চলার পথে — পর্ব 3

চলার পথে — পর্ব 3

মানোরি বীচ

মহারাষ্ট্র

বেড়ানোর শখ কম বেশি সব বাঙালিরই থাকে। আমারও আছে। লোকে ঝাড়া হাত পা সময়ে বেশি ঘোরে বেড়ায়, আমার সে সময়ে বিশেষ হয়নি। তিতির একটু বড় হওয়ার পর সেই যে আমাদের টবেঈ-বেঈট শুরু হল, মুম্বই থেকে কাছেপিঠের প্রায় সব জায়গা ঘুরে ফেলেছি এই ক’বছরে।
তবু, অনেকদিন ধরে আমার নিজেরও একটা ব্রেক দরকার হয়ে পড়েছিল। তারপর, গণপতি সোমবার, মানে লম্বা উইকেন্ড। কিন্তু লোনাভালা-খান্ডালা-আলিবাগ-মাথেরান সব তো কতবার ঘোরা হয়ে গেছে, তায় বৃষ্টি চলছে লাগাতার, কাছাকাছির মধ্যে কই যাই, ও জীবনপথের পথিক?
টুকুং করে মানোরি, গোরাই, উট্টান এসব নামগুলো মাথায় লম্ফঝম্প করে উঠল। নেট ঘেঁটে, হালহকিকত বুঝে নিয়ে, ফোনে ঘর বুক করে, চেনা গাড়িওলার সঙ্গে কথা বলে প্রস্তুতি নিতে কতটুকুই বা সময় লাগে তারপর!
মুম্বই পেরোনোর খানিক পরেই কুট্টি কুট্টি পাহাড় দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার দুধার জুড়ে। পশ্চিমঘাটের অঙ্গ সব, ক্ষয়ে ক্ষয়ে কারো মাথা একদম থ্যাবড়া গোল, কারো চ্যাপ্টা, কারো বা কাঁচকলা দেখানোর মত সরু লম্বা। তাদের কালো পাথুরে গা জুড়ে বর্ষার জলে ফনফন করে গজিয়েছে ঘাস আর বুনো গাছ। দুদিকে কখনো ছোট বাড়ির সারি, কখনো মাঠ। যত এগোই, রাস্তা তত ফাঁকা আর সরু হয়। বৃষ্টি আসে, যায়। আমরা গাড়ির মধ্যে উলটো করে নামতা বলি, কানফিসফিস খেলি।
হোটেলে চেক ইন করে, কফি খাই একপ্রস্থ। তিতির হ্যামক পেয়ে মহানন্দে দোল খায়। এই যা! অঝোরে বৃষ্টি নামল দেখি! পালাও পালাও ঘরে। আরেক দফা চা দিয়ে যায়, এবারে ‘বেবি’ও মিল্ক টি খাবেন বলেছেন। ব্যাগ থেকে বিস্কুট চানাচুর বেরোয়, আর এরকম বিপত্তির কথা ভেবে আনা তাসের প্যাকেট। হুঁ, আমরা টিভি দেখাটা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি।
আরে, বৃষ্টি কমেছে যে! চ’ চ’! ছাতা, রেনকোট, হাপ্প্যান্ট সব নিয়ে সমুদ্র অভিমুখে বেরিয়ে পড়ি। খুব ছোট্ট বীচ, তায় জোয়ার চলছে। বীচ অদৃশ্য, শুধু জল দেখি।
শুধু?
তিনদিকে যতদূর চোখ যায় জল, জলের নিরন্তর চলাচল, অন্তহীন ঢেউয়ের মাথায় ফেনার মুকুট নিয়ে আছড়ে পড়া, ওই দূরে দিগন্তে সমুদ্র আর আকাশের মিলনস্থল যেন তুলির আঁচড়ে আঁকা, মাথার উপর ঝুঁকে নেমে আসা কালো মেঘের সামিয়ানা, ছাতার উপর হালকা চালে বৃষ্টির নাচন। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি গো!

মেয়ের হাত ধরে জলে নেমেই পড়ি। আরেকটু,  আরেকটু… করতে করতে ঝপাং করে ইয়াব্বড় ঢেউ এসে পুরো কোমর অবধি ভিজিয়ে দেয়, অমনি “পালা পালা দৌড়ে পালা”, আবার ঘুরে দাঁড়ানো, আবার পায়ে পায়ে ঢেউ পেরোনো, মেয়ের ফ্লেমিঙ্গো নৃত্যের শখ হওয়ায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে পড়া, তাই দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে উদো ও বুদ্ধু মায়ের ” অসীমের ডাক শুনি কল্লোল-মর্মরে/এক পায়ে খাড়া থাকি একা আমি বালুচরে” বলতে বলতে একপেয়ে হতে গিয়ে ল্যাগব্যাগার্নিশে পরিণত হওয়া,  আরো বৃষ্টি, আরো হাওয়া, আরো অ্যাকাব্যাঁকা ঢেউ…ঘরে ফিরে আবার বৃষ্টিধোয়া সবুজে সবুজ বাগান দেখতে দেখতে পুরুষ্টু ফিশফ্রাই…
ছুটিটা আক্ষরিক অর্থে “জলে” দিয়ে ফেরার পথ ধরি। আসার সময়েই চোখে পড়েছিল, এখন আবার দেখি, একদা এই সব সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে পোর্তুগীজ প্রভাব ছিল প্রবল, এখনো তার ছাপ রয়ে গেছে কোনো বাংলোর গড়নে, গাছের নিচে বা রাস্তার ধারের কুচি জমিতে চিলতে বাঁধানো উপাসনাস্থলগুলির ক্রশচিহ্নে, নাতনির হাত ধরে টুকটুক করে দোকান যাওয়া ঠাকুমার ফুল-ফুল ছাপ লম্বা ফ্রকে। তা বাদে, ঠিক উত্তর কলকাতার গলির মত সরু সরু পাক খাওয়া রাস্তা, ছোট ছোট বাড়ি রাস্তার ধারে, পাড়ার দোকান, কাঠের দরজা আধখোলা, পাশে জলের কলের সামনে চাতালে ধপাধপ কাপড় কাচা মাঝবয়সিনী, হেলে পড়া অশ্বত্থের নিচে হাতজোড় করে নমস্কার করা সাধারণ মানুষ, হাতে বাজারের থলি নিয়ে দুই বৃদ্ধর আলাপচারিতা।
ভারতবর্ষ, এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, একই কাপড়ের বুনন যেন। আলাদা আলাদা রঙে ছোপানো খালি, আলাদা আলাদা নকশা। প্রার্থনা করতে ইচ্ছে হয় যে এই বুননটি অটুট থাকুক চিরকাল।
তারপর গাড়ি আবার ফাঁকা রাস্তায় ছুটে চলে চেনা শহরের দিকে। একটুকরো জল-ছলোছলো ছুটি স্মৃতি হয়ে থেকে যায়।

Leave a Comment