চলার পথে – ২২ (cholar pothe – 22)

চলার পথে – ২২ (cholar pothe – 22)

 

কুমাই-চারখোল-তাকদা ভ্রমণ—পর্ব-১

বাড়ি-অফিস-স্কুলের হোমটাস্ক-লেখাপত্তর-আবার অফিস … এসব করে করে আদ্ধেক বছর কেটে গেল। সেইসঙ্গে হাঁসফাঁসানো গরম কলকাতায়! পাহাড়ে যাবার জন্য মন হু-হু করছিল। তাছাড়া, মেয়ের গরমের ছুটি, বেড়াতে যাব না!

টিকিট, থাকার জায়গা এসব নিয়ে বেশ কিছু ফোন কল-খোঁজাখুঁজি-হাহাকার ইত্যাদি পার হয়ে অবশেষে লাস্ট মোমেন্টে সব ব্যবস্থা হল। টিকিট প্রতীকদার পরামর্শমতো কাঞ্চনকন্যার স্লিপারে, আর বাদবাকি আদ্রিক হলিডে’জ-এর কৌশিকের দায়িত্বে।

সোয়েটার কই, রেনকোট খোঁজ, ছোটো স্যুটকেসে চেন লাগছে না যে বড়োটা পাড়ি তবে, হ্যাঁগো তোমরা দুজন ঠিকঠাক থাকতে পারবে তো?, গল্পের বই নেবই নেব—জামা কমাই বরং, তোর জুতো ছোটো হয়ে যায়নি তো, গুরুজিকে বলে দাও ঐ শনিবার ক্লাস করা হবে না, অ্যাঁ ওদিন আমি পাঁচটায় লগ অফ করছি সাতটায় মিটিং হবে-ইয়ার্কি নাকি, এই যা হেয়ারকাট করতে ভুলে গেলুম, সকালে টুথব্রাশ ভরতে মনে করিয়ে দিস তো… এসব পেরিয়ে “অ্যাই তিতির, বেড়াতে যাচ্ছি রে!”র বুধবার এসে গেল।

সঞ্জয়দা আমাদের ট্রেনে তুলে লাগেজ সেট করে দিয়ে গেল। সাইডের বার্থ, বসে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া যাবে ভেবে বেজায় খুশি হলুম বইকি। সামনের ক্যুপের সহযাত্রীরাও ছিলেন নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ সব—বয়স্ক রিটায়ার্ড ছজনের গ্রুপ, ট্রেন এবং সময় একটু গড়ানোর পর আলাপ হয়ে গেল কথায় কথায়। আমি ভেবেছিলুম স্কুলের বন্ধু, জানা গেল তা নয়, এঁরা মর্নিং ওয়াকের বন্ধু। দমদমেই থাকেন, একসঙ্গে বেড়াতে চলে এসেছেন হুজুগ তুলে— ঘুরবেন বেড়াবেন, ছবি তুলবেন, নিজেদের স্কুল-কলেজ জীবনের দশটা গল্প করবেন। ব্যস, আর চিন্তা রইল না, বাথরুম যেতে টেতে হলে ওঁরাই দায়িত্ব নিয়ে আমাদের ব্যাগ পাহারা দিলেন।

ট্রেনের সেলফি

বাড়ি থেকে আনা ডিনার খেয়ে, ধপাস করে শয়ন ও নিদ্রা।

একটা কথা এখানে না বলে পারছি না, স্লিপারের অভিজ্ঞতা বহু বছর পরে হল। স্মৃতিতে যা ছিল, তার সঙ্গে আজকের স্লিপার ক্লাসের বিশা-আ-ল তফাৎ। মেঝে পরিষ্কার, বাথরুম পরিষ্কার, জল ফুরিয়ে যায় না, বেসিনের নিচের ডাস্টবিন উপচে পড়ে না। গরম হবে কিনা ভেবে চিন্তায় ছিলুম, বদলে রাত্রে খোলা জানলা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া খেতে খেতে চাদরমুড়ি দিতে হল শীত করছিল বলে। অমন ফ্রেশ ঠাণ্ডা হাওয়ার সামনে কোথায় লাগে বদ্ধ কামরার এসি!

