চলার পথে – ২১ (cholar pothe – 21)

চলার পথে – ২১ (cholar pothe – 21)

সিকিম, পর্ব ১০

 

১৪ অক্টোবর ২০২১, বৃহস্পতিবার, বোরং

দেখে রেখেছিলুম কালকেই। এদের একটা উঁচু ছাত মত জায়গা আছে, যাতে জলের ট্যাঙ্ক রাখা। ঘর থেকে বেরিয়ে, রাস্তা দিয়ে একটু বাঁদিক দিয়ে গিয়ে সিঁড়ি গোছের ব্যবস্থাও আছে সেখানে চড়ার।

সক্কাল সক্কাল অ্যালার্ম দিয়ে উঠে, সোয়েটাল মাফলার কোট টুপি সব এঁটে, মোবাইল বাগিয়ে, এখান ধরে, সেখানে লাফ মেরে, হাঁটুতে গুঁতো খেয়ে, একটু প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে হাঁচড়পাঁচড় করে গিয়ে চড়লুম সেই ট্যাঙ্কের পাশে। ভোর পাঁচটা বাজে, আলো সবে ফুটছে।

কষ্ট সার্থক হল তারপর। সোনার টুকরো ধরা দিলেন। আহা! এইরকম সব দৃশ্য দেখেই লোকে পাহাড়ের আমৃত্যু প্রেমে পড়ে যায়!

 

নেমে এলুম বুকের মাঝে অঢেল তৃপ্তি নিয়ে। তারপর একটু চা টা পাওয়া যায় কিনা খোঁজ করতে গুটি গুটি গিয়ে দেখি তারা সব টি শার্ট কি স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঐ ধরাচূড়ো পরেও কাঁপতে থাকা আমায় দেখে তাদের সে কী হাসি!

ব্রেকফাস্ট খেয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে, তৈরি হয়ে রওনা। আজ আবার নতুন গাড়ি আসবে, গতকাল যে এসেছিল তার লাগেজ নেওয়ার জায়গা নেই বলে। এলো সে গাড়ি, কিন্তু এ-ও একদম ছোট্ট যে!

কোই বাত নেহি। এ গাড়ির মাথায় পোক্ত ক্যারিয়ার দেওয়া। স্যুটকেস, ভারি ব্যাগ সব উপরে তুলে দড়ি দিয়ে কষে বেঁধে ফেলল মঞ্জিল গুরুং আর ড্রাইভার মিলে।

এবার তবে আসি?

আরেকটা কাজ বাকি আছে, জানায় মঞ্জিল। আমাদের একলাইনে দাঁড় করিয়ে সাদা রেশমি উত্তরীয় পরিয়ে দেন তিতিরের আন্টি, সবাই হাত জোড় করে নমস্কার করি পরস্পরকে।

প্রথা।  সিকিমী আতিথেয়তার প্রথা।

গাড়িতে উঠতে উঠতে মনকেমন করে মানুষগুলোর জন্য।

সেই যে বোরং মনাস্ট্রি, যার পথের গোড়ায় কুকুর নিয়ে খেলছিলুম আমরা এই দুদিন, সেইটি টুক করে দেখিয়ে দেয় ড্রাইভার যাবার পথে। ছোট্ট, ছিমছাম মঠ।

তারপর উলটোবাগে চলি চাকুং-এর পথে।

সেই ভাঙাচোরা খানাখন্দ সরু রাস্তা সব পেরিয়ে, দক্ষিণ সিকিম ছেড়ে আবার ফিরে আসি পশ্চিমে। এতদিনে এই পাহাড় আর খাদের দৃশ্যে চোখ সেট হয়ে গেছে, বুঝতে পারছি যেদিন বাইরে চেয়ে আবার সেই বাড়ির দেওয়াল দেখতে হবে, মন কতটা মুষড়ে পড়বে। তাই কিছুটা অভ্যাসের আনন্দে, কিছুটা আর তো দুদিন পরেই আর পাব না এই চিন্তার ধাক্কায় দুচোখ পেতে বসে থাকি সারা রাস্তা, একটি ফোঁটাও যেন না বাদ যায়।

