চলার পথে – ২৩ (cholar pothe – 23)

চলার পথে – ২৩ (cholar pothe – 23)

কুমাই-চারখোল-তাকদা ভ্রমণ—পর্ব-২

 

পরদিন উঠে একেবারে রেডি হয়ে নেমে ব্রেকফাস্ট করলুম। সকালে চা চাইনি বলে একটু বকেই দিলেন শকুন্তলা। কী করে আর বলি, আমি চায়ের মোটেও ভক্ত নই! তারপর ব্রেকফাস্টে আলুর ঝোল ঝোল তরকারি দিয়ে পরোটা, রসোগোল্লা খেতে খেতে চায়ের কাপ এল। ওঁরটা আলাদা করে, নিজেই হেসে জানালেন, ওটি নুন-চা। ওঁরা ওভাবেই খেতে অভ্যস্ত। সঙ্গে সঙ্গে বায়না করে বসলুম, “আম্মো নুন-চা খাব কাল!”

আজ দুবেলা দু দফা সাইট সিয়িং-এর পালা। এখন বেরিয়ে প্রথমে চললুম দলগাঁও ভিউপয়েন্ট। ভারি সুন্দর। একদম ফাঁকা ছিল আমরা যখন গেলুম।

দলগাঁও ভিউপয়েন্টের ওয়াচ টাওয়ার

ওয়াচটাওয়ার থেকে নিচে

শুধু পাহাড় আর পাহাড়

সামনে সাজানো বাগান

একলা গাছ

কন্যা যখন ফোটোগ্রাফার

নির্জন সুন্দর

ভিউ টাওয়ারে চড়ে দেখে, আশ মিটিয়ে ছবি তুলে নেমে আবার রওনা দেওয়া গেল। এবার গন্তব্য বিন্দু, ঝালং আর জলঢাকা পাওয়ার প্ল্যান্ট।

এ জায়গাগুলো আর কী বলি। ছবিই থাক বরং কটা।

প্রথমে বিন্দু। পাহাড়ের ওপাশেই ভূটান। নিচে এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে ক্ষীণকায়া জলঢাকা নদী। পথের পাশের দোকানে থরে থরে চকোলেট। ভূটানী বিয়ারও পাওয়া যাবে চাইলে, জানালেন দোকানের দিদি। ওটিতে আমার আসক্তি নেই, তাই না করে দিলুম।

বিন্দু, ওপারের পিছনের পাহাড়টি ভূটানে

জল

পাথরে ঢাকা নদীপথ

তারপর জলঢাকা পাওয়ার প্ল্যান্ট। সে আরেক সৌন্দর্য তখন নদীর।

জলঢাকা পাওয়ার প্ল্যান্টের কাছে

প্রবল স্রোত।

জলঢাকা

শেষে ঝালং নদী। পাহাড়ি সব নদীর মতোই এ-ও উচ্ছল, পাথরসংকুল।

পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে নদী

ঝালং নদী

ফিরে এসে স্নান করলুম চুটিয়ে। যদিও এমনিতে গরমই বলা যায়, জলে চোরা ঠাণ্ডা আছে। গিজার চাই বলায় ওঁদের নিজেদের বাথরুম খুলে ব্যবহার করতে দিলেন, আমাদের ঘরটায় কোনও একটা ইলেক্ট্রিকাল সমস্যার জন্য গিজার লাগাতে পারেননি বলে বার বার সরিও বললেন। অবশ্য ফোনেই, কারণ দুজনেই তখন স্কুলে। কুক দিদি ঘর খুলে গিজারের সুইচ দেখিয়ে দিয়ে গেলেন।

