চলার পথে – ২৮ (cholar-pothe-28)
উত্তরবঙ্গ ডিসেম্বর, ২২ (কালিম্পং-পেডং-মুন্সং-দার্জিলিং) – পর্ব ২
দিন ২ (২৪ ডিসেম্বর, ২০২২) – আগের পর্বের পর থেকে
—————————————————————————-
কালিম্পং সায়েন্স সেন্টারটি গতবারেও কন্যার মনোহরণ করেছিল, এবারেও। ছোটোর মধ্যে ভারি সুন্দর সাজানো গোছানো জায়গা।
এবারে আমরা একটা থ্রি-ডি কী যেন ভয়ের সিনেমাও দেখেছি সেখানে – ব্যাপারটা বেজায় হাস্যকর যদিও!
এছাড়া অজস্র আয়নার কারসাজি…
গোলকধাঁধা…
আরও কত কী! বেশ সুন্দর কাটে সময়টা, সত্যিই।
বেরিয়ে দেখি মাঠের ওপর দিয়ে প্যারাগ্লাইডার ভেসে যাচ্ছে। ড্রাইভার এবং স্থানীয় একজন এসে জানতে চায় আমরাও করতে ইচ্ছুক কিনা। সভয়ে ও সজোরে না বলে দিই।
বেরিয়ে পড়ার আগে বাইরের ডাইনোটার সঙ্গে ছবি তুলে নিই একখানা।
অতঃপর একটা ছোট্ট মনাস্ট্রি, পেডং যাওয়ার পথে। ভিতরে যাওয়া গেল না, বাইরের ছোট্ট সাজানো বাগানে চারটি ছবি তুললাম তাই।
একপাশে দেখি লেখা আছে “গুরু পদ্মসম্ভব ভিউ পয়েন্ট”। মেঘ থাকায় ভিউ বিশেষ টের পেলুম না যদিও।
গাড়িতে চড়ে বসি। শেষ দ্রষ্টব্য এক হনুমানমূর্তি। এই জায়গার সঙ্গে তার সংযোগ কী ঠিক বুঝতে পারলুম না, কিন্তু বেশ একটু চড়াই বেয়ে উপরে উঠে আশপাশ দেখতে খাসা লাগল। তাছাড়া একজন ডেকে একমুঠো করে নকুলদানা দিলেন খেতে।
তারপর সোজা পেডং।
পেডং দু অংশে বিভক্ত, আপার পেডং আর লোয়ার পেডং। মূল রাস্তাটা বিভাজনকারী। আমাদের যাওয়ার ছিল আপার পেডং-এ, একটু রাস্তা গুলিয়ে খানিক এদিক ওদিক ঘুরে তারপর লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছলাম Hidden Heaven Homestay।
ছোট্ট একটা চাতাল রাস্তার ধারে। দুটো গাড়ি পাশাপাশি দাঁড়াতে পারে, এমন। সেখানে নামি। অমনি এক হাসিমুখ ছেলে ছুটে এসে মালপত্র নামাতে শুরু করে দেয়। চাতাল থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে, পাহাড়ের গায়ে সেঁটে আছে হোমস্টের ঘরবাড়ি। নেমে যাই। একটা সাদা-কালো ছোটো কুকুর কোথা থেকে দৌড়ে এসে পায়ে পায়ে চলে ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে।
প্রথম দরজা পেরিয়ে, ছোট্টো উঠোনের মত চত্বর পাশ কাটিয়ে পরের দরজায় ঢুকি। দোতলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা। মুখোমুখি দুটি মাত্র ঘর। আর কেউ নেই এখন।
সুন্দর, পরিপাটি। দুটো পাশাপাশি বিছানা, সোফা আর দেওয়াল আলমারি। একপাশে বারান্দা খোলা।
বারান্দা থেকে ছবি তুলি একটা-
ডানদিকে হোমস্টেটা, সামনে খোলা জমি ছোট্ট ছোট্ট নীল ফুলে ভরা।
