চলার পথে – ২৬ (cholar-pothe-26)

চলার পথে – ২৬ (cholar-pothe-26)

কুমাই-চারখোল-তাকদা ভ্রমণ—পর্ব-৫

 

এইখানে একটা ব্যাপক ঘটনা ঘটল। জিংলিং নাম্নী দুই বা আড়াই বছরের খুকিটি তাঁর দুটো টেনে বাঁধা ঝুটি, একটা বিস্কুট আর অটুট গাম্ভীর্য নিয়ে সেই দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই হঠাৎ এক গাল হেসে সোজা এসে খচমচ করে আমার কোলে উঠে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়লেন।

বসে, প্রথমে জানলা দিয়ে কচি মাথাটা বাড়িয়ে, আঙুল দিয়ে পাহাড়ের দিকে দেখিয়ে ‘আইওয়াল্লক্কক্ককিয়াআউ’ ইত্যাদি ভাষায় অনেক কিছু বলে দিলেন। আমি প্রতি কথায় ‘তাই তো!’ ‘ঠিক বলেছ!’ ‘একদম’ এসব বলে সায় দেওয়ায় মহারানী আমার উপর খুবই তুষ্ট হলেন মনে হল, এবার নিচে ভ্যালির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে অদৃশ্য কাকে যেন প্রচণ্ড বকাবকি করতে লাগলেন। বলা বাহুল্য আমিও সেই অদেখা ব্যাক্তিকে ‘হতচ্ছাড়া’, ‘খুব দুষ্টু’, ‘দিতে হয় কান মলে!’ এসব বলে বকে দিলুম।

তাতে পরম পরিতুষ্ট হয়ে তিনি প্রথমে আমার জামার হাতাটা একটু চিবিয়ে দিলেন, তারপর হাতের ফোনটা থাবড়াতে শুরু করলেন। দিলুম আনলক করে। ক্যামেরায় ছিল, ফ্রন্ট ক্যামেরা অন ছিল। নিজেকে দেখে যেই আনন্দে হাসতে শুরু করেছে, টুক করে ছবি নিলুম একটা—অবশ্যই পাশে বসা ওর বাবার পারমিশন নিয়ে।

তিনি

তারপর তিনি আর আমার কোল থেকে নামবেনই না! তার মা, বাবা, দাদা, রূপেশ, আরও উপস্থিত স্থানীয় লোকেরা সবাই চেষ্টা করে করে ফেল মারল, তিনি নামবেন না তো নামবেন না। এদিকে আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, তখন অগত্যা আমিই দুহাতে তুলে ধরে তাঁকে মাটিতে স্থাপন করার চেষ্টা করলুম, ওমা! দেখি, দু পা ভাঁজ করে উপরে তুলে নিয়ে আমার হাতেই ঝুলে আছেন আর মিটমিট করে হাসছেন। শেষে তাঁর বাবা গাড়ি চেপে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে তাঁকে সেই সিংহাসনচ্যূত করে বাইরে নিয়ে গেলেন।

এখান থেকে সোজা হোম স্টে। স্নান, খাওয়া, একটু বিশ্রাম। তারপর আবার তড়াক করে উঠে পড়া, বেড়ানোর শেষবেলা কি ঘুমিয়ে কাটায় কেউ!

কোথায় যাব? আঙ্কল দেখিয়ে দিলেন রাস্তা, সামনের পাহাড়ের একটা অংশের জমি তাঁদেরই, প্রাইভেট জঙ্গল যাকে বলে। তার মধ্যে সুন্দর ধাপে ধাপে বেড়ানোর রাস্তা করা আছে, যাকে বলে জাঙ্গল ট্রেইল। একদম নিরাপদ, দুদিকে গেট দেওয়া, শুধু এখানকার গেস্টরাই যেতে পারে।