দুপুরে খেলুম ভাত, আলু-পটল (এই পটল আমরা শিলিগুড়ি থেকে আসার পথে কেনা হয়েছিল), ডাল, পাঁপড় ভাজা, ডিমের ঝোল। রান্নার স্বাদ অন্যরকমের আমাদের চেয়ে, দিব্যি খেতে। বেশিই খেয়ে ফেলেছি টের পেলুম হাই ওঠা শুরু হওয়ায়, কিন্তু শোওয়ার উপায় তো নেই! একটু পরেই গাড়ি নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া হল লোকাল সাইটসিয়িং-এ।

আপার কুমাই যখন পৌঁছচ্ছি, মেঘে সব ঢেকে গেছে। রাস্তাও দেখা যায় না প্রায়।  ভিউ দেখা যাবে না বোঝাই গেছিল, কিন্তু নেমে ঐ মেঘের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেও যে কী মজা!

মেঘে ঢাকা উপত্যকা

দূরে গ্রাম

সেখান থেকে রকি আইল্যান্ড, মূর্তি নদীর আরেক রূপ সেখানে।

রকি আইল্যান্ড

ব্রিজে নেমে একটু ঘুরতেই এক দুই করে দেখি সাতখানা লাল-সাদা-কালো হরেক রঙের হরেক রকম কুকুর আমাদের পাশে পট-পট করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চলেছে। পাশের দোকান থেকে মেরি বিস্কুটের প্যাকেট না কিনে কী করি আর! একটা মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল, আবার একটা নিতে হল। তিতির যে কী খুশি তাদের পেয়ে, আদর করেই যাচ্ছে। খানিক সময় তাদের দিয়ে আবার গাড়িতে ওঠা হল।

এবার শেষ পয়েন্ট আজকের, সামসিং লালিগুরাস।

লালিগুরাস থেকে নিচে মূর্তি নদী

পাহাড়ে আজকাল যেমন ছবি তোলা ম্যান্ডেটরি

মেঘলা আকাশ, একলা গাছ

মেঘ খানিক কাটল এখানে এসে, মূর্তি নদীকে এখান থেকে দেখা গেল নিচে। ছবি তুলে, চা খেয়ে ফিরে চললুম আজকের মতো। রাত্রে আবার উপরে, ঘরের পাশে বসার ঘরে এসে বসলেন বিমল লামা, কুমাই নামের উৎস কী, তাঁর ঠাকুর্দা কেমন করে এখানে এসেছিলেন, বাড়িঘর বানিয়েছিলেন সেসব শুনলুম।

 

২১ মে, ২০২২, শনিবার

বিদায়ের পালা আজ। ব্রেকফাস্টে লুচি তরকারি ডিমসেদ্ধ রসোগোল্লার সঙ্গে আজ সেই স্পেশাল নুন-চা খাওয়া হল। আমার দেখাদেখি তিতিরও তাই-ই খেল। চমৎকার লাগল। একসঙ্গে একটা ছবি তুলে বেরিয়ে পড়লুম পরের গন্তব্যের দিকে- চারখোল।

কুমাইয়ের হোম স্টের সামনে। তিতিরের পাশে শকুন্তলাজি, আমার পাশে কুক মহিলাটি।

সেবক হয়ে, একটা মস্ত জলাধার দেখে আরেকটু এগোতেই চড়াই শুরু হল। ঘুরে ঘুরে হেয়ারপিন বেন্ড বেয়ে সমানে উঠে যাওয়া। নির্জন জঙ্গল দুপাশে। পথের পাশে চা-বাগান দেখি।

পথের পাশে চা-বাগান

তারপর আরও উপরে উঠে যাই। কুচো কুচো ঘরবাড়ি, ধাপে ধাপে মাঠ, সরু ফিতের মতো নদী। মেঘের কাছ দিয়ে, মেঘের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে মনে হয় অন্য জগতেই চলে গেছি বুঝি বা! পথে পড়ল পানবু দারা—এক অবিশ্বাস্য সুন্দর কুয়াশার রাজত্ব।