সীমিত গণ্ডূষ ভরে ওঠে, উপচে পড়ে, তবু এই হাত পাতার ব্যাকুলতা যায় না।

রাস্তা অনেকখানিই। পথে পড়ে একটা গ্রাম, জুম। বার্মিক থেকে বোরং যাবার পথেও পেয়েছি এটি, হাসাহাসি করেছি, ‘পৃথিবীর প্রথম জুম মিটিং এই গ্রামে হয়েছিল’ – বলে। এখন সেটিকে পাশ কাটিয়ে অন্য রাস্তা ধরি। খাড়া চড়াই এই রাস্তা সোজা উঠে যাবে চাকুং-এর দিকে।

কোথাও কিছু লেখা নেই, থাকলেও স্থানীয় ভাষায়। নেট তো শম্বুকগতি। মনে হয় হারিয়েই গেলুম বুঝি। খালি জঙ্গল আর জঙ্গল পেরিয়ে চলেছি তো চলেইছি।

ড্রাইভারও একটু যেন নার্ভাস হয়, বলে ফোন লাগান!

এমন কপাল, ফোনেও পাওয়া যায় না।

এমন সময়ে একটা দুটো ঘরবাড়ি দেখা যায় দূরে। গাড়ি থামিয়ে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোজি কোঠি কোথায় ভাই?

ভাই, নাকি আঙ্কল, নাকি দাদাজী – অমনি একগাল হেসে বলেন, কাজির বাড়ি তো? হুইইইইই পথ দিয়ে সোজ্‌জা চল্যা যাও!

না মানে, এমন করে বলেন না অবশ্যই। বলেন লেপচা ভাষায়, ড্রাইভার বোঝে তার মর্মার্থ – আমি শুনি যেন এইরকমই বললেন।

তাই যাই আমরা। খানিক পরে সাইনবোর্ড দেখে বুঝি আমরা নামটা ভুলই জানি বটে, এ হল ‘কাজি হেরিটেজ কটেজ’। মানে, ঐ, কাজির বাড়ি।

কিন্তু সাইনবোর্ড ছাড়া কিচ্ছু নেই যে! বাড়ি কই? ভূতুড়ে ব্যাপার নাকি রে!

বাঁদিকের এক চওড়া পাকদণ্ডি গছের রাস্তা দিয়ে ধপাং ধপাং করে নেমে এল দুই উদ্ধারকর্তা, জোয়ান দুই নেপালী ছেলে। উপর থেকে দেখেছে মনে হয় আমাদের গাড়ি থামিয়ে হাঁ করে এদিক ওদিক তাকানো। বলে দিলে কীভাবে সামনে আরেকটু গিয়ে ঘুরে উঠে আসা যাবে একেবারে কটেজের দোরগোড়ায়।

তাই এলুম। অমনি মনটা ডানা মুড়ে গুটিশুটি হয়ে ঝুপ করে বসে পড়ল। সবুজ ঢালা মাঠ, দুপাশ ভরা বাগানের গাছ – কমলালেবু, নাসপাতি আর কত কী ফুল, ডানদিকে ধাপে ধাপে উপরে আরও উঠে গেছে বাগান আর বাঁদিকে পাহাড়ের একদম ধার ঘেঁষে পাশাপাশি দুটি কটেজ। সে কটেজে পা রাখার আগেই মনে হল, আর কোথথাও যেতে চাই না।

সেখানে এমন একটা বারান্দা আছে, সেখান থেকে আর কোথায়ই বা যেব, কেনই বা যেতে চাইব, বলুন?