নিজস্ব জঙ্গলপথ

চললুম দুজনে মিলে টুক টুক করে। এই একদম জঙ্গলে ঢুকে যাই, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, এই আবার মোড় ঘুরে অনেকটা উপর থেকে দেখি ওই তো হোমস্টের দরজা, ওই তো আঙ্কল রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর কার সঙ্গে গল্প করছেন। এইরকম লুকোচুরির মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার, সুন্দর রাস্তায় প্রায় ঘন্টাখানেক হেঁটে এসে অন্য প্রান্তে পৌঁছই, সেখানেও আরেকটা গেট, বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া। হাত বাড়িয়ে সে ছিটকিনি খুলি, তারপর কী করে যেন কীসব করে ফেলি, আর দেখি, বাঁশের ফ্রেমে সে ছিটকিনির ডান্ডা এইসা জ্যাম হয়ে গেছে যে দরজা না এদিকে খুলছে না ওদিকে।

সুখের বিষয় জায়গাটা পাকা রাস্তা থেকে একটুখানিই উপরে, আমাদের ধাক্কাধাক্কি টানাটানি দেখে সামনের বাড়ি থেকে এক দৌড়ে এক হাফপ্যান্ট পরা স্থানীয় লোক ছুটে এলেন। এসে তিনিও ঘাবড়ে গেলেন অমন অনৈসর্গিকভাবে ছিটকিনি আটকে যাওয়া দেখে। তবে বাইরে থেকে একটু টানাটানি করতেই সেটা খুলেও গেল, আমরাও হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়লুম। বেরিয়ে দেখলুম জায়গাটা হোম স্টের গেট থেকে সামান্যই দূরে, আঙ্কল, আন্টি এবং সেই পর্যটকরা সবাই আমাদের এই মহান কীর্তি দেখে বেজায় হাসছেন তখন।

অত হেঁটে খিদে পেয়ে গেছিল, চা আর পকোড়া সাঁটিয়ে একেবারে উপরে এলুম। আজ আর খেতে নামা ছাড়া বেরোনো নেই। যে যার বই আর আঁকার খাতা নিয়ে ধপাধপ উপুড় হলুম জামাকাপড় ছেড়ে।

ঘরের সামনে থেকে ভিউ

রাত্রে সারপ্রাইজ ডিনারে এল ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন। চিকেনের বাইরেটা কে এফ সির মতো ক্রাঞ্চি আর ভিতরটা মাখন। গ্রেভিতে পষ্ট দেখলুম ক্যাপসিকাম টমেটোর সঙ্গে লঙ্কাও রয়েছে বেশ, কিন্তু একটুও ঝাল লাগল না খেতে।

ঘুমের আগে চিরাগের বোনকে বললুম, খুব ইচ্ছে রক্সির সঙ্গে ছবি তুলব। রক্সি কে বলেছি? ওই যে ছ মাসের সেন্ট বার্নার্ড! আশা করা যায় দুদিন ধরে আমাদের দেখে সে একটু সহজ হয়েছে। কথা হল সকালে হবে সেই ফোটো সেশন।

‘বেড়ানো শেষ’, বলতে বলতে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লুম।

 

২৫ মে, ২০২২, বুধবার

ঘুম ভাঙল, এইত্তো ঠিক ধরেছেন, ভোর পাঁচটা। তখন গোটা বাড়িতে কেউ ওঠেনি মনে হল, বাইরের গেট খোলা হয়েছে যদিও। আস্তে করে বেরিয়ে পড়ি, কিছুক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে হেঁটে আসি। প্রাইভেট ট্রেইল না, এমনি পায়ে চলা অন্য পথে যা গ্রামের সবাই ব্যবহার করে।

জঙ্গলে সকাল

জঙ্গল

গাছের আড়ালে বনমোরগের ডাক শুনি, দেখতে পাই না। অবাক হয়ে দেখি পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের পাশে এক ফুটবল গ্রাউন্ড!

