চলার পথে – ৩৩ (cholar-pothe-33)

চলার পথে – ৩৩ (cholar-pothe-33)

উত্তরবঙ্গ ডিসেম্বর, ২০২২ (কালিম্পং-পেডং-মুন্সং-দার্জিলিং) – পর্ব ৭

দিন ৬ (২৯ ডিসেম্বর, ২০২২)

————————————–
আজ তাড়া ছিল না, তবু সকালবেলাই উঠেছিলুম। যদিই মেঘ সরে, যদিই সামনে যে ৬৫ ডিগ্রি জুড়ে খোলা পাহাড় ,কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ, দেখা যায় এখান থেকে, তার দেখা মেলে।
ও বাবা, ঘর থেকে বেরিয়ে মনে হল মেঘের পেটে ঢুকে গেলুম সটাং! যেন কেউ জায়গাটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেঘালয়ে বসিয়ে দিয়েছে!
এই দেখুন। এই নাকি সূর্যোদয়!

অগত্যা স্নান টান করে নিয়ে ব্রেকফাস্ট খেতে চলে গেলুম। খাবার ঘরের কয়েকটা ছবি তুলে ফেললুম মনের দুঃখে।

 তারপর চেক আউট সেরে, প্রথামতো বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়া। এই মহিলা আগাগোড়া খুবই দেখভাল করেছিলেন আমাদের।

এদের থেকেও বিদায় নেওয়া হল।


গাড়ি এসে গেছিল। মালপত্র তুলে নিয়ে রওনা দিই দার্জিলিং-এর পথে। রাস্তায় অনেকগুলো চা বাগান পড়ে।


এইখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা দার্জিলিং ভান্টেজ নামের একটা হোমস্টে-তে। ম্যল থেকে কিছুটা দূরে, ভিড়ভাট্টা থেকে সরে থাকতে চেয়েছিলুম, কৌশিক তেমনই ব্যবস্থা করেছে। এটা এক নেপালী পরিবারের বাড়ি, দুটো তলা মিলিয়ে মোট ছটা ঘর। যুবরাজ বলে এক সদাহাস্যময় মিষ্টি যুবক, তার স্ত্রী আর মা মিলে নিজেরাই সমস্ত কাজকর্ম সামলায় দেখলুম। যুবরাজ রাস্তায় অপেক্ষা করছিল, আমরা আসতেই লাগেজ শুদ্ধু আমাদেরও আগাগোড়া স্যানিটাইজ করে নিয়ে তবে উপরে নিয়ে গেল।
আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল তিনতলার একটা ঘরে।

সামনে একদম খোলা ভিউ, জানলা দিয়ে শৈলরানী দার্জিলিং।


ব্যাগ ট্যাগ রেখে, ফ্রেশ হবার পর যুবরাজ ছাতে নিয়ে গেল আমাদের। ভারি সুন্দর লাগছিল মিঠে রোদটুকু।

আমাদের ঠাণ্ডা লাগছে শুনে খুব হাসল ছেলেটি, বলল গতকাল এত টেম্পারেচার কমে গেছিল যে এমনকী ওদেরও ঠাণ্ডা লাগছিল, মনে হচ্ছিল বরফ পড়বে হয়তো রাত্রে।
ঘরে আসতেই একটা জোর আওয়াজ শোনা গেল দূর থেকে—যুবরাজ হেসে বলল, ওই যে, টয়ট্রেন যাচ্ছে। দেখতেও পেলাম এক ঝলক।
কী মজা! ও কৌশিক, আমরাও যাব!
একটু পরেই লাঞ্চের ডাক এল। খেতে বসে আলাপ হল আরেক বাঙালি দম্পতির সঙ্গে, ওদের আরেক গেস্ট। তাঁরাও বেড়াতে ভালোবাসেন, ছেলে চাকরি পেয়ে বাবা-মাকে এসব জায়গা বুক করে দিয়ে বেড়াতে পাঠায়। খুবই সহজ সরল মানুষ, বেশ গল্পে গল্পে খাওয়া হয়ে গেল। সোনার মতো ঝকঝকে, কানা উঁচু, কাঁসার থালায় গরম গরম ভাত ডাল আলুভাজা ডিমের ঝোল।
খেয়ে উঠে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরোনো—কৌশিক টয়ট্রেনের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে। যুবরাজ দেখিয়ে দিল কীভাবে শর্টকাটে নেমে মেইন রোডে পড়ে, টয় ট্রেন স্টেশনের দিকে যাওয়া যাবে। সেইমতো নেমে গেলুম আবারও লোকের বাড়ি ঘর উঠোন পেরিয়ে। মেইন রোডে নেমে দু তিনজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে পৌঁছে গেলুম স্টেশনে।

