চলার পথে- ৩১ (cholar-pothe-31)

চলার পথে- ৩১ (cholar-pothe-31)

উত্তরবঙ্গ ডিসেম্বর, ২২ (কালিম্পং-পেডং-মুন্সং-দার্জিলিং) – পর্ব ৫

দিন ৪ (২৭ ডিসেম্বর, ২০২২)

আজ দেরি হয় ঘুম ভাঙতে। ব্রেকফাস্টে লুচি তরকারি খেয়ে তৈরি হই। ১০টায় গাড়ি এসে যায়, বিশ্বরা সবাই আন্তরিক ভাবে বিদায় জানায়, তাদের প্রথামতো।

ছোটামাঙ্গোয়া যাওয়ার পথে তিস্তা পেরোই। গাড়ি থামে, ছবি তুলি।

তারপরের পথটুকু এত সুন্দর… পাহাড়ে, সবুজে ডুবে থাকি। পথে পড়ে গুম্বাদারা—গতবার তাকদা থেকে যেখানে ঘুরে গেছিলুম।

সেইসব মনে পড়ে যায়। তাকদার রাস্তা নিচে নেমে যায়, আমরা এবার উপরের পথ ধরি। রাস্তা একটু গুলোয়—তখন কথাপ্রসঙ্গে জানি ড্রাইভ যিনি করছেন তিনি বিশ্বর সাক্ষাৎ শ্যালক, আমি একা মেয়েকে নিয়ে ঘুরছি বলে তাঁরা বাইরের কাউকে ডাকেননি, নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন। কৌশিকও যেমন, এই পাহাড়ি মানুষেরাও তেমন – খুব কেয়ারিং গেস্টদের ব্যাপারে। ভালো লাগে।

একে ওকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছনো যায় অবশেষে ‘দার্জিলিং ব্লসমস’। ঢুকেই তিতির মুগ্ধ চীৎকার শুরু করে দেয়, কারণ সামনেই এক খাঁচা খরগোশ ও গলা বাগিয়ে চেয়ে থাকা এক রাজহাঁস।

জিনিসপত্র এক হাসিমুখ মহিলা নামিয়ে ফেলেন পটাপট। আমরা ২ নম্বর ঘরটা পাই, রিসেপশনের কাছেই।

একদিক পুরো কাচের জানলা, ভারি সুন্দর ভিউ।

তবে ওই, এবার আমাদের মেঘের কপাল! উপর দিক মেঘে সব ঢাকা।

এখানে দুদিন থাকব। জিনিস একটু গুছিয়ে নিয়ে ফ্রেশ হই, লাঞ্চ করতে যাই। গাড়িতে আসার পথেই ফোন করে লাঞ্চে কী খাব জেনে নিয়েছিলেন এঁরা, সেই মতো ভাত, ডাল, কপির তরকারি, মাছের ঝোল চলে আসে। সুন্দর রান্না। খেতে খেতেই বিকেলের আর রাত্রের অর্ডার দেওয়া হয়ে যায়।

তারপর রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি অরেঞ্জ গার্ডেন দেখতে।

একদম নিরিবিলি কী সুন্দর রাস্তা, হাঁটতেও ভালো লাগে। ছবি তুলি।

মুহূর্তের মধ্যে দুটো কুকুর কোথা থেকে এসে জুটে যায়, তিতিরের দৌড়াদৌড়ির সঙ্গী হয়।

কিন্তু এ যে হেঁটেই চলেছি! কই র‍্যা তোর অরেঞ্জ গার্ডেন!

তিতিরের শ্যেনদৃষ্টি আবিষ্কার করে কমলালেবুর খোলা পড়ে আছে। তারপর এককোণে একটা গাছ দেখা যায়, তাতে রোগা রোগা কিছু কমলালেবু ঝুলছে।

এ কী ছিরির বাগান!

অদম্য আশায় ভর দিয়ে আরো কিছুটা এগোই। একটা বেশ বাগান মতো চোখে পড়ে এইবার।

কিন্তু তাতে ঢোকার কোনো রাস্তা দেখা যায় না। আমরা সেটার সামনে বার দুই হাঁটাহাঁটি করি, করতে করতে বাগানের অন্যপ্রান্তে রীতিমতো জনবসতিওয়ালা গ্রামে পৌঁছে যাই, কিন্তু সর্বত্র যেমন পোক্ত এক মানুষ উঁচু বেড়া দেওয়া তেমনিই, একটাও গেট বা একটুও ফাঁক নেই।

চটেমটে আমি ওই বেড়ার মধ্যে দিয়ে গলেই ঢোকার তাল করছিলুম, কিন্তু যুগপৎ তিতিরের “মা, মা, ও কী করছ!” করে আর্তনাদে আর মাথা ঢোকানোর পর ফাঁকটা আমার জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত কিনা সন্দেহ জাগরূক হওয়ায় সে চেষ্টায় ক্ষান্তি দিলুম। মানে, আমি আধখানা ঢুকে যদি আটকে যাই, আর সেই অবস্থায় মেয়ের অমন চিলচীৎকারে বাগানের মালিক-টালিক কেউ ছুটে আসে— ব্যাপারটা মোটেই ভালো হবে না।

মন খারাপ করে ফিরে আসছি, হঠাৎ চোখ যায় রাস্তা থেকে বেশ অনেকটা নিচে।

এত এত কমলালেবুর গাছ?

দুজনে চোখাচোখি করি, তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে নামি সিঁড়ি বেয়ে। গাছগুলোর কাছাকাছি যেতে এক মহিলা বেরিয়ে আসেন বাড়ি থেকে, ভাঙা হিন্দিতে জানতে চান আমরা অরেঞ্জ গার্ডেন দেখতে চাই কিনা?

