে সব জায়গায় এখানে। একদল বাঁশ কেটে সাইজমতো করছে, একদল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আরেক দল মুড়ে রাখা কাপড় খুলে তাতে আটকাচ্ছে, আরও একদল তৈরি পতাকা নিয়ে যাচ্ছে মঠের দিকে – সেখানে নিশ্চয় আরও লোক অপেক্ষা করছে, জায়গামতো আটকে দেবে বলে।
সুশৃংখল গতিতে নিবিষ্ট মনে কাজ। সব দলেই মহিলাদের উপস্থিতি চোখে পড়ল, দা-এর মতো জিনিস দিয়ে বাঁশ ছুলে শেপ করছে, বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি।
আরও একটা পয়েন্ট দেখতে যাওয়া হল এরপর, টাইটানিক পয়েন্ট। একটা বিশাল গিরিখাতের উপরে, চমৎকার ভিউয়ের সামনে একটা কৃত্রিম জাহাজের আদল। দাঁড়ালে মনে হয় জাহাজ হাওয়ায় ভেসে ভেসে চলছে। একপাশে পাহাড়ের গায়ে হরিণের মূর্তি এমন বানানো, হঠাৎ মনে হয় সত্যি বুঝি!

 

সুন্দর, তবে একটু অর্বাচীন ব্যাপার। যা যা দেখে এলুম তার পর যেন ততটাও সুন্দর আর লাগে না। তবে যাওয়া আসার রাস্তাটা নিবিড় জঙ্গল। ঠাণ্ডা, ছায়াচ্ছন্ন, মন-কেমন-করা। পথে হঠাৎ দেখি হুপো পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝুঁটি ফুলিয়ে।

ফিরে এসে স্নানাহার। আবারও সেই সাধাসিধে কিন্তু বেজায় সুস্বাদু নেপালী রান্না, সেই রান্নাঘরের লম্বাচওড়া টেবিলে হাত পা ছড়িয়ে খাওয়া, আন্টি এসে তিতিরের পাশে বসে গল্প করা – ওদের ক্ষেতের সবজির গল্প, ছেলে মেয়ের গল্প, শীতের সময় কেমন ঠাণ্ডা পড়ে তার গল্প।
আজ ঘোরাঘুরির পথে এক দোকান থেকে দু প্যাকেট বিস্কুট কিনে এনেছি তিতিরের ডগিদের জন্য। খাবার পর একটু বিশ্রাম করেই বেরিয়ে পড়লুম দুজনে ডগি-অন্বেষণে।
সে বিকেলের বর্ণনা আর দেব না, ছবিগুলোই যা বলার বলুক নাহয়।

সন্ধ্যায় ফিরে, চা আর সঙ্গে আনা নিমকি, শোনপাপড়ি ইত্যাদি খেয়ে যে যার পূজাবার্ষিকীতে ডুবে যাই। হু হু করে ঠাণ্ডা বাড়ছে ঘরের বাইরে তখন। মুরগি আর ছাগলেরা তাদের ঘরে ঢুকে গেছে, বাইরে গাছের ফাঁকে ফাঁকে শুধুই পোকামাকড়ের আলাপন।
রাত হয়, অষ্টমী পুজোর রাত। আজকের ডিনারে রুটি আর নেপালী আলুর দম, আচার। ঘরেই দিয়ে যায় আজ সব গুছিয়ে, অত ঠাণ্ডায় আর বেরোতে হবে না আঙ্কলকে।

এত নিবিড় ঘুম শহরে কক্ষনো হয় না।

(ক্রমশঃ)

Leave a Comment