তার মধ্যেই মোমোর দোকান চোখে পড়ায় মা-মেয়ের প্ল্যান হয়ে গেছে সন্ধেবেলা মোমোভক্ষণ হবে।
স্টেশনে গিয়ে জানা গেল কুয়াশার জন্য সব ট্রেন একটু লেটে চলছে, অপেক্ষা করতে হবে। চা খেয়ে, স্যুভেনির দেখে আর স্টেশন চত্বরের কুকুরদের সঙ্গে ভাব করে সে সময়টা কাটানো গেল।


তারপর ট্রেন এল। যে যার নাম্বার লেখা সিটে বসে পড়লুম। সবাই উত্তেজিত, হই হই করছে। দেখতে দেখতে বাঁশি বাজিয়ে হেলেদুলে ট্রেন চলতে শুরু করল।

সে ভারি মজার গুটিগুটি পায়ে যাত্রা… তিতিরের তো বটেই, আমারও জীবনের প্রথম। তবে কী জানেন, মন উপভোগ করার মাঝে মাঝেই বলছিল, এই যে খাদের দিকটা ঢেকে এত বাড়িঘর, এত নতুন নতুন রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে এখনো… এগুলো যখন ছিল না তখন যাত্রাটা আরো অনেক সুন্দর হত নিশ্চয়!
তিতির অবশ্য বেজায় এক্সাইটেড। লাফাচ্ছে সিটে বসে বসেই। মাম্মা ওই দেখো নীল ফুল! মাম্মা ওই দেখো পাহাড়! মাম্মা ওই দেখো একটা ডগি ল্যাজ নাড়াচ্ছে!
এই করে করে পৌঁছে গেলুম বাতাসিয়া লুপ।

এইটের ছবি এঁকেছিলুম যেবার ইঙ্কটোবার করেছিলুম। আসল জায়গাটা একটু অন্যরকম লাগল কল্পনার চেয়ে। ট্রেন পনেরো মিনিট দাঁড়ায়, আমরা ছবি টবি তুলি।

তারপর ঝুকঝুক করে ঘুরে ঘুরে আমরা এসে পৌঁছই ঘুম স্টেশনে। সেই ঘুম, বুড়ো আংলায় যার নাম প্রথম শোনা। তারপর অবন ঠাকুরেরই ‘হাওয়া বদল’ লেখায়। কেমন ছোট্ট ঘুম-ঘুম স্টেশন একটা।

তিতিরকে এক পাশের একটা দোকান থেকে কাপকেক কিনে দিই। ধোঁয়া ছেড়ে একটা স্টিম ইঞ্জিন এসে হাজির হয় তার মধ্যে।

