চলার পথে – ৩২ (cholar-pothe-32)

চলার পথে – ৩২ (cholar-pothe-32)

উত্তরবঙ্গ ডিসেম্বর, ২২ (কালিম্পং-পেডং-মুন্সং-দার্জিলিং) – পর্ব ৬

দিন ৫ (২৮ ডিসেম্বর, ২০২২) – আগের পর্বের পর থেকে

রাস্তা চড়াই-উৎরাই, সরু। গায়ের উপর গাছের ডাল এসে লাগে, পায়ের নিচের নুড়ি গড়গড়িয়ে দৌড় দেয়। সাবধানে এগোই। ক্রমশ জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি বুঝতে পারি।


উঠে নেমে, পাহাড়ে পাক খেয়ে অবশেষে এসে আবার এসে পড়ি পাকা রাস্তায়। সেখান থেকে ডানদিকে মোড় নিতে হবে, বলে দিয়েছিল রিসেপশনের লোকটি। সেইমতো আবার বেশ খানিকটা যাই।

দুপাশে পাহাড়, পাথর আর নির্জনতা।

এতক্ষণ একটিও লোকের দেখা পাইনি, একটু একটু ভয় করে, রাস্তা ভুল হলেই হয়েছে!
এমন সময়ে দেখি রাস্তা থেকে ডানহাতে একটা পথ উঠে গেছে। সে পথ জোড়া লম্বা নিশান, উপরে সাদা শোর্তেন।

এইটেই হবে, নয়?
কিন্তু সেখানে তো পথের গোড়ায় নোটিস, নো এন্ট্রি!
যা থাকে কপালে, বলে উঠে যাই।
এইটে পেরিয়ে একটু এদিক ওদিক যেতেই মঠের গেট চোখে পড়ে।

তার পাশে এক বেঞ্চে বিভিন্ন বয়সের লামারা বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। একটু ভীতু চোখে তাকাই, এই বুঝি বকে দিল! তার বদলে ফিরতি মৃদু হাসি পাই, মাথা নেড়ে এগিয়ে যাওয়ার সম্মতি। ও নোটিস মনে হয় গাড়ির জন্য।
ঢুকি। ঝকঝকে মঠ। আমাদের দেখে ভিতর থেকে একজন এসে তালা দেওয়া দরজা খুলে দেন।

ভিতরের ছবি তোলা যায়? মাথা দুলিয়ে হেসে নিতে বলেন। মনের আনন্দে ফোটো তুলি।


তারপর বাইরের চাতালে এসে গল্প করতে করতে কথায় কথায় বলি, পুরোনোটা তো দেখা হবে না আমাদের… একটু গল্পই বলুন তার শুনি।
বয়স্ক লামা দুম করে বলে বসেন, “কেন দেখা হবে না কেন? যাও দেখে এসো!”
“অ্যাঁ! কী করে যাব, সে যে বহু দূর!”
হা-হা করে হেসে ওঠেন।
‘হোক না দূর। আমাদের শর্টকাট আছে কী করতে! আমরা যাই না? প্রায় রোজ তো যাওয়া-আসা চলে আমাদের।“
কতক্ষণ লাগে?
চোখ কুঁচকে একটু ভেবে বলেন, “আমার ওই… মিনিট দশ!”
বুঝে নিই আমাদের খুব কম করে আধ ঘন্টা লাগবে তার মানে। তা হোক! দেখা যাবে!
হাতে চাঁদ পাই। কিন্তু শর্টকাট চিনব কী করে?
চাতালের ধারে নিয়ে যান লামা। নিচে উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। আঙুল দিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দেন, কোথা থেকে শর্টকাটের প্রায়-চোখে-পড়ে-না এমন সিঁড়ির ধাপ শুরু হয়েছে, কোনদিকে যেতে হবে, কোথায় নীল চালের বাড়িটা থেকে মোড় ফিরে আবার নামতে হবে… ইত্যাদি।
শুরুর জায়গাটা দুই বালক লামা আমাদের দেখিয়েও দেয়।
পরম আহ্লাদে দুজনে নেমে পড়ি। সুন্দর ধাপ ধাপ সিঁড়ি করা পাথরের রাস্তা।
এবং আরো নির্জন। এতক্ষণ যা এসেছি তার চেয়েও বেশি নির্জন রাস্তা।

বেশ খানিক পরে সেই নীল চালের বাড়ি পাই, সেও নিশ্চুপ, জনমানুষের সাড়া নেই। সেখান থেকে যেমন বলেছেন মোড় ফিরি। নামি, নামি, নেমেই চলি।


