চলার পথে – ৩০ (cholar-pothe-30)

চলার পথে – ৩০ (cholar-pothe-30)

উত্তরবঙ্গ ডিসেম্বর, ২২ (কালিম্পং-পেডং-মুন্সং-দার্জিলিং) – পর্ব ৪

দিন ৩ (২৬ ডিসেম্বর, ২০২২)

—————————————

আজ বিশাল ভোরে উঠে পড়ি। সূর্যোদয় দেখতে যাব উপরের পয়েন্টে, আয়ুষ নিয়ে যাবে। বেজায় ঠান্ডা, ভালো করে মাফলার প্যাঁচাই।

আলো ফুটি-ফুটি তখন। আয়ুষের সঙ্গে বেশ খানিকটা চড়াই হেঁটে উপরের সেই পয়েন্টে এসে পৌঁছই। সেখানে ডানদিকে সূর্যোদয় এবং বাঁদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু বিধি বাম, প্রচুর মেঘ। খানিক এমনিই ছবি তুলি।

অবশেষে সূর্য ওঠে।

কিন্তু মেঘ কাটে না কাঞ্চনজঙ্ঘার দিক থেকে। আয়ুষ ভারি মুষড়ে পড়ে, যেন বা ওরই দোষ। বাচ্চা ছেলে… সান্ত্বনা দিই, ফোন থেকে খুঁজে প্লেনে তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি দেখাই। আস্তে আস্তে অনেক গল্পই করে সে তারপর—তার জন্ম মেঘালয়ে, ছোটোবেলার একটা অংশ সেখানে কাটিয়েছিল। সেখানকার যা যা স্মৃতি আছে বলে যায় উৎসাহ পেয়ে। বাবার আর্মির কাজের দৌলতে এদিক ওদিক ঘুরেছে বেশ কিছু। অবশেষে এখানের স্কুলে, বোর্ডিং এই আঙ্কলের কাছে।

ছোটো ভাইয়ের কথা বলে, মায়ের কথা বলে। আমার মনাস্ট্রি ভালো লাগে শুনে নিজেই বলে, আরেকটু ওপরে একটা মনাস্ট্রি আছে, যাবেন?

যাই, বলা বাহুল্য। অত সকালে সব বন্ধ। ছোট্ট, অনাড়ম্বর। চার্চটির মতোই।

আয়ুষের একটা ছবি তুলি ফুলগাছের সামনে। খুব লজ্জা পায়, আবার খুব খুশিও হয়।

রাস্তা দিয়ে নেমে আসতে আসতে দেখি লোকজনের ঘুম ভাঙছে। তাদের কেউ কেউ আয়ুষকে ডেকে খোঁজ নেয়। একজনের বাড়ির একটা গাছ দেখিয়ে সে বলে, পাহাড়ি টমেটো। অন্যরকম হয় খেতে।

উৎরাই নামা সহজ, ধাঁই ধাঁই করে নেমে আসি। কাছাকাছি যখন এসেছি, আয়ুষ বলে, এই যে আপনারা মা-মেয়ে ঘুরছেন, আমি ছোটো থাকতে অমন করেই বাবার সঙ্গে ঘুরতাম। ভাই মায়ের কাছে থাকত, বাবা আমায় নিয়ে বেড়াত কত কত জায়গায়!

বুঝি, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে।

“বাবাকে খুব ভালোবাসো, না বেটা?”

নিচু গলায় বলে, “সবচেয়ে ভালোবাসি।”

কে জানে কী পরিস্থিতিতে এভাবে ছেলেকে দূরে রেখে দিতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। ছেলে ভালো পড়াশুনো করবে সেই আশাতেই নিশ্চয়।

তিতিরের যা বয়স, সেরকম বয়স থেকেই বোর্ডিং-এ থাকে। কতটুকু বা বাড়ি যায়, কতটুকু বা বাবার, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটার কাছে থাকতে পারে!