খাওয়ার ডাক আসে। ভারি সুন্দর করে ইংলিশে কথা বলে ছেলেটি, পরে জেনেছিলুম তার নাম আয়ুষ। একতলার ছিমছাম খাবার ঘরে কেতাদুরস্ত সাজিয়ে রাখা খাবার দাবার – এমনকি ঈষদুষ্ণ গরম জল। (পাহাড়ি জায়গায় সবাই ঠাণ্ডা জল খেতে বারণ করেন, গরম জল খেতে বলেন। শরীর ঠিক থাকে।)
ভাত, ডাল, স্কোয়াশের তরকারি, রুই মাছ, পাঁপড়ভাজা। চমৎকার রান্না। পেট ভরে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে দেখি ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়েছে চিলতে উঠোনে, পাশে সেই গোয়ালঘর। টুক করে একটা ছবি তুলে ফেলা গেল।
আমাদের সাড়া পেয়েই হাঁকডাক শুরু করেছিল পাশের কাঠের ঘরে থাকা দুই কুকুর। শুনলুম দিনের বেলা ওরা ওদের ঘরেই থাকে, রাত্রে তেজী, পাহাড়ি কুকুর দুটোকে রাত্রে রাখা হয় পাহারা দেওয়ার জন্য। একজনের নাম সিম্বা, আরেকজনের নাম নালা।
বেলা পড়ে এসেছিল, আমরা ক্লান্তও ছিলুম। বেরোতে তখন বারণ করল সবাই, আর বেরিয়ে আলো থাকতে থাকতে কোথাও যেতে পারতুমও না। কাজেই ঘরে গিয়ে বই, লুডো আর সান্টা ক্লজ তিতিরের গিফটটা কোথায় দেবে, তা নিয়ে জল্পনা… এসবেই সময় কাটল সন্ধ্যা অবধি। মধ্যে ছ’টায় চায়ের ডাক পড়েছিল, নিচে গিয়ে ঘরে বানানো প্রেটজেল আর ইংলিশ টি খাওয়া হল। টি-পট জামা পরেছে দেখে তিতির খুবই মজা পেয়েছিল।
তারপর সন্ধ্যা আটটা নাগাদ আরেকজন এল।
ক্রিসমাস ইভ-এর প্রেয়ার হবে চার্চে, আমরা কি দেখতে যাব?
যাব না মানে! অবশ্যই যাব! এখুনি যাব!
সে ছেলে হুঁশিয়ার। টর্চ জোগাড় করে তবেই নিয়ে গেল। শর্টকাটের পাথুরে পথ, আমরা অনভ্যস্ত কিনা!
সে কী ঠাণ্ডা কী বলব! তাপমাত্রা দশের নিচে নেমে গেছিল সম্ভবত। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছিল সেই সঙ্গে। তারই মধ্যে, টর্চ নিয়ে পথপ্রদর্শকের সঙ্গে শর্টকাটের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মা আর ছা গিয়ে পৌঁছেছিলুম সেক্রেড হার্ট চার্চের আঙিনায়।
চার্চে উপাসনা চলছে। ঈশ্বরপুত্রের জন্ম নেওয়ার সেই চেনা গল্প, নেপালী ভাষা হলেও আন্দাজে আন্দাজে বুঝি। পাশে সেই চিরচেনা বেথলেহেমের আস্তাবলের দৃশ্য।
চার্চে অত রাত্রেও ভরপুর মানুষ। বাইরের চাতালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরো অনেকে যারা উপাসনায় অংশ না নিলেও, আমাদের মতোই আনন্দটুকুর ভাগ নিতে উন্মুখ। নতুন মানুষ দেখে ঘিরে আসেন তাঁরা, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব এসব প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে সরল অভ্যর্থনা, আরো কিছুদিন গ্রামে থেকে যাওয়ার সাদর আহ্বান। মন ভালো হয়ে যায়।