 

আমাদের সব গুছিয়ে দিয়ে গেলেন মিসেস কাজি, হাসিমুখ সুন্দর স্কুল টিচার, এ হোম স্টে তিনিই মূলত চালান। তাঁর কর্তা পালদেন কাজি তখন বাইরে ছিলেন, যেজন্য ফোন লাগছিল না – তিনিও এসে গেলেন খানিক পরেই, কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে কিনা খোঁজখবর নিয়ে, খাওয়াদাওয়ার ইন চার্জ মনীশকে আলাপ করিয়ে দিয়ে গেলেন।

যা খাইয়েছিল না আমাদের মনীশ! বেঁটেখাটো,থই-থই মাসলের গাঁট্টাগোঁট্টা নেপালী, মাথার দুপাশ কামানো, মাঝের চুল কাঁধ ছাপানো লম্বা রেখে তা টেনে মাথার মাঝখানে একটা জম্পেশ ঝুঁটি বাঁধা কালো হেয়ারব্যান্ড দিয়ে, রান্না করে একদম নামী হোটেলের মতো আর সারাক্ষণ রান্নাঘরে হিন্দি গান চালিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও গায় গলা ছেড়ে।

আমাদের চারজনের জন্য অঢেল খাবার বানিয়ে সাজিয়ে দিত আর খালি খালি বেজায় তাচ্ছিল্যের গলায় বলত, দুর দূর, তোমরা তো কিছু খেতেই পারো না!

কলকাতায় যা খাই, তার দ্বিগুণ খেয়েও তাকে খুশি করতে পারিনি।

তিতিরের জন্য এক গ্লাস গরম দুধ দিত ব্রেকফাস্টে। সে দুধ এত খাঁটি, মেয়ে প্রথম দিন খেয়ে বলে, মা দুধটা কেমন মোটা-মোটা। মনীশ শুনে হাসে, বলে, পাহাড়ি গরুর দুধ অমন হয়। মোষের দুধের মত – কিন্তু মোষ না, গরুরই দুধ!

তিতিরকে বলে, খুব করে খাও। নইলে তোমায় পাথরে বেঁধে রাখব।

পাথর?

বাঁধব না? তুমি যা পাতলা! এখানে খুব জোর হাওয়া দেয়, তুমি সে হাওয়ায় উড়ে গেলে তোমার মা কাঁদবে না?

নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে কুটিপাটি হয়ে যায় তারপর। তিতিরও দেখি বিনা বাক্যব্যয়ে মনীশ যা দেয় তাই খেয়ে নেয় তারপর থেকে।

 

———————————–

 

সিকিম, পর্ব – ১১

 

শুধু জঙ্গল, শুধু নিবিড় জঙ্গল, সামনে তিনদিক ঘেরা পাহাড়। তারও পিছনে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কিন্তু এখন মেঘে ঢাকা।

এর মধ্যে হোমস্টেটি কী সুন্দর করে ধাপে ধাপে সাজানো। যেখানে আছি, সেখান থেকে একতলা মতো উঠে এলে ছাতা দেওয়া গোল কাঠের ছোট্ট ছোট্ট টেবিল, চারদিকে কাঠের গুঁড়ি পেতে বসার ব্যবস্থা। সে গুঁড়িতে কতরকম ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে।

মধ্যে একটা ঝুলা, সেও কাঠের। তিতির আর আমি সারাদিন সেখানেই পড়ে থাকি। বাপিও উঠে এসে বসে পরদিন সকালে – সেদিন কাঞ্চন মুখ বাড়িয়েছে আড়াল সরিয়ে। চুপ করে বসে বসে পাহাড় দেখা, এতেই সময় কেটে যায় চোখের পলকে।

তারও উপরে আরও দেড়তলা মতো উঠে গেলে এক বিশাল দোলনা, দুই সুদীর্ঘ গাছের মাঝে টাঙানো। তিতিরকে চাপিয়ে দেয় কাজি আঙ্কল। কী উঁচু, কী উঁচু!