মন খারাপ লাগে। পড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আবার একসঙ্গে থাকতে পারবে আশা করি। ততদিনে সে ভদ্রলোকও নিশ্চয় রিটায়ার করে যাবেন।

ভাবনায় ছেদ টেনে হইহই করে ওঠে আয়ুষ। “আঙ্কল পরোটা ভেজেছে! আপনারা ফ্রেশ হয়ে চলে আসুন শিগগির, আমি ব্রেকফাস্ট লাগিয়ে দিচ্ছি।”

ঘরে এসে বারান্দা থেকে আবার সূর্যের ছবি তুলি। কী কুয়াশা, কে বলবে এটা দিনের ছবি। দিব্যি জ্যোৎস্নারাত বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

ব্রেকফাস্টে পরোটা, ঘুগনি, ডিমসেদ্ধ খেয়ে রেডি হয়ে নিই। ততক্ষণে আমাদের মুন্সং নিয়ে যাওয়ার ট্যাক্সি এসে গেছে। বেরোনোর আগে একটা গ্রুপ ফোটো তোলা হয়।

—-

মুন্সং যাওয়ার পথে একটা ভিউপয়েন্টে দাঁড়াই। নিচে তিস্তা।

আরেক জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভার ভাই দেখান, নিচে ওই দূরে ট্রেনলাইন বানানোর কাজ চলছে— তৈরি হয়ে গেলে সিকিম সোজা ট্রেনে করেই চলে যাওয়া যাবে।

ভালো লাগে না। সভ্যতার আগ্রাসন মানেই পাহাড় জঙ্গলের নির্জনতার শেষ ঘনিয়ে আসছে, মনে হয়। কিন্তু কী আর করার আছে!

তারপর যাই জলসা বাংলো।

ভারি মনোরম জায়গা। টিকিট কেটে ঢোকার পর এই হল যাওয়ার রাস্তা।

এই বাংলো

ট্রিহাউসটা তালা দেওয়া ছিল, কিন্তু সিঁড়িতে উঠে খাসা লাগল দেখতে।

সেকেলে গড়নের বাংলো বাড়ি, ছড়ানো হাতায় বিশাল বিশাল গাছপালা সব।

 

আচ্ছা, এই ছবিটাকে কি ‘শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া’ বলা যায়?

মুন্সং খুবই কাছে দেখা গেল। দ্যাখ-না-দ্যাখ পৌঁছে গেলাম। রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্ব, হোমস্টের মালিক। একগাল হেসে ব্যাগ তুলে নিয়ে চলল পথ দেখিয়ে।

ধাপে ধাপে নেমে, এর উঠোনের পাশ দিয়ে, তার দাওয়ার নিচ দিয়ে, সবজিক্ষেতের গা ঘেঁষে সরু মেঠো পথ বেয়ে খানিক যাওয়ার পর তাদের বাড়ি।

দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সামনে সবুজ লন, লন ঘিরে বাহারি গাছ, রংবেরঙের ফুল।

আমাদের একতলার একটা বড়ো ঘর দেওয়া হয়। সে ঘরের সাজসজ্জা একদম নিজেদের লোককে ডেকে থাকতে দেওয়ার মতো।

বিশ্ব আর তার মিষ্টি গিন্নির ব্যবহারও তেমনই। দুজনেই কমবয়সী। ডেকে নিয়ে যায় দোতলায়, বড়ো বারান্দায় বসে আরাম করতে বলে, চা খাওয়ায়। বারান্দা দিয়ে নিচে দেখি, একজন বাসন ধুচ্ছে কলে, পাশে একটা লোমশ কুকুর লাফালাফি করছে – তাকে দেখে তিতিরও ঠিক তেমনি লাফালাফি করে আমার পাশে। যিনি বাসন ধুচ্ছিলেন আওয়াজে ফিরে তাকান, হাসেন।

কর্তা-গিন্নি দুজনে মিলে খাবার নিয়ে আসে উপরে। মুখ ফুটে লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলি, বিকেলে বা পরদিন ব্রেকফাস্টে মোমো খাওয়া যায়? আমার মেয়েটি বড়োই মোমোভক্ত কিনা…

নিজেদের মধ্যে দ্রুত কীসব কথা বলে বিশ্ব বলে, তোমরা পর্ক খাও কি? তাহলে এখনই দিতে পারে, আমাদের নিজেদের পর্ক মোমো করা হয়েছিল… খাও যদি…

খাই বলায় কী খুশি হল ভাবতে পারবেন না। ছুটে গিয়ে প্লেট ভরে নিয়ে এল।

সে কী স্বাদ! অপূর্ব!

খোলা বারান্দা, হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, মোটা জ্যাকেট পরেও শীত টের পাচ্ছি। সামনে খোলা আকাশ, আর প্লেটে গরম মোমো। স্বর্গ মশাই, স্বর্গ!