এই তাহলে সেই জায়গা!

সামান্য কিছু দিয়ে টিকিট নিতে হয়। তারপর তিনি নিজেই আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান। কোন গাছের কত বয়স, কী দেখে বয়স বোঝা যায়, কতদিনে ফল হয় ইত্যাদি নানা গল্পের সঙ্গে।

মাঝপথে এক মিষ্টি খুকিও এসে দলে যোগ দেয়, ভদ্রমহিলার মেয়ে। তিতির দিদিসুলভ খোঁজখবর করে, নাম কী, কোন ক্লাস, কোন সাবজেক্ট ভালো লাগে… সে ভারি খুশি হয়।

বাগান ঘোরার পর মাকে ফিসফিস করে কী যেন বলে, ভদ্রমহিলা আমাদের দুজনকে দুটো কমলালেবু গিফট করেন, মেয়ের ইচ্ছা! তারপর আমাদের নিয়ে গিয়ে বসান  তাঁদের খোলা ছাতে, চা আর ঘরে বানানো কেক খাওয়ান। যতই গার্ডেন দেখতে আসা ট্যুরিস্ট হই, ক্রিসমাসের সময়ে ঘরে আসা মানুষকে না খাইয়ে যেতে দিতে নেই না!

চা খেতে খেতেই চোখ যায় ছাতের এক কোণে। সারি সারি শিশিতে আচার শুকোচ্ছে।

“আপনার বানানো?”

প্রশ্ন করার আগেই জানতুম উত্তর হ্যাঁ-ই হবে। এক সারিতে মিক্সড আচার – পাহাড়ি টমেটো (সেই যেটা আয়ুষ দেখিয়েছিল পেডং-এ), বিনস আর আদা। অন্যটায় বিখ্যাত লাল ডল্লে খোরসানি লঙ্কা।

দেখেই জিভে জল এসে যায়। আমি এমনিতেও একটু আচারপ্রিয়, দেখলেই কিনতে ও খেতে ইচ্ছে করে। দুটোই এক শিশি করে নিতে চাইলুম। সঙ্গে সঙ্গে স্কচ টেপ এনে আষ্টেপৃষ্টে মুড়ে দিলেন তিনি, এইসা ভালো প্যাকিং যে একটুও লিক করেনি তারপর অত ঘোরাঘুরিতেও।

এইখানে বলে রাখি, ডল্লে কেমন ঝাল সে তো জানেনই নিশ্চয় (মাথা থেকে ধোঁয়া বেরোয় প্রায় খেলে), আর অন্যটাও এত ভালো, টেস্টের চেয়েও, আদা-টাদা দিয়ে এমন করে করা, যে খেলে গলায় বেশ আরাম হচ্ছে, গরম লাগছে। মাঝে কাশি হয়েছিল আমার, ওটা একটু করে খেয়ে খুব রিলিফ পেয়েছি  সেই সময়ে।

ও হ্যাঁ, কমলালেবুগুলোও ছিল ‘মিষ্টি যেন গুড়’!

সেসব নিয়ে ঘরে ফিরলুম। ছ’টায় দরজায় নক করে মোমোর ক্যাসেরোল আর পকোড়ার প্লেট এল, সঙ্গে চা।

তারপর আবার গল্পের বই নিয়ে লেপের নিচে।

রাত্রে খাবার জায়গায় যেতে হল, ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুটা হেঁটে জায়গাটা। এই যে –

আজ আমরা এগরোল খাব বলেছিলুম, সে এল একদম ধোঁয়া ওঠা।

খেয়েদেয়ে, বেড়ানো আদ্ধেক হয়ে গেল রে… করে খানিক জাপটাজাপটি সেরে ঘুমের অতলে তলিয়ে যাওয়া গেল।

——

দিন ৫ (২৮ ডিসেম্বর, ২০২২)

 

আজ মনাস্ট্রি যাব, তাক করে রেখেছিলুম। অন্যদের মুখে শুনে যা বুঝলুম, আমাদের একটু ভুল হয়েছে। এখানে দুটো মনাস্ট্রি আছে, একটা পুরোনো, একটা নতুন। পুরোনোটা বেশ দূরে, লোকে আসার পথে গাড়িতেই সেইটে দেখে নিয়ে তবে আসে। রেগুলার ড্রাইভার না থাকায়, যিনি ছিলেন তিনি জানতেন না বলে বা যে কারণেই হোক, সেটা আর হয়নি।

কিন্তু আমাদের হাতে তো আজকে দিনটা আছে, তাই নিজেরা যেতে পারি কিনা খোঁজ করতে যাই রিসেপশনে। যাঁরা ছিলেন একবাক্যে বলে দিলেন, নতুনটা দেখে আসতে পারবেন, শর্টকাট আছে একটা পাশ থেকে… পুরোনোটা পায়ে হেঁটে আপনারা যেতে পারবেন না।

মন খারাপ হয়েছিল, লুকোব না। কিন্তু কিছু তো করারও নেই। শুধু ওই একটা মনাস্ট্রির জন্য গাড়ি ভাড়া নেওয়া পোষাবে না, তাই ঠিক করলুম যা হচ্ছে তাই হোক। কপালে যখন নেই…

বিধাতা অলক্ষ্যে হেসেছিলেন মনে হয়। কপালের কথা মানুষ আর কী জানবে!

ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা যখন দিচ্ছি, তখনও জানি না যে সারা বেলা ধরে এই বেড়ানোর সেরা ডে-ট্রিপটা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

কিন্তু সে গল্প হবে পরের কিস্তিতে। আপাতত আমাদের সঙ্গে শর্টকাটের সরু পায়ে চলা পথে ঝরা পাতা আর ঝুরো পাথর পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করবেন, চলুন!

(ক্রমশঃ)

 

Leave a Comment