চলার পথে – ২৭ (cholar-pothe-27)

চলার পথে – ২৭ (cholar-pothe-27)

উত্তরবঙ্গ ডিসেম্বর, ২২ (কালিম্পং-পেডং-মুন্সং-দার্জিলিং) – পর্ব ১

 

“ক্রিসমাসে বেড়াতে যাবি?”

“হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ!”

“কোথায় যাওয়া যায় বল দিকি! গোয়ায় বড্ড ভিড় হয় এই সময়ে…”

“পাহাড়।“

“অ্যাঁক্‌! খুব ঠান্ডা হবে যে রে!”

“হোক। পাহাড় যাব, পাহাড় যাব!”

ভেবে দেখলুম, শীতকালেই শীতের জায়গায় যেতে হয় বহুবার পড়েছি বটে। তাহলে আর বেশি ভেবে লাভ নেই, বেড়ানোর কাণ্ডারী কৌশিককে ফোন করি তদ্দণ্ডেই।

“হ্যাঁ বলছি, মর্গান হাউসটা গতবার বলেছিলুম, মনে আছে তো?” (পাশ থেকে কন্যার “ভূতিয়া হাউস! ভূতিয়া হাউস!” করে চিল্লানো)

“আর ইয়ে, আমি আজ অবধি না… দার্জিলিং যাইনি।“

ছোকরা মন্দ না। এসব শুনে যতই হাসুক, ব্যবস্থা করল সব মাথায় রেখেই। ইতিমধ্যে আমি যাওয়ার টিকিট কেটে ফেলেছি, আসারও যাহোক একটা…

কাজেই রইল বাকি খালি ব্যাগ গুছোনো আর দিন গোনা।

———————————————————————————-

দিন ১ (২৩ ডিসেম্বর, ২০২২)

এক অতি অসম্ভব ভোরে উঠে, রেডি হয়ে আমরা দমদম পৌঁছে গেলুম। আশপাশে অনেকেরই আমাদের মতো ধুমসো ধুমসো জ্যাকেট, এই ঘোর ডিসেম্বরেও অনেক লোকে পাহাড়ে বেড়াতে যায় তাহলে!

ওমা! ডিলে কেন বলে রে! কুয়াশা হয়েছে… যাঃ!

আরও দুবার ডিলে হওয়ার অ্যানাউন্সমেন্ট এবং একবার গেট পালটানোর পর অবশেষে ফ্লাইটে উঠে বসা গেল।

আরামসে যাচ্ছি, প্রায় চোখ বুজে এসেছে, হঠাৎ সামনের সিটের বালকটি “ঐ, ঐ” করে চেঁচিয়ে উঠল। চমকে জানলা দিয়ে তাকিয়েই দেখি, তিনি দৃশ্যমান।

দেরি হওয়ার জন্য জমে ওঠা বিরক্তিটা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল; মনে হল, পুরো ট্যুর খুবই ভালো কাটবে এবার।

ছোট্ট সফরের শেষে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পদার্পণ করা গেল। ব্যাগ কলেক্ট করে, ট্রলি নিয়ে গুটগুট করে সোজা পার্কিং। সেখানেই অপেক্ষা করছিলেন ড্রাইভার দাদা সেই সকাল ন’টা থেকে, ব্যাগ ডিকিতে তুলে নিয়েই যাত্রা শুরু।

গন্তব্য কালিম্পং, আজকের রাত্রিবাস তিতিরের ‘ভূতিয়া হাউস’-এ।

***

সরাসরি নয় অবশ্য। পথে প্রথমে লাঞ্চ করা হল। নুডলস আর মিটবল। সঙ্গে স্ট্রবেরি মিল্ক শেক।

তারপর দূরপিন মনাস্ট্রি যাওয়া হল। গতবার এইটি বন্ধ ছিল বলে দেখতে পাইনি। তবে এবারেও ভিতরে যাওয়া গেল না, এখনো সেটা বন্ধ। বাইরে থেকেই দেখা আর সহাস্য লামাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় হল।

তারপর সোজা মর্গ্যান হাউস। ততক্ষণে আলো প্রায় মরে এসেছে, জব্বর ঠাণ্ডা শরীরের খোলা জায়গাগুলোয় কামড় বসাচ্ছে। চার দেওয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়ার জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

এ বাড়িটিতে এমনিতে প্রবেশ নিষেধ,  শুধুমাত্র বুকিং করলে তবেই ঢোকার ছাড় পাওয়া যায়। গেটে সেই বুকিং-এর কাগজ দেখিয়ে আমরাও ঢুকে পড়লুম।