জঙ্গলের পাশে ফুটবল গ্রাউন্ড

তারপর ফিরে এসে উলটোদিকে হেঁটে নেমে যাই গ্রামের মধ্যে। ঘুম ভাঙা মানুষজন নতুন লোক দেখকে হাসে, কুকুরেরা বাড়ির দাওয়া থেকে নেমে শুঁকে যায়। ছোট্ট কৃষ্ণমন্দির অবধি গিয়ে ফিরে আসি।

গ্রামের দিকে

লুচি তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে, ব্যাগ গুছিয়ে স্নান সেরে রেডি হয়ে ঘর ছাড়লুম সাড়ে দশটায়। নিচে নেমে দেখি রক্সিও এসে হাজির, আজ আর লজ্জা পেল না, বেশ ভাবই হয়ে গেল বলা যায়। ওঁদের ঐতিহ্য অনুযায়ী রেশমি কাপড় জড়িয়ে দিয়ে আমাদের বিদায় জানালেন আন্টি। একসঙ্গে ছবি তোলা হল বেশ কিছু।

রক্সির সঙ্গে ভাব হয়ে যাওয়ার পর

বিদায়মুহুর্তে সবাই মিলে

তারপর রওনা শিলিগুড়ির উদ্দেশে। আজও রূপেশভাই এসেছিলেন, কঠিন অংশটা তিনিই ড্রাইভ করে পার করে সোজা রাস্তা অবধি পৌঁছে দিলেন। খুব উপকারী মানুষটি, বলতে বাধ্য।

ট্রেনের অনেক সময় আছে, তাই বিজনদা বললেন বেঙ্গল সাফারি করতে। তবে তার আগে সেবকে দুপুরের লাঞ্চ করে নেওয়া হল।

তিস্তা

বেঙ্গল সাফারিতে গিয়ে দেখা গেল টয় ট্রেন বন্ধ, আর সাফারিগুলো এত দেরিতে আছে যে নিলে ট্রেন ধরাটা একটু চিন্তার হয়ে যাচ্ছে। আমরা তাই এমনি পার্কে ঘোরার টিকিট কেটে ঢুকে পড়লুম।

বড়ো পার্ক। বাটারফ্লাই গার্ডেনে প্রায় কিছুই নেই, বাচ্চাদের খেলার জায়গায় বড্ড জলকাদা হয়েছে বৃষ্টি হয়ে। একটা জিপলাইন না কী যেন ছিল, একটা উঁচু ঘর থেকে দড়ি বেয়ে অন্যদিকে চলে যাওয়া যায়। আমার উৎসাহ ছিল, কিন্তু তিতির একটুও অ্যালাও করল না। অগত্যা টঙে চেপে ছবি তুলেই নেমে এলুম।

অগত্যা, ছবিই সই

সেই রোমাঞ্চকর ব্যাপারটা

গাছটা আমার জামার সঙ্গে প্রিন্ট ম্যাচ করেছে দেখছি!

তারপর আমরা গেলুম কুমিরের খোঁজে, ঐ একটামাত্র জায়গা হাঁটা দূরত্বে মনে হল। সে রাস্তায় খানিকটা গিয়েই হারিয়ে গেলুম, তখন পাশে দেখি ক্রাফট সেন্টার না কী। ডিরেকশন জিজ্ঞাসা করতে ঢুকে দেখি কোথাও কেউ নেই, খালি একপাশে একটা চা-পাতার দোকানে এক ভদ্রলোক বসে আছেন।

কী ভাগ্যিস হারিয়ে গিয়ে রাস্তা খুঁজতে হল! তাতেই আলাপ হয়ে গেল সরোজিৎ পালের সঙ্গে। রিটায়ার্ড ফরেস্ট অফিসের কর্মী, জঙ্গল যেমন ভালোবাসেন তেমনি এই অঞ্চল চেনেন হাতের তালুর মতো। কত যে গল্প তাঁর ঝুলিতে, চা বাগানের, বাঘের, কাঠপাচারীদের, পশুশিকারীদের, চোরাচালানকারীদের। দাপটে চাকরি করেছেন, অজস্র অপরাধীদের সায়েস্তা করেছেন। আবার নাটকের দল করে পথে পথে নাটক করে, বুঝিয়েবাঝিয়ে এরকম অনেককে সৎপথে নিয়েও এসেছেন। গল্প করতে খুব ভালোবাসেন, আমার কাশি হচ্ছে দেখে তুলসি চা বানিয়ে খাওয়ালেন। ওঁর থেকে ফার্স্ট ফ্লাশ নিয়ে এসেছি বাড়িতে , খুব ভালো খেতে। কলকাতায় হরবখৎ চাপাতা পার্সেল করে ওঁর ‘পল টি হাউস’।