তারপর ট্রেনের ইঞ্জিন পালটায়, পিছনবাগে চলতে চলতে ফেরা। সন্ধে হয়ে যায়, আলো জ্বলে ওঠে। ট্রেন থেকে নামি যখন, সে একেবারে জম্পেশ অন্ধকার হয়ে গেছে, আর ততোধিক জম্পেশ ঠাণ্ডা। মোটা জ্যাকেটেও হি-হি করার দশা প্রায়। আশপাশের হাজারো দোকান থেকে ডাকাডাকি আসছে সোয়েটার চাদর মাফলার টুপি ইত্যাদি কেনার জন্য। তিতির একটা নীল রঙের গলায় প্যাঁচানোর জিনিস পছন্দ করে, কিনে দিতেই সেটা গলায় জড়িয়ে ফেলে। তারপর দুজনে মিলে জোরকদমে পা চালাই।
ফেরার রাস্তাটা গুগল ম্যাপ দেখতে দেখতে এগোই। হিমেল কুয়াশায়, আলোকোজ্জ্বল ঘরবাড়ি আর আনন্দিত ট্যুরিস্টদের আনাগোনায় সরগরম সে রাস্তা দেখতে দেখতে টের পাই, দার্জিলিং-এর জাদু। এ এক আলাদাই সৌন্দর্য, আলাদাই আকর্ষণ।


পথে পড়ে ক্লক টাওয়ার। কুয়াশার হালকা চাদরে, অপার্থিব সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই রাত্রে।


আরো এগোতে এগোতে এই দোকানটা চোখে পড়ে, ‘নেপালি চুলো’। কেন জানি দেখেই মনে হয় খাসা হবে খাবারদাবার। ঢুকে পড়ি।


টিভিতে নেপালি নাচ-গান চলছিল। অর্ডার দিতে, আমাদের জন্য এক প্লেট মোমো আর এক বাটি থুকপা আসে। যেমন মনে হয়েছিল, খাবার অসম্ভব স্বাদু। খেয়েদেয়ে আবার হাঁটা, ম্যাপ ধরে ধরে।
ক্রমে জনবহুল জায়গা ছাড়িয়ে একটু ফাঁকা রাস্তা ধরতে হয়। মোড়ের মাথায় এ বাড়িটার কী সুন্দর আলো!


তারপর আস্তে আস্তে রাস্তা একদমই খালি আর মিটমিটে আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। প্রাচীন শহরের গলিতে ঘুরে বেড়ানোর মতো।


তবে আমরা ঠিক একা ছিলুম না। কয়েকটা কুকুরকে বিস্কুট খাওয়ানো হয়েছিল পথে, তাদের কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে পাহারা দিয়ে দিয়ে চলে। আদর খায়, ল্যাজ নাড়ে, চলে যেতে বলি, যায় না।
অবশেষে আটটার একটু আগে ফিরে আসি ঘরে। আরে, এই সুন্দর ঝকঝকে শোকেসটা তো আগে খেয়াল করিনি!


এর পরের সময়টুকু বই নিয়ে কাটানো ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। সে কী ঠান্ডা, আমরা তখনই লেপ খুলে ফেলে তার মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে বাধ্য হই।
রাত্রে চিকেন রুটি ডিনারের পর কাঁপতে কাঁপতে শোয়ার তোড়জোড় করছি, যুবরাজ দরজায় নক করে এসে হাজির।
“এইটে নিয়ে ঘুমোন।“
এইটে হল একটা হটওয়াটার ব্যাগ। ও-ই শিখিয়ে দিল কীভাবে লেপ কম্বলের মধ্যে ওটাকে মুড়ে নিতে হয় যাতে অনেকক্ষণ গরম থাকে।
সে যে কী আরাম হয়েছিল ওই ব্যাগে পা সেঁকে!
তিতির অবশ্য প্রথমে খুবই টেনশনে পড়ে গেছিল। জীবনে প্রথম দেখল তো! খালি জিজ্ঞাসা করছে, মা ওটা ফেটে জল পড়ে যাবে না তো! বলে বলে তার ভয় কাটিয়ে হল বিপত্তি, সে এমন পা দিয়ে ওটায় লাথি মারছে যে এবার আমার টেনশন হতে লাগল, ফেটে যাবে না তো!
আরামের চোটে এক ঘুমে রাত কাবার!
—————

Leave a Comment