 

গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে গেলুম, মালপত্র মুহূর্তের মধ্যে কাদের সব হাতে হাতে উধাও হয়ে গেল। খুব মিষ্টি দেখতে এক ভদ্রমহিলা আমাদের বসতে দিলেন, তাঁর ইঙ্গিতে সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর কাপে দার্জিলিং চা এসে গেল ‘ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক’ হিসাবে, নাম রেজিস্টার করানো ইত্যাদিও মসৃণভাবে হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। এখানে তিতিরের বয়সী বাচ্চাদেরও সরকারি পরিচয়পত্র লাগে। দুজনের আধার কার্ডই নিয়ে গেছিলুম তাই।

তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরে গেলুম।

কাঠের সিঁড়ি। কাঠের মেঝে। আমাদের স্কুলের চ্যাপেলে যাওয়ার সিঁড়িটাও এমন কাঠের সিঁড়ি ছিল। পা ফেললে কত রকম শব্দ হয়!

বিছানা, সোফা, টেবল, কাবার্ড। পরিপাটি ঘর। ব্রিটিশ আমলের বিরাট বড়ো বাথরুম। ঝকঝকে তকতকে। গদি আর লেপ দেখেই আরামের জন্য মন কেঁদে ওঠে। কিন্তু তার আগে সাফ হতে হয়, জামাকাপড় পালটে পরিষ্কার ঘরের জামা পরতে হয়, দুটো গল্পের বইও বার করে নিতে হয়।

ছুটির মেজাজ জমে ওঠে তারপর।

ছ’টায় চা আর চিকেন পকোড়া এসে হাজির হয়। গরম গরম, মুচমুচে। এইটের আর রাতের খাবারের অর্ডার তো আসামাত্র নিয়ে নিয়েছিল। দুজনে দুটো সোফায় গ্যাঁট হয়ে বসে মুখ চালাই। দুই অর্থেই মুখ চালাই,  মানে পাল্লা দিয়ে খাই আর সারাদিন কী কী হল তার গল্প করি।

ঠান্ডা ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে, টের পাই। জুড়িয়ে আসা চা-টুকু শেষ করে স্যাটাস্যাট আবার লেপের নিচে ফিরে যাওয়া।

নটায় ডিনার চলে আসে। খুবই স্বাদু হালকা মশলার রান্না। খেয়েদেয়ে, ক্যাসারোল বাইরে বার করে রেখেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি।

আহা, ভূতেদের সময় দিতে হবে না?

——————————————————————————————————————————————

দিন ২ (২৪ ডিসেম্বর, ২০২২)

কী আর বলি ভাই! এত আশা করে থেকেও, সারা রাত বেশ কয়েকবার ঘুম ভাঙার পরেও কোনো ভূতের টিকির দেখা পাওয়া গেল না। অবশ্য সাহেবী ভূতের টিকি থাকার কথাও না।

আচমকা ঘুম ভেঙে গিয়ে সোঁ-সোঁ আওয়াজ, যেন বা কেউ কাঁদছে জানলার বাইরে বসে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে অনৈসর্গিক সব খট্‌ খট্‌ শব্দ, কিঁচ করে কীসের জানি ডেকে ওঠা…ব্রহ্মদত্যি সিঁড়ি দিয়ে নামছে খড়ম পরে নাকি রে? ওই বুঝি ইঁদুর-ভূতের ল্যাজ মাড়িয়ে দিল, তাই সে চিল্লিয়ে উঠল?

যত এইরকম সব কল্পনা করে ভয় পাওয়ার চেষ্টা করছি, তত বেয়াড়া বজ্জাত মন বলছে, “ধুস্‌, ওটা তো হাওয়ার শব্দ। ও তো কাঠের সিঁড়ি ঠান্ডায় ছোটো হচ্ছে তার শব্দ। কেউ বাথরুমের দরজা খুলল, নির্ঘাৎ আর থাকতে পারছে না… নইলে এত শীতে কেউ লেপ ছেড়ে ওঠে!

এই যে কিছুই ভয়ডর লাগল না, এর জন্য আমার ধারণা লীলা মজুমদার বহুলাংশে দায়ী। অবশ্য আমার বহু কিছুর জন্যই উনি দায়ী, তবে এটা এর আগে ভেবে দেখিনি। ওই যে, পাকদণ্ডি, বকধার্মিক  আর অন্য নানা গল্পে উনি পাহাড়ি ঠান্ডার এত জীবন্ত, এত বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে রেখেছেন, যে নতুন কিছু শব্দ শুনেই মন বলে উঠছে, “ওই দ্যাখ! সেই কার্ণিশ থেকে টুপ্‌ টুপ্‌ করে জল পড়ছে, সেইরকম  কাঠের মেঝে মচমচ করছে, সেই রাতজাগা পাখি ডাকল!”

ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, ভূতের দেখা না পেয়ে আমি যত না হতাশ হয়েছি, সারারাত এতরকম চেষ্টা করেও আমায় কিছুতেই ওই ‘পাকদণ্ডি’র বর্ণনার বাইরে বার করতে না পেরে ভূতগুলো তার চেয়ে বেশিই হতাশ হয়েছে!

আমার কন্যা আমার চেয়েও সরেস। আমি তবু মাঝেসাঝে উঠেছি, সে একঘুমে রাত কাবার করে উঠে একগাল হেসে বলল, “কিচ্ছু টের পেলুম না, আবার আসব, কেমন?”

বেড টির সরঞ্জাম দেওয়াই ছিল। খেয়ে, স্নান সেরে তৈরি হয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে রেখে নেমে গেলুম। কম্পাউন্ডটা পুরো ঘুরলুম, লনে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছ’টা কুকুর শুয়ে ছিল, তাদের প্রত্যেককে প্রচুর আদর করা হল, ছবি তোলা হল।

বাড়ির ভিতরে তোলা কিছু ছবি-

বাড়ির বাইরে গিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে ছবি তোলা হয়েছিল-

 

তারপর ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়া হল।

তারপর গাড়ি এসে গেল আমাদের। চেক-আউট করে রওনা দেওয়া গেল পেডং-এর পথে।

***

তবে হ্যাঁ, যাওয়ার পথে বেশ কিছু জায়গা ঘুরতে ঘুরতে যাব। প্রথমেই যাওয়া হল কালিম্পং ফরেস্ট মিউজিয়াম। এইটের কথা আগে শুনিনি, দেখলুম, খুবই ছোটো, কিন্তু গোছানো একটা হলঘর—তার মধ্যে অজ্ঞাত কারণে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কাটা।

চারদিকের দেওয়াল জুড়ে ছবি চার্ট দিয়ে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের কথা লেখা আছে।

একপাশ থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা গ্যালারি আছে, তাতেও ছবি আছে, এছাড়া বিশাল উঁচু ঘরের দেওয়াল জুড়ে আছে পশুচর্ম ও অন্যান্য পশুশরীর দিয়ে তৈরি জিনিসের নিদর্শন। বলা বাহুল্য সেসব অতি প্রাচীন, যখন শিকার-টিকার চলত… এসবের  অধিকাংশই এখন নিষিদ্ধ। খুব একটা ভালো লাগল না সেসব দেখতে, সত্যি বলতে। কেমন যেন গা শিরশির করছিল।

তারপর একটা মনাস্ট্রি। এটা আবার ভুল করে পাশের অন্য কী একটা সর্বধর্মসমন্বয় টাইপের জায়গায় ঢুকে পড়েছিলুম।

মনাস্ট্রির দরজায় গণেশ দেখে ভড়কে গিয়ে এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম সেটা পাশের গলিতে। সে গলিতে গিয়ে সাদা পতাকা দেখে নিশ্চিন্ত হলুম, এইটে মনাস্ট্রিই বটে। নাম টংসা গুম্বা।

একটা ভারি গোলগাল বাচ্চা তার বাবা-মা দিদিমার সঙ্গে এসেছিল সেখানে, খালি খালি টলমল পায়ে পড়ি-পড়ি হচ্ছিল। তার মা অনেক ছবি তুলছিলেন তার। তিনিই জানালেন মূল কক্ষ এখন বন্ধ, পরে খুলবে। কিন্তু তাতে অসুবিধা নেই, এ ভারি জাগ্রত জায়গা, ওই সারি সারি জপযন্ত্র ঘোরাতে ঘোরাতে তিন পাক (বাঁদিক দিয়ে) দিলেই আমাদের ঢের পুণ্য হবে।

পুণ্যের লোভে নাহোক, জপযন্ত্র ঘোরাতে হেব্বি লাগে বলে দিলুম পাক।

তারপর গেলুম কালিম্পং সায়েন্স মিউজিয়াম। এইটিতে গতবার তিতির অনেকটা সময় কাটিয়েছিল, খুব মজাও লেগেছিল, তাই আরো একবার। কিন্তু সে গল্প আসবে পরের পর্বে।

(ক্রমশঃ)

Leave a Comment