 

সেখানে আরেকদিকে ট্রি হাউস তৈরি হচ্ছে, এখনও রেডি নয়। মুরগির খোপ, গোলাপ সহ অসংখ্য ফুলগাছ চারদিকে। ভদ্রলোকের গাছের নেশা, সকাল থেকে বাগানে খাটছেন নিজে দেখি, গোড়া নিড়োচ্ছেন, লন মোয়ার চালাচ্ছেন, গাছ ছাঁটছেন।

গোটা পাঁচেক কুকুর আছে – তার মধ্যে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে হিংস্র দেখতে বিশাল কালো কুকুরটার নাম ‘ভালু’। ওদিকে স্বভাবে সেটাই আবার সবচেয়ে নিরীহ, তিতির তাকে জড়িয়ে ধরলেও আপত্তি করে না।

একটা বেড়ালও আছে, কুকুরদের সঙ্গে তার বেশ ভাব দেখলুম।

ইনিও আছেন এখানে। ছ ইঞ্চি ম্মতো লম্বা, আমার জিনসে উঠে চুপচাপ বসে ছিলেন কখন জানি, কাজি আঙ্কল দেখতে পেয়ে টোকা মেরে ফেলে দিলেন। তিতির অমনি হই হই করে উঠল, ‘স্টিক বাগ! স্টিক বাগ!’

 

একে নেট খুব স্লো, তা’য় মাথাতেও আসেনি সত্যি এটা চেক করার কথা। কিন্তু এক দাদাকে হোয়্যাটস-অ্যাপে বলতেই জানা গেল, সত্যিই ‘স্টিক বাগ’ বলে পোকা হয়। তাদের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, শত্রুতে ওই ছটা পায়ের একটা কামড়ে ধরলেও এরা কুছ পরোয়া নেহি ভঙ্গিতে সে পাটা খুলে দিয়ে চলে আসে। তারপর টিকটিকির ল্যাজ গজানোর মতো আরেকটা নতুন পা গজিয়ে নেয়।

বিচিত্র প্রকৃতি!

কিন্তু আমার মেয়ের পছন্দেরও বলিহারি যাই! এই বিতিকিচ্ছিরি দেখতে, আমার দেখেই গা শিরশির করতে থাকা পোকাটাকে বলছে “কী সুঈট!”

দিন কখন বদলে সন্ধ্যা হয় কে জানে। বারান্দায় বসে বসে সামনের পাহাড়ে এক এক করে আলো জ্বলে ওঠা দেখতে পাই। নিকষ কালোর বুকে সংখ্যায় খুব সামান্য সে দীপ্তি।

কম ভোল্টেজের আলোতে পড়তে ক্লান্তি আসে। খাতায় আঁকিবুঁকি স্কেচ করি পেন্সিলে। লতিয়ে আসা স্কোয়াশ লতার পিছনে পোকারা ডেকেই যায় অবিশ্রান্ত।

রাত্রে হাত ধোয়ার বেসিনের পাশ দিয়ে দেখতে পাই চেনা সাঁঝতারা উঠেছে আকাশে। কী জানি কেন মন খারাপ নিয়ে ঘুমোতে যাই।

 

 

১৫ অক্টোবর, ২০২১, শুক্রবার, চাকুং

চেষ্টা করেও আজ সকালে সোনালী রং পাওয়া গেল না। মেঘেদের আনাগোনা অব্যাহত।

তবে আরেকটু আলো হতে, ঝকঝকে সাদা রূপটি পেলুম বটে। ঘরে বসে বসেই, জানলা দিয়ে।

 

তারপর আবার পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ঘনিয়ে এলো পাহাড়ের বুকে। হয়তো এই দৃশ্য দেখেই যক্ষের মনে হয়েছিল— মেঘ এসে পাহাড়ের চূড়া হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে!

সারাদিন এই ঘরে, বাগানে, দোলনায় কেটে গেল। কাজিদের বাগানের গাছেদের ফোটো তুললাম কিছু। কত পাতার বাহার, কত ফুলের রং।

তার মধ্যে তিতিরের মাথায় ঠক করে কী একটা এসে পড়ল, উপরে চেয়ে দেখি বুলবুলিতে প্লাম ঠোকরাচ্ছে বসে।