পানবু দারা – মেঘে মাখামাখি

পানবু দারার ধারের জঙ্গল

যে ব্রিজ পেরিয়ে পানবু দারায় এসে দাঁড়ানো

চারখোলের রত্ন আদিত্য হোমস্টেতে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দেড়টা বাজল।

এক ঝলক দেখেই মুখ দিয়ে আপনি “বাঃ” বেরিয়ে আসে, এত সুন্দর সে বাড়ি, তার কাঠের প্যানেলে মোড়া ঘর, ছোট্ট ফায়ারপ্লেস। এখন যদিও আগুন জ্বালার সময় নয়। সবই খুব সাজানোগোছানো, আরামে ভরা। সামনের খোলা বারান্দায়, নাকি ছাত বলব, চেয়ার পাতা, সামনেই পাহাড়।

চারখোলের রত্না আদিত্য হোমস্টের লাউঞ্জ

সামনের ছাতে আড্ডার ব্যবস্থা

আমাদের ওয়েলকাম করল এক খুদে, ক্লাস ফোরের শেরাপ দোর্জি। তিতির আর শেরাপ সেই চেয়ারে বসে খানিক গল্পও করেছে, এই দ্যাখো তার প্রমাণ। তবে কী কথা হয়েছে বাংলা-হিন্দি-নেপালি মেশানো সে আড্ডায় সে আমি বলতে পারব না, আমার প্রবেশ নিষেধ ছিল।

দুই খুদের আড্ডা

আমাদের পিছু পিছুই আরেক বড়ো দল বাঙালি পর্যটক এসে হাজির হলেন। আরও দুটো দল এসেছিল পরদিন, বোঝাই যাচ্ছিল এটা এখানকার জনপ্রিয় আস্তানা। দুটোর একটু পর ডাকতে এল নেপালি হেল্পিং হ্যান্ড ছেলেটি, লাঞ্চ রেডি। ঘর থেকে বেরিয়ে একটু নেমে নিচে ওপেন কিচেন ও ডাইনিং হল। পাহাড়ে জিনিসপত্রের অপ্রতুলতাহেতু বৈচিত্র্য কম হবে, এটাই স্বাভাবিক। সবজিটাই শুধু পালটাত, সঙ্গে রোজই দুপুরে ডাল, আলুভাজা আর আন্ডা-কারি এবং রাত্রে চিকেন। আজ ছিল গাজর-ক্যাপসিকামের শুকনো তরকারি। রান্নার স্বাদ চমৎকার।

খেয়ে উঠে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে লাগলুম, আজ বিকেলটা ফ্রি নিজেদের মতো ঘুরে বেড়ানোর জন্য। হোমস্টের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা পাহাড়ে উঠে গেছে, সেটা বেয়ে বেশ অনেকটা উপরে চলে গেলুম দুজন মিলে। আরও একটা হোমস্টে বা হোটেল উপরে জঙ্গলের মধ্যে। ইচ্ছেমতো ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার মুখে ফিরে এলুম ঘরে।

ততক্ষণে জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়েছে। জ্যাকেট দিতে হয়েছে গায়ে। ঘরে এসে, পোশাক পালটে সোজা লেপের তলায়। দুজনের হাতেই দুটো বই, তাছাড়া মধ্যে মধ্যে বাধ্যতামূলক কাতুকুতু দেওয়া, খোঁচানো ও তৎপরবর্তী জাপটাজাপটি, লেপের ভাগ নিয়ে মারামারি তো আছেই! তার মধ্যেই এসে গেল পকোড়া আর চা। তখনই দিদি জেনে গেলেন রাত্রে ভাত খাব না রুটি।

নটার পর ডিনারের ডাক পড়ল। আহা, সে কী চিকেন! তিতির অবধি দেখি চেটেপুটে প্লেট চকচকে সাফ করে ফেলেছে। বেশি খাওয়া যে হল, বলাই বাহুল্য। ঘরে এসে লেপের নিচে ঢুকতে যেটুকু দেরি।

(ক্রমশঃ)

Leave a Comment