তবে হ্যাঁ, যাত্রীদের এক শ্রেণী অবিকল আগের মতোই নির্বোধ ও নির্লজ্জ আছে। খেয়ে খোসা/প্যাকেট মাটিতে ছড়ানো, প্যাসেজে লাগেজ রেখে দেওয়া, বাচ্চা চা উলটে অন্যের সিট নোংরা করে দিলেও সেটা সাফ করার চেষ্টা না করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকা, মাঝরাত অবধি আলো জ্বেলে ব্যাজর-ব্যাজর, হেডফোন ব্যবহার না করে স্পিকারে গান চালানো… তা সে আজকাল এসিতেও অবশ্য এদের দেখা পাওয়া যায়।

যাক সে কথা। সকালে উঠে মেয়েকে ঠেলে তুলে চা-দাদার থেকে চা খেয়ে ফেলা গেল। শিলিগুড়ি এল, কামরা প্রায় খালি হয়ে গেল সেখানে। ঐ দলটিও নেমে পড়লেন। আমরা যাব নিউ ম্যল জংশন, তাই বসে রইলুম।

শিলিগুড়ি পেরোতেই কৌশিকের ফোন এল, ‘ব্রিজ পেরিয়েছেন?’

“আমি তো কলকাতা থেকে  অজস্র ব্রিজ পেরিয়েছি ভাই, কোনটা চাই?”

কৌশিক তদ্দিনে বুঝে গেছে এ দিদিটি কেমন মানুষ। হেসে ফেলে বলল, ‘তিস্তার ব্রিজ…দেখবেন ঐ…”

আর জানা হয় না কী দেখব, সিগ্ন্যাল চলে যায় ফোনের।

সেই যে গেল, সে আবার এল তিস্তার ব্রিজ প্রায় পেরিয়ে যাওয়ার পর। মাঝে অনেকটা পথ জঙ্গলের মাঝ দিয়ে, আর নেটওয়ার্কের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে।

সিগ্ন্যাল আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার কৌশিক ফোন করে, বোঝা যায় সমানে ট্রাই করছিল সে। বাকিটুকু বুঝিয়ে, বার বার আশ্বস্ত করে যে সে নিজে থাকবে স্টেশনে।

নিউ ম্যল জংশনে মাত্র দুমিনিট গাড়ি দাঁড়ায়। খানিক আগেই উঠে এগিয়ে যাই দরজার দিকে, কারণ এখন  আমরা ছাড়া গাড়িতে রয়েছে খালি একদল কলেজ ছাত্র, জিওগ্রাফির ট্যুর করতে যাচ্ছে মূর্তি নদীতে। তাদের দীর্ঘ লাইন আর দীর্ঘতর লাগেজের সারির পিছনে পড়লে আমাদের নামাটা চাপ হয়ে যেতে পারে। ছেলেমেয়েগুলো ভালো, “বাবা, তোমরা ছেলেমানুষ, লাফিয়ে নেমে যাবে দরকার হলে, আমি কি স্যুটকেস আর এই চেহারা নিয়ে পারব?” বলতেই তারা নিজেরাই সরে সরে আমাদের আগে এগিয়ে নিল। ট্রেন থামতেই টুকুস করে নেমে পড়লুম। কৌশিক তখন তড়বড় করে ওভারব্রিজ দিয়ে নামছে, ফোন মারফৎ চেনা হয়ে গেল, হাত নাড়ানাড়ি হল। সে এসেই আমার হাত থেকে স্যুটকেস কেড়ে নিয়ে একগাল হাসিমুখে বলল, “চলুন!”

মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল।

গাড়িতে এনে, ড্রাইভার বিজনদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে, মালপত্র তুলে প্রথমে যাওয়া হল মিশন হিল-এর টী মোমেন্টস রেস্তোঁরায়।

টী মোমেন্টস

ব্রেকফাস্টের আগে

স্যান্ডিউইচ, পিজ্জা স্লাইস, ব্রেড বাটার, চা এসব দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে, রওনা দেওয়া গেল ‘কুমাই’য়ের পথে। সে এক নাম-না-শোনা ডুয়ার্সের গ্রাম, কৌশিকের ঠিক করা হোম-স্টে এক নেপালি পরিবারে। এতই প্রত্যন্ত অঞ্চল যে যাবার পথে কৌশিক আমাদের জন্য সবজি-বাজার করে সঙ্গে দিয়ে দিল, নইলে খেতে পাব না— কারণ সেখানে সপ্তাহে একদিনই হাট বসে। ও হ্যাঁ, পথে একটা ভিউপয়েন্ট দেখা হল, তারপর কৌশিক তার অন্য কাজে নেমে গেল, বাকি ট্যুর আমরা বিজনদার ভরসায় পাড়ি দিলুম।