পাথরের সিঁড়ির দুপাশ জুড়ে অজস্র রকমের গাছের ঝোপ। কোথাও কোথাও পাশে খেত করে চাষ হয়েছে, কোথাও কোথাও স্রেফ জঙ্গল। একটা পাখি ডাকছে দূরে, তা বাদে আমাদের পায়ের শব্দ ছাড়া কিছুই আওয়াজ নেই।
না, ভুল বলেছি। দূর থেকে ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে – ঘন্টাধ্বনি। মন্ত্রপাঠ।
পুরোনো মঠে উপাসনা হচ্ছে, মনে হয়। দ্বিগুণ উৎসাহে পা চালাই।
পাথরের সিঁড়ি দুম করে শেষ হয়ে যায়। দেখি কাদের জানি উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে রোদ পড়া দাওয়ায় দুজন লোক একগাদা লেপ কম্বলের তুলো বার করে শতরঞ্জির উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর পাশে, বাড়ির থামের নিচের ছায়ায় চেয়ার পেতে এক অতিবৃদ্ধা, মেরুন পোশাকে আগাপাশতলা ঢেকে বসে আছেন। তাঁর পায়ের কাছে একটা পমেরিয়ান ঘুরঘুর করছে।
ইয়ে…মনাস্ট্রি যানা হ্যায়…কিধারসে?
মুখে কিছু না বলে ইশারায় দেখিয়ে দেন কীভাবে উঠোনের পাশ থেকে উঠে যাওয়া একটা আরও সরু রাস্তা ধরতে হবে। ধরি। পিছনে পমেরিয়ানটি যথেচ্ছ চীৎকার করে তার দায়িত্বপালন করে। তুলো ছড়ানো লোকগুলো ফিরেও তাকায় না।


সে রাস্তার অদ্ভুত সব বাঁক ঘুরে, এক বাড়ির সামনের উঠোন ক্রস করে—তাতে একটা ট্রাইসাইকেল উলটে পড়ে আছে, একটা খোলা গাড়ির টায়ার শুয়ে… সেসব পেরিয়ে আরও উঠে নেমে এবার রাস্তা শেষ হয়ে যায় এক রান্নাঘরের দোরগোড়ায়। মুণ্ড গলিয়ে দেখি, বিরাট বড়ো ঘরের একপাশে একটা জাঁদরেল সাইজের উনুনে, ছোটো বাথটাবের মতো বিরাট একটা ডেকচিতে বগবগ করে জল ফুটছে, আর ঘরের অন্য পাশে একটা বাঁশের মাচা মতো জায়গায় পাশাপাশি বসে তিন মহিলা মন দিয়ে মোমো গড়ছেন আর সামনের ইয়াব্বড়ো পরাতে রাখছেন। (পরাত মানে জানেন তো? বড়ো, থালার মতো চ্যাপটা কানা উঁচু পাত্র, আমার দিদা বলতেন শব্দটা। পুরোনো কলকাতার বাংলা শব্দ।)

তাদের মনাস্ট্রির কথা জিজ্ঞাসা করতে প্রথমে বলল, ওই পথ ধরে উঠে যাও। তাতে আমি ঘোর আপত্তি করে বললুম, ওখান দিয়ে এই সবে নেমে এসেছি, আবার উঠব কেন! তখন তারা ভারি অবাক হয়ে বলল, ও! এইখানের মঠ দেখবে? সে আগে বললেই হত! এই রান্নাঘরের পাশ দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকে চলে যাও।
গেলুম তাই। কুট্টি কুট্টি সিঁড়ি, খুদে খুদে গায়ে গায়ে ঘর। কী যে মিষ্টি গ্রামটা! ছবি তুলতেই ভুলে গেছি, নইলে দেখাতুম।
এই হল সেই প্রাচীন মঠের পুরোনো দরজা।