আমাদের বুলবুলি ধান খায়, পাহাড়ি বুলবুলি প্লাম খায়।

এমন বিজ্ঞ কথায় তিতির মোটেই পাত্তা দিল না, উলটে আমায় টানতে টানতে নিয়ে চলল ম্যান্টিস-দর্শনে। বলিনি বুঝি তার কথা? আমাদের ঘরের বাইরে একটা ম্যান্টিস বসে আছে অনেকক্ষণ ওৎ পেতে, সারাদিন ধরে তিতির ঘুরেফিরে এসে দেখে যাচ্ছিল সে আছে, না চলে গেছে।

হয়তো এত উঁকিঝুঁকিতেই চটে গিয়ে সে ডাকতে শুরু করল হঠাৎ। বাবা রে, কী গলার জোর! পুরো আশপাশের জঙ্গল রি-রি করে উঠল যেন।

পালাই পালাই মোডে মেয়ের হাত ধরে শুঁড়িপথ বেয়ে দৌড় দিলুম একদিকে।

ফিরে এলুম যখন পড়ন্ত সূর্যের আলো লালচে হয়েছে, ম্যান্টিস উধাও।

মনীশ চা এনেছে সাজিয়ে। পকোড়া ভেজেছে বাঁধাকপি দিয়ে। বারান্দায় সবাই বসি, অলস, তৃপ্ত দিনের শেষে। সেই বুলবুলিতে ঠুকরে ফেলা প্লাম কী যে মিষ্টি খেতে ছিল!

নেট এসেছে এখন খানিক। সোশ্যাল মিডিয়া জানান দেয়, আজ বিজয়া দশমী।

মা-বাপিকে প্রণাম করি, তিতিরও করে। আমায় কিন্তু করে না কিছুতেই, বা রে, আমি না ওর ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’! বরং আচ্ছাসে জাপটেজুপটে কোলাকুলি করি আমরা দুজনে, তারপর এত বড়ো মেয়ে কোলেই বসে থাকে গলা আঁকড়ে…

দিন ফুরোয়। বেড়ানোও ফুরিয়ে আসে।

 

১৬ অক্টোবর, ২০২১, শনিবার

সকালে অ্যালার্ম দিয়ে যখন উঠে জানলায় বসেছি, তখনও এমন দেখাচ্ছে।

হাল ছেড়েই দিয়েছিলুম, যে আর তো হল না এ যাত্রায়! তাও, বসে ছিলুম, কারণ এমন দৃশ্যপটে, কোন মুহূর্তটাই বা সুন্দর নয়!

তারপর আস্তে আস্তে ভোরের গোলাপী রং লাগল আকাশে।  প্রথমে অন্য দিকে, তারপর এই চূড়ার পাশে।

 

তারপর, সেই অপার্থিব দৃশ্য। সেই জমে থাকা সোনা, এখানে অন্য অ্যাঙ্গল থেকে, আরও যেন অপূর্ব সুন্দর।

এটিতে কোনও ফিল্টার নেই, সামান্য জুম করা।

আরেকটু আলো হল, রং পালটাল।

 

তারপ আস্তে আস্তে আলোয় আলো হয়ে উঠল, ঝকঝক করে উঠল শুভ্র কিরীট।

আশ মিটিয়ে যতক্ষণ দেখা যায়, দেখলুম। তারপর লাগতেই হল ব্যাগ গুছোতে, তৈরি হতে। চলে যেতে হবে এবার, ছুটির পালাটি ফুরোলো। মনীশেরও বেজায় তাড়া, আমাদের ব্রেকফাস্ট খাইয়ে সব গুছিয়ে সেও নেমে যাবে তার গ্রামে, বাড়ির দশেরার বকেয়া কাজেকর্মে। আবার পরের ট্যুরিস্ট এলে হয়তো তার ডাক পড়বে।

কাজি পরিবারের কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠি, একসঙ্গে ছবি তোলা হয় তার আগে।

হু হু করে নেমে আসি। যাবার সময়ে অনেক সময় লেগেছিল – একে পুজোর জ্যাম, তায় চড়াই ছিল বলে, কিন্তু ফেরার পথ সে তুলনায় অনেক তাড়াতাড়িই পেরোয় দেখি। লোহাপুলে এসে পড়ি বারোটায় – কারওই খিদে পায়নি, তাই আরও এগিয়ে সেবকে খাওয়া হবে স্থির হয়।