ভিউপয়েন্টের দৃশ্য

কৌশিকের সঙ্গে

ভিউপয়েন্টে আমরা

Yonzonla home stay পৌঁছলুম, তখন দুপুর। কর্তা গিন্নি দুজনেই স্কুল টিচার, তাঁরা তখন স্কুলে—আমাদের আপ্যায়ন করল তাঁদের নেপালী কুক, বেজায় মিষ্টি হাসিমুখ গোলগাল মহিলা। একটা চা খেয়ে, স্নান করে খেতে বসলুম। যত্ন করে বেড়ে দেওয়া হল ভাত, ঢ্যাঁড়শের তরকারি, ডাল, বেগুনী, ডিমের ঝোল। আমাদের খাওয়ার মাঝপথে মিসেস লামা ফিরে এলেন স্কুল থেকে। নিজে থেকে অতিথিসৎকার করতে পারেননি বলে দুঃখপ্রকাশ করলেন। ইনিও হাসিখুশি, খুব ধীরস্থির মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে বসে নিজে তদারক করে খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকেলে কী করা যায় তার প্ল্যানও আলোচনা করলেন। কিন্তু প্রকৃতির মনে অন্য কিছু ছিল, খেয়ে উঠতে না উঠতেই ঝেঁপে বৃষ্টি এল। একটু অপেক্ষা করে বেরোনো যাক, ভেবে দোতলার ঘরে উঠে গেলাম। অতটা জার্নি, পেট ভরে খাওয়া, নরম বিছানা—চোখ লেগে এলে দোষ কী! চটকা ভাঙল বিজনদার ফোন আসতে, বৃষ্টি ধরে এসেছে, বেরোনো যাবে এবার। চট করে উঠে পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে গাড়িতে। চললুম জঙ্গলের রাস্তা ধরে মূর্তি নদীর দিকে।

শালবন

অরণ্য

ফুলের মাঝ দিয়ে পথ

শালবন। সবুজ, গহন জঙ্গল। পথে রেললাইন পড়ল, লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম আমরা। ট্রেন আসবে, দেখব। একটু পরেই ক্রসিং বন্ধ হল, আরো গাড়ি, ট্রেকার এসে দাঁড়াল রাস্তায়। স্থানীয় লোকজনে ভরা ট্রেকার, আসছে ঝালং থেকে—বিজনদা তার ড্রাইভারের থেকে খোঁজ নেন রাস্তা কেমন আছে ওদিকে। শ্রমিক মহিলা টুক করে নেমে পড়ে আড়মোড়া ভেঙে কোমর ছাড়ান, আমাদের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসেন। দূর থেকে ট্রেনের শব্দ পাই, চোখে দেখতে পাই না তখনও।

ট্রেন আসছে

অমনি বিজনদা আর আরও কয়েকজন হই হই করে ওঠে। দুটো ময়ূর ওদিকে, রেললাইনের উপর চলে এসেছে। তিতির খুব টেনশনে পড়ে যায় ওরা ট্রেনে চাপা পড়ে যাবে ভেবে, আশ্বস্ত করি যে ওরা ঠিক সময়ে উড়ে যাবে। যায়ও তাই, ইঞ্জিন কাছাকাছি হতেই তারা সরে যায়, ঝমঝম করে ট্রেন চলে যায় মস্ত এক খেলনার মতো।