তখন ভরদুপুর। দরজা বন্ধ। ঘুরে ঘুরে ছবি তুলি এমনি।

মঠের বন্ধ দরজা-

দরজার দু পাশের ছবি-

সিঁড়ির নিচের ছবি-

তারপর পাশের বাড়িটায় একটু উঁকিঝুঁকি দিতে এক বেশ পাকা গৃহিনী গোছের মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন, সবাই খেতে বসেছে, তোমরা দোতলায় গিয়ে দেখো গে’! দোতলা খোলা আছে।
আমরা অগত্যা দোতলাতেই চলে গেলুম। ছোটো আর পুরোনো মঠ যেমন হয়, তেমনই। একপাশে স্তূপ করা পুঁথি। দেওয়াল জুড়ে উজ্জ্বল সব ছবি আঁকা। থাঙ্কা ঝুলছে।
চোখ ভরে দেখে নেমে এলুম। এক ঝুঁটি বাঁধা বালিকা মনে হয় খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটা বেড়ালছানা নিয়ে খেলছিল সামনের চত্বরে, আমাদের দেখে লাফাতে লাফাতে বেড়ালছানাকে ফেলে চলে এল। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে বুঝলুম সে হিন্দি ইংলিশ কিছুই বোঝে না।
ইতিমধ্যে আরেকজন বয়স্ক লোক এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে অনুরোধ করতে মঠ খুলে দিলেন, ভিতরের ছবি তুলতে বারণ করেছেন বলে নিইনি। এখানে বুদ্ধের বাঁপাশে এক ভয়ানক চেহারার মূর্তি ছিল। চিনতে পারিনি, খুব সামান্য হিন্দির দখল থাকায় উনিও ঠিক বোঝাতে পারেননি। তবে তাঁকে ভয় ভক্তি না করলে বিপদ হয়, এটুকু বোঝালেন।
তারপর সামনের চত্বরের ধাপিতে বসে জুতো পরছি, আরেকজন লামা এসে বসলেন আরেক পাশে। সরল ভাবে হেসে নানান প্রশ্ন করতে লাগলেন, কোথা থেকে এসেছি, বাড়ি কোথায়, কলকাতা কেমন খুব নাকি গাড়ি চলে, তিতিরের কোন ক্লাস, এখান থেকে কোথায় যাব ইত্যাদি। উনি এখানেই থাকেন, নতুন মঠে যাননি। নতুন মঠের লামার সঙ্গে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে শুনে ভারি খুশি হলেন, বললেন উনি তো খুব আসেন আমাদের কাছে (আমি মনে মনে বললাম, দশ মিনিটে), এ মঠ এত পুরোনো, এখানে সব পুরোনো নিয়ম মেনে পূজা হয় ইত্যাদি… বলছেন, খুব ভালো লাগছে সেসব শুনতে, বলতে বলতে হঠাৎ বললেন, “ওই রাস্তা দিয়ে এলে তো? শর্টকাট?”
আমি যেই সায় দিয়েছি, শিশুর মতো হেসে মাথা দুলিয়ে বলেন কিনা, “ওই জঙ্গলে লেপার্ড আছে।“
আমার তো শুনে উলটে পড়ে যাওয়ার জোগাড়।
“অ্যাঁ!!! কী? কী?”
“লেপার্ড! দুমাস আগেই এই এখান অবধি চলে এসেছিল, মঠের পিছনে লুকিয়ে ছিল।“
আমি আর নেই। এ কী সর্বনাশ! ওই রাস্তা দিয়েই তো ফিরতে হবে!
তড়িঘড়ি অন্য দিকের রাস্তার খোঁজ নিই। লামা এবং সেই বৃদ্ধ দুজনেই এক কথায় নাকচ করে দেন, সে এত দূর যে তাঁদের হিসাবে তিন-চার ঘন্টা লেগে যাবে পায়ে হেঁটে।
মানে আমাদের কম করে ছ সাত ঘন্টা। যদি লাঞ্চ-টাঞ্চ ভুলে যাব মনে করি, তাহলেও এই দুপুরের পর বেরিয়ে আলো থাকতে থাকতে ফিরতে পারব না। মানে, ওই শর্টকাটেই যেতে হবে।
লামা হাসিমুখে অভয় দেন, “আরে, বুদ্ধের নাম করে এসেছ! বুদ্ধের নাম করতে করতে চলে যাও, কিচ্ছু হবে না! তাছাড়া দু মাস ধরে তাকে দেখিওনি, নেই এখন এখানে তার মানে।”
নিরুপায় হয়ে ওই কথার ভরসাতেই বেরিয়ে পড়ি। বুদ্ধদেব নিজে যখন ব্যবস্থা করে টেনে এনেছেন এতটা, একটা গুলবাঘকে কি আর সামলাতে পারবেন না!
আবার সেই রান্নাঘর পেরিয়ে যাই… মহিলাদের কাজ শেষ, তাঁরা এখন বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন, আমাদের দেখে এক গাল হাসেন। তারপর সেই বাড়ির উঠোন। এখন তাতে তিনটে ছেলে মেয়ে বেজায় ছুটোছুটি করছে, পড়ে থাকা ট্রাইসাইকেল চালিয়ে আরেকটা ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বাবা বা তেমন কেউ এক পাশে দাঁড়িয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। মানুষের দেখা পেয়ে একটু মনোবল বাড়ে। ধাঁই ধাঁই করে বাকি পথ পেরিয়ে আবার সেই উঠোনে এসে পড়ি। তুলো বার করার কাজ শেষ, সেসব এখন রোদ খাচ্ছে দাওয়া জুড়ে, লোক দুটো খোল সেলাই করছে একপাশে বসে। সেই বৃদ্ধা এখনো পিঠ সোজা করে ঠায় বসে, আমাদের দেখে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন মঠ দেখা হল কিনা। পমেরিয়ানটি আবার তারস্বরে চেঁচিয়ে নিল।
সেখান থেকে আরো খানিকটা এগিয়ে তিতির বলল, “খাব না?”
তখন আমার মনে পড়ল, তাই তো। ব্যাগ ভরে স্ন্যাক্স নেওয়া হয়েছিল, রাস্তায় পিকনিক করা হবে বলে। কিন্তু লেপার্ড? তারপর মনে হয়, দূর হোক ছাই! অত ভেবে লাভ নেই। বেজায় খিদে পেয়েছে সেও তো কথা!
ওই সিঁড়িতেই – দিব্যি পরিষ্কার – ধপাধপ বসে পড়ে বিস্কুট, কেক আর জল খাওয়া হল। তারপর আবার উঠি, উঠি – বাবারে, এতখানি নেমে এসেছিলাম… এখন উঠতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে… করে করে অবশেষে নতুন মঠের গোড়ায় সেই পাকা রাস্তায় ফিরে এলুম। ঘড়ি ধরে দেখলুম, পাক্কা চল্লিশ মিনিট লেগেছে।
লেপার্ড বাবাজি যে উধাও ছিলেন, এজন্য বুদ্ধদেবকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে ফেললুম। তবে হ্যাঁ, আর কক্ষণো আমি গুচ্ছ জেরা না করে লামাদের পরামর্শে কোনো রাস্তায় যাচ্ছি না বাপু! ওঁরা সব আলাদা জগতেরই বাসিন্দা!
তারপর আবার সেই নুড়িপাথরের সুঁড়িপথ ধরে ফিরে আসি।