ঠিকঠাক দোকান পেতে খানিক সময় গেল, দেরিও হল কিছু… কিন্তু অবশেষে একটা খুব সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেস্টুরেন্টে খাসা চাউমিন দিয়ে লাঞ্চ করা গেল।

আবার ফেরার রাস্তা। এই অংশে আবার জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মাঝে মাঝেই। দশেরার মিছিল বেরোবে আজ বিকেল থেকে, তার আগে শিলিগুড়ি পেরিয়ে যাবার তাড়া আমাদের মনে।

এরই ফাঁকে টুক করে তিস্তার এই ছবি পেয়ে যাই গাড়ি থেকে।

এন জে পি ষ্টেশন পৌঁছই ট্রেন আসার অনেকটাই আগে। লটবহরের জন্য কুলি লাগে, সে আমাদের প্ল্যাটফর্মে এনে বসিয়ে দিয়ে বলে গাড়ি আসার সময়ে আসব আবার, তুলে দেব।

বসে থাকি। এই কদিনের পর বেজায় গরম লাগে ছায়ায় বসেও। এদিক ওদিক মানুষ দেখি, নিজেদের মাস্ক এঁটে পরি।

শাশ্বতীদি – এই যে লিখি-টিখি, তার শুরুর দিক থেকেই এক দিদিকে পেয়েছি এই শহরের। এবারে সময় থাকা সত্ত্বেও, বিজয়ার মিছিলের ভয়ে আর তাঁর বাড়ি যাওয়া হল না, কিন্তু ঐ যে, দিদির আদর আর প্রশ্রয়ের অবধি দেখিনি কখনও। আমরা যেতে পারব না বুঝতে পেরে, তিনি নিজেই এসে দেখা করে গেলেন স্টেশনে।

এই যে চলার পথের বাঁকে বাঁকে এমন অহৈতুকী ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় মানুষগুলো, এদের কোন নামে ডাকি বলো তো?

ফিরে আসা, যেমন হয়, ফিরে আসার মতোই হয়। সব বাঙালী সহযাত্রী, প্রথমে মালপত্র বসার জায়গা নিয়ে খানিক খ্যাঁচাখেঁচি, তারপর মিলেমিশে ভাব হয়ে গিয়ে যে যার বেড়ানোর গল্প বলা, ফোন থেকে ছবি দেখানো, বাচ্চাদের ভাব করিয়ে দেওয়া, কলকাতায় চেক-আপ এ যাওয়া মানুষটির বাড়ির গল্প শোনা, সামনের বছর বেড়ানোর প্ল্যান নিয়ে চুটিয়ে আলোচনা করা, বিস্কুট চানাচুর ভাগ দেওয়া, রাত্রে শোবার জায়গা করে দিতে এ ওকে হেল্প করা।

ক্ষণিকের আত্মীয়তা।

কিংবা হয়তো, বুকের মাঝে এক টুকরো হিমালয়ের ছোঁয়া নিয়ে ফেরার কেরামতি।

পুনশ্চ – যে তিনটি জায়গায় থেকেছি, তার কনট্যাক্ট নাম্বার রইল এখানে একসঙ্গে। যদি কারও দরকার লাগে।

 

১) হী বার্মিক (Hee-Burmoik)

চন্দ্র গুরুং – 7797882250  (গাড়ি এবং গাইড হিসাবে ইনি অসাধারণ। এঁর নিজের হোটেলও আছে, যদিও সেটা তখনও পুরো রেডি নয় বলে আমি ভিতরে যাইনি।)

স্বরূপবাবু – 8777571786 (হোম স্টে। দোতলার পিছনের রুমের ভিউ সম্ভবত বেস্ট।)

 

২) বোরং (Borong)

মঞ্জিল গুরুং – 8116246579 / 9733860060

apnasikkim@gmqil.com

 

৩) চাকুং (Chankung)

Palden Kazi –  6297066016 (এটাই একমাত্র থাকার জায়গা এখানে)

Leave a Comment