তারপর ভাত, ডাল, ওদের নিজেদের খেতের পালংশাক ভাজা আর চিকেন।

এত ভালো খেয়ে শুয়ে পড়তে বড়ো ইচ্ছে করে, কিন্তু এখানে তো এই এক রাত্রিই থাকছি। তাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি মিনিট পনেরো বিশ্রাম নিয়েই। বাইরে এসে দেখা হয় বিশ্বর বাবা-মায়ের সঙ্গে, তাঁরা লনে বসে ছিলেন। ওদের মতোই খুবই আপন করে নেওয়া ভালো মানুষ, আঙ্কল আমাদের নিয়ে গিয়ে গ্রামের জলের পাইপলাইন দেখালেন, বাগানের গাছ দেখালেন এটা ওটা।

তারপর আমরা হাঁটতে বেরিয়ে পড়লুম।

যে পথে এসেছিলুম, সেই পথ বেয়ে উপরে পাকা রাস্তায় উঠে খানিক দোনামনা করে বাঁদিকে হাঁটা লাগালুম। কিছুদূর গিয়ে দেখি পায়ে চলা পথ একটা উঠে গেছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। আমরাও সেদিকে হাঁটা মারি।

তার খানিক আগে একটা অত্যন্ত খেঁকুড়ে মেজাজের পমেরিয়ান কুকুর উপরের একটা বাড়ি থেকে তেড়ে আসে আমাদের দিকে, তবে কিছুটা দূর অবধি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার ডাক শুনে আরও বন্ধুবান্ধব এসে জড়ো হতে থাকে, তবে তারা আমাদের দিকে চেয়ে বিগলিতভাবে ল্যাজ নাড়ায় খালি। তাদের পিছনে ফেলে রেখে পাকা রাস্তা ছেড়ে পায়ে চলার পথটায় ঢুকে পড়ি।

হালকা চড়াই, ঘন জঙ্গল একদিকে, অন্যদিকে হালকা গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিচের মুন্সং গ্রামের ঘরবাড়ি খেতজমি। তিতির কাঠি কুড়োয়, পা দিয়ে ঝরাপাতা ওড়ায়, প্রজাপতি খোঁজে। আমি টুকটুক করে দেখেশুনে পা ফেলি, থেমে থেমে ছবি তুলি।

উপর থেকে আমাদের হোমস্টে দেখতে পাই।

অনেকটা এঁকেবেঁকে ওঠার পর ঘড়ির হিসাবে মনে হয় এবার ফেরা উচিত। অন্ধকারে অচেনা পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা ঠিক হবে না, আর গ্রামেও তো সেই অর্থে আলোর ব্যবস্থা নেই সেরকম! নামি।

পাকা রাস্তায় পড়তেই আবার সেই কুকুরটা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে চেঁচাতে থাকে, তবে এবার আর কাছে আসে না। ফিরতে ফিরতে আরো অনেক পোষা কুকুর দেখি এবার। তিতির একটা লিস্ট করেছিল ওর ডায়রিতে, সেটা অনুযায়ী মুন্সং-এ এতরকম কুকুর দেখা গেছে –

  • বাদামী লক্ষ্মী ছেলে
  • ইয়াব্বড়ো, ঝুপুসঝাপুস লোম
  • খেঁকুরে পমেরিয়ান… খুব চিল্লায়
  • রোগা, লোম ছাঁটা ছোট্টপানা
  • ছাই ছাই রঙের ধেড়ে
  • ছোট্ট ছানা—সম্ভবত মা আর ছানা

(আহা, সে ইঞ্জিরিতে লিখেছিল, আমি বাংলা করে দিলুম। তার ডায়রি থেকে মাঝে মাঝে তথ্য নিচ্ছি তো, সেটা উল্লেখ করিনি বলে আবার বকছে আমায় এখন। এই বলে দিলুম বাপু!)

গ্রামের পথ ধরি। ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া গ্রামটা পাহাড়ের গায়ে যেন ঝুলে আছে। রাস্তার এদিকে একজন জামাকাপড় তুলছেন তার থেকে। ওদিকে নিচে তকতকে উঠোন, একপাশে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো।

মুলোর ক্ষেতে মুরগি চরছে – ভেজ আর নন-ভেজের সহাবস্থান!

ঠান্ডা বাড়ছে আবার, ঘরে ঢুকে পড়ি আর না দাঁড়িয়ে। অমনি চা, আর নিমকির মতো দেখতে মালপোর মতো খেতে কী জানি শুকনো সব ঘরে বানানো খাবার আসে।

সন্ধ্যা কাটে বই পড়ে, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে।

রাত্রে ভাত, ডাল, কপির তরকারি, পেঁয়াজি, চিকেন ঘরেই সার্ভ করে দেয় ওরা। আরামসে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

(ক্রমশঃ)

 

 

Leave a Comment