আবার গাড়িতে উঠে পড়ি আমরা। দাঁড়াই আবার মূর্তি নদীর ধারে গিয়ে।

মূর্তির ব্রিজে

মেয়ের হাতে ক্যামেরা

মূর্তি নদী

বয়ে যাওয়া জলধারা সবসময়েই বড়ো সুন্দর লাগে। শান্তি, আনন্দ। ধারে ছোটোবড়ো পাথর। তিতির জানতে যায় একটা নেবে কিনা, তাকে মনে করিয়ে দিই, এভাবে প্রতিদিন ৫০% ট্যুরিস্টও যদি একটা করে পাথর তুলে নিয়ে চলে যেতে থাকে, ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়। বুঝদারের মতো মাথা নাড়ে মেয়ে, এখনকার বাচ্চারা তো অনেক বেশি পরিবেশ সচেতন, তাদের সিলেবাসে বা স্কুলেও সেভাবেই শিক্ষা দেওয়া হয়। নদী দেখি, নিজেরা ছবি তুলি, ব্রিজে হেঁটে বেড়াই। তারপর ব্রিজের পাশের গুমটিতে চা খাই। সারারাস্তা যে গোলাপি-বেগুনি ফুলে ছয়লাপ হয়ে ছিল, চা-ওয়ালা ছেলেটিকে সে গাছ দেখিয়ে নাম জানতে চাই- সে লজ্জা পেয়ে বলে আমাদের ভাষায় বলে ‘জারল’, আর তো নাম জানা নেই। হইহই করে বলি, ঐত্তো! মনে পড়েছে, বাংলায় বলে জারুল। (সেটা আর এটা এক নাও হতে পারে অবশ্য, আমার বোটানি জ্ঞান খুব স্ট্রং নয়। কিন্তু মনে হল তাই।)

স্থানীয় ভাষায় নাম ‘জারল’

‘জারল’ ফুল

ফেরার পথে অন্যদিক দিয়ে চলেন বিজনদা, হঠাৎ দেখি সামনে গেট ফেলে আটকানো। ছটা বেজে গেছে যে, এই জঙ্গল ছটায় বন্ধ বাইরের লোকের জন্য। তাহলে? কী হবে এখন?

কী আবার হবে। হর্ন দিতেই ফরেস্টের গার্ড ভিতর থেকে গেট তুলে গাড়ি পাস করিয়ে দিল। আবার চললুম, আরও ঘন জঙ্গল ভেদ করে।

হঠাৎ বিজনদা গাড়ি থামিয়ে বললেন ‘ঐ দেখুন ডানদিকে।‘

দেখি একটা বাইসন গাছের গুঁড়িতে প্রাণপণে পিঠ ঘষছে।

বাইসন!

তিতির খুব বিজ্ঞের মতো বলল, “আহা রে, ওর পিঠ চুলকোচ্ছে। ফুলুরি (আমাদের বাড়ির পড়ে পাওয়া বিড়াল) ছাতে গড়াগড়ি দিয়ে পিঠ চুলকোয় দেখোনি?”

শুনে মনে হল, দিম্মার পিঠচুলকুনি লাঠিটা হাতের কাছে থাকলে সেটা দিয়ে বাইসনের পিঠ চুলকে দিয়ে আসতে চলেই যেত গাড়ি থেকে নেমে।

খানিক দাঁড়িয়ে দেখে, আবার ফিরে চলা।

ঘরে আসার একটু পরেই দরজায় নক করে এসে গেল চা আর কুড়মুড়ে পকোড়া। কী আরাম কী আরাম!

একে বলে ‘সায়মাশ’। 🙂

রাত্রে আলাপ হল গৃহকর্তা বিমল লামার সঙ্গে, সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ছোটোখাটো ফিট চেহারার মানুষ, চোখে চশমার আড়ালে কোমল উজ্জ্বল চোখ। তাঁর স্কুলটি শকুন্তলাজির স্কুলের উলটোবাগে, একটু বড়োও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যায়, তাই কাজ বেশি। রাতের মেনু ছিল রুটি (জেনে নিয়েছিলেন ভাত খাব না রুটি), আলুভাজা আর চিকেন। দুজনেই আমাদের সঙ্গেই খেতে বসলেন, অনেক গল্প হল খেতে খেতে। ওঁদের ছেলে এখন কালিম্পঙ-এ পেয়িং গেস্ট থেকে পড়ছে সেসব গল্প, স্কুলে এখানকার ছেলেমেয়েরা কেমন পড়াশোনা করে তার গল্প, কলকাতার গল্প, ডুয়ার্সের ঋতু, জঙ্গল এসবের গল্প। শকুন্তলার ক্রাফটের শখ, চারদিকে তার নমুনা, সেসব নিয়েও আড্ডা হল। পরদিন কোথায় কোথায় যাব সে আলোচনাও।

(ক্রমশঃ)

Leave a Comment