দিব্যি ভদ্রসভ্য সময়ে, বেলা দুটোর একটু পর। ফ্রেশ হয়ে খেতে যাওয়ার আগে রিসেপশনে বলে যাই যে দুটো মঠই পায়ে হেঁটে দেখে এসেছি। শুনে ভদ্রলোক এমন একটা আকাশ-পাতাল জোড়া হাঁ করে ফেলেন কী বলব!
যাক, এত অ্যাডভেঞ্চার করলে প্রবল খিদে পাওয়া খুবই স্বাভাবিক, ভাত ডাল বেগুনের তরকারি স্কোয়াশের তরকারি মাছের ঝোল সব হু হু করে উড়ে গেল। তারপর ছোট্ট করে একটু ঘুম, বিকেলে ক্যাম্পাসের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি।

তিতির যথারীতি খরগোশ খাওয়ানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

তার খানিক পর দেখি একটা কুকুরকে পাকড়াও করেছে।

তারও খানিক পর, আমি বেঞ্চে বসে ঝিমোচ্ছি, ‘মা মা’ করে হাঁকডাকে চেয়ে দেখি একটা গোলগাল সাদা বিড়াল। একটু পরেই দেখা গেল তিতির তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।


এই এত কিছুতে উৎসাহিত হয়ে গিয়ে সে এর পর রাজহাঁসকে আদর করতে গেছিল। কী ভাগ্যিস পায়ে মোটা বুট ছিল।

হাঁসটাকে বিস্কুট খাওয়ানোর পরেও  ঠুকরে দেওয়ার বেইমানিতে মেয়ের ভারি রাগ হল, ঘরে ঢুকে ন্যান্সি ড্রু নিয়ে শুয়ে পড়ল। অগত্যা আমিও…
সন্ধ্যায় আবার চা, পকোড়া আর মোমো। রাত্রে চাউমিন। এইভাবে একটা ঘটনাবহুল দিনের পরিসমাপ্তি ঘটল।
—-
(ক্রমশঃ)

Leave a Comment