মিস্টার পলের দোকানে

উনিই দেখিয়ে দিলেন কুমিরের জলায় যাবার রাস্তা। সেখানে পাশাপাশি দুটো জলাশয়, মধ্যে একটা ব্রিজ। ব্রিজের আগে একপাশে দুই গার্ড বসে পাহারা দিচ্ছেন যাতে কেউ কুমিরদের বিরক্ত না করে। জলে, পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি ইত্যাদির মধ্যে প্রথমে চট করে চোখে পড়ে না, একটু পরে চোখ সয়ে যেতে দেখলুম এদিকে দুটো, ওদিকে চারটে কুমির শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। খানিক পরে এক জোড়া কচ্ছপও জলে সাঁতার কেটে এদিক থেকে ওদিক গেল।

কুমির

আরও কুমির

এবং দুই নিরীহ পর্যটক

তারপর কতক্ষণ ধরে আমরা খেললুম। কিছুই না, একটা গাছের সরু ডাল, পার্কের বালিমাটি, আর খুনসুটি।

এই যে, এটা তিতিরের সেলফ পোর্ট্রেট।

এটা আমি।

এটা তিতিরের দাদুমণি।

এটা দিম্মা।

এটা মাসিমণি।

আর এই আমাদের কাটাকুটি খেলা।

একটা গোটা বিকেল জুড়ে বাচ্চার মুখে আনন্দের হাসি ফোটাতে এই-ই ঢের!

তারপর বিজনদা নিয়ে চললেন গাজলডোবা। সেটা নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলুম বলতে পারব না, কিন্তু শিলিগুড়ির মানুষ হিসাবে তাঁর কাছে সেটা প্রিয় মনে হল, তাই আপত্তি করলুম না। বেশ অনেকটা রাস্তা। একটা ক্যানাল, নৌকো চলছে, তিরে প্রচুর খাবার দোকান। আমরা সেখানে ফুচকা খেলুম।

গাজলডোবা

তারপর স্টেশনের দিকে রওনা, প্রত্যাশামতোই শহরের রাস্তার ঢিকিঢিকি ট্রাফিক, জ্যাম, সিগন্যাল ইত্যাদি পেরিয়ে প্রায় সাতটা হল শিলিগুড়ি জংশন পৌঁছতে। বিদায় জানিয়ে, চলে গেলুম প্ল্যাটফর্মে। রাত্রের খাবার প্যাক করিয়ে নিলুম ওখান থেকেই। তারপর ট্রেন এল, নিজেরাই কামরা খুঁজে নিয়ে উঠে পড়লুম, লাগেজ ফিট করিয়ে বসেও পড়লুম দিব্যি। আবারও সাইডেই। ট্রেন ছাড়ার একটু পর খাওয়াদাওয়া সেরে আবারও সেই হু-হু হাওয়া খেতে খেতে নির্বিঘ্নে সকাল আটটা পনেরোয় বিফোর টাইম শিয়ালদা, সেখানে সঞ্জয়দার হাতে লাগেজ সঁপে দিয়ে গাড়িতে উঠে হুশ করে বাড়ি।

এবারের মতো সত্যিই বেড়ানো শেষ। দেখা যাক, চলার পথের পরের বাঁকে আবার কোন অঞ্চলে গিয়ে হাজির হওয়া যায়!

আপাতত, বিদায়!

(সমাপ্ত)

Leave a Comment