মনে হয়, পৃথিবী এমনই সুন্দর থাকুক। ক্রিসমাসের তারাটির আলোর মতোই, শুভবোধ ছড়িয়ে যাক মানুষের মনে।
তারপর বাজারেও ঘুরিয়ে দিয়েহচিল সে, নাম মনে নেই ছেলেটির। ভারি গল্পবাজ। এইখানেই এক স্কুলে তার পড়াশোনা, এখন পাস করে অন্যত্র চলে গেছে যদিও। আমার আগ্রহে সে খুঁজে খুঁজে নেপালি আচার জোগাড় করে দিল। বাজারের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন পাইন গাছটাও দেখাল, এই পাইন বনের থেকে জায়গার নাম নাকি পে-ডং।
রাত্তিরে একদম থালা চেটে খাওয়ার মতো চিকেন আর রুটি খাওয়া হল। সঙ্গে আলুভাজা, বিনের শুকনো তরকারি, ডাল এগুলোও ছিল অবশ্য। তারপর আর দাঁড়ানো নেই- হাতমুখ ধুয়ে নিয়েই সোজা লেপের মধ্যে ডাইভ।
=========================================================================================
দিন ৩ (২৫ ডিসেম্বর, ২০২২)
———————————————————————————-
ক্রিসমাস। সকাল সকালই ঘুম ভেঙেছিল। কন্যাকে আজ ডেকে তুলতে বেশি বেগ পেতে হয়নি, “এইইই! তোর বালিশের পাশে চকচকে ওটা কী রে?” বলতেই সে একলাফে উঠে পড়েছিল।
সান্টা ক্লজ লোক ভালোই, একটা বই আর একটা প্লে-ডো দিয়েছে তিতিরকে। কিন্তু মুশকিল হল তিতির তারপর সারা বিছানা, সারা ঘর হাঁটকে বেজায় উৎপাত করতে লেগে গেল, তার ধারণা ওকে যখন গিফট এখানে দিয়েছে, তখন মাম্মার গিফটও ঘরেই কোথাও আছে। হয়তো বিছানাতেই ছিল, মাম্মা ট্যালার মতো কোথাও ফেলে দিয়েছে। সে খুঁজে বার করা না অবধি তার শান্তি নেই।
এদিকে মাম্মা তো…
অগত্যা, আজ সাইটসিয়িং যাওয়া হবে, ব্রেকফাস্টের ডাক এসে গেছে ইত্যাদি বলে মেয়েকে ঠেলে তৈরি হতে পাঠানো হল। তারপর দুজনে রেডি হয়ে মাম্মা যেই মোজা পরতে যাবে, দেখে সেই গুটলি পাকিয়ে রাখা মোজার একপাটি বেজায় ভারি!
তিতির প্রবল খুশি হয়েছিল সান্টা ক্লজের এই ফক্কুড়ি দেখে—মায়ের মোজার মধ্যে চুপি চুপি কেমন একটা তাসের প্যাকেট রেখে গেছে, দেখো! পরে জনে জনে ফোন করে জানিয়েছিল সান্টার কীর্তি।
আজকের ব্রেকফাস্ট জম্পেশ – টোস্ট, ঘরে বানানো মাখন, ডিমসেদ্ধ ভাসমান স্যুপি নুডলস, দুধ আর দুরকম ঘরে বানানো কেকের টুকরো।
তারপর সেই জামা-পরা লম্বা সাদা হাঁসের মতো দেখতে টি-পট থেকে ঢালা সুগন্ধী চা, বলা বাহুল্য!
ইতিমধ্যে আজমল গাড়ি নিয়ে এসে পড়েছে। লম্বা, ছিপছিপে হাসিমুখ তরুণটিকে দেখেই ভালো লেগে গেল। ব্যাগটুকু গুছিয়ে নিয়ে উঠে বসতে যেটুকু সময় লাগে!
চললাম, সাইটসিয়িং করতে। সে গল্প বলছি পরের পর্বে।
(ক্রমশঃ)