চলার পথে – পর্ব ৪

চলার পথে – পর্ব ৪

আজ একদম হুশ করে চলে যাব দেশের বাইরে, কেমন? সময়টাও পিছোবে, এটা ২০০৩-২০০৪ সালের গল্প।
গেছিলুম অবশ্য অফিসের কাজে। টোকিওতে। মাস দুই থাকতে হয়েছিল টানা। সেটা আবার ছিল ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস, উহুহু কী ঠাণ্ডা কী বলব! নিয়মিত বরফ পড়ত, সন্ধ্যায় ফেরার পথে দেখতুম রাস্তার বরফ সরানো হয়েছে, ধারে ধারে সাদা স্তূপ হয়ে জমে আছে। বাচ্চারা স্নো-ম্যান বানাত। সেই প্রথম এ’রকম শহরের মধ্যে বরফ দেখেছিলুম, খুব আহ্লাদ হয়েছিল মনে আছে।
ঐ দুটো মাস ঘুরেছিলুম প্রাণ ভরে। সোম থেকে শুক্র – এই পাঁচদিন অফিসে পাগলের মত খাটতুম – জাপানীরা যে কী কাজপাগল কী বলব! সেই সঙ্গে কথায় কথায় বাও করে করে কোমর খুলে যেত, উফ! অবশ্য তারাও আমার ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ/না বলার অভ্যাসে বেজায় কনফিউজড হত, শেষে একজন বলেই দিল ‘খবোদ্দার অমন ডুগডুগ করে ঘাড় নাড়িও না, আমরা তোমার ইয়েস-নো গুলিয়ে ফেলছি।‘
তো, সেখানে যদিও অফিসের আরও কিছু ভারতীয় লোকজন ছিল, কিন্তু তারা খালি খালি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে যেত আর হিন্দি ফিল্ট টিল্ম নিয়ে গল্প করত, সেসব আমার একদম পোষাত না। তাই প্রথম এক সপ্তাহ একটু তাদের সঙ্গে থেকে ব্যাপারস্যাপার বুঝেশুনে নিলুম, তারপর উইকেন্ডগুলোয় একা একাই বেরোনো শুরু করে দিলুম।
অফিসে তদ্দিনে কিছু স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে দিব্যি দোস্তি হয়ে গেছে, তারা আমায় নানাবিধ টিপস দিয়ে যাচ্ছে ঘোরাঘুরি বাবদ। প্রতি হপ্তায় লাঞ্চের আড্ডায় বলতুম অমুক জায়গা যাবো, আর তারা ম্যাপ এনে,  ধরে ধরে কালার কোডিং শিখিয়ে, কোথায় কী ট্রেনলাইন চেঞ্জ করতে হয় পাখিপড়া করিয়ে, কী দেখব, কী খাব সব হালহদিশ দিয়ে রেডি করে দিত। মনে রাখতে হবে তখন আমার হাতে স্মার্টফোন নেই, গুগল ম্যাপ দূর-অস্ত!
অনেক সময় অফিসের বন্ধুরাই বলে দিত কোথায় যাব সে হপ্তায়। সেইমতো, আমি শনিবার আর রবিবার দুদিনই ভোরে উঠে তৈরি হয়ে বেরিয়ে যেতুম আর একদম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ রাতের ডিনার প্যাক করে নিয়ে সার্ভিসড অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতুম। আমি একটু শীতকাতুরে কিনা, এর পর এত ঠাণ্ডা লাগত যে আর বাইরে থাকতে পারতুম না। এইভাবেই একা একা রোপ্পোঙ্গি, আসাকুসা, এম্পারারস গার্ডেন, চিড়িয়াখানা এরকম কত জায়গা ঘুরে এসেছি।
তো এই ঘোরাঘুরিতে অন্য কিচ্ছু প্রবলেম হত না, সেফটি তো একেবারেই না – কিন্তু ভাষা ছিল একটা ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ। ইংলিশ প্রায় কেউ বোঝে না। কিন্তু সেসব বলে কি আর অদম্য গলকে নিরস্ত করা যায়? কেন, ডাম্ব শ্যারাড খেলিনি নাকি স্কুল কলেজে?! জাপানী বন্ধুদের শেখানো পড়ানো ম্যাপ তো থাকতই হাতে, বাকি ইশারা ইঙ্গিতে চালিয়ে দিতুম খাসা। এমনকী, যখন ইশারাই বুঝবে, তখন আর অত খাটি কেন ভেবে বেশ কয়েকবার দরাজ বাংলাও বলেছি। (এর একটা বিস্তারিত গল্প পরের পর্বে বলব নাহয়।)
সাংঘাতিক ভদ্র আর হেল্পফুল মানুষগুলি। একবার এক দোকানদার কিছুতেই বুঝতে না পেরে গিয়ে পাশের বাড়ি থেকে ইংলিশ জানা একজনকে ডেকে এনেছিলেন – এটা ভালো করেই বুঝেছিলেন কিন্তু আমি ওঁর থেকে কিচ্ছু কিনব না, রাস্তার খোঁজ করছি খালি -তবু।

এই এত ঘোরাঘুরির মধ্যে, যেটা দেখে আমার মুগ্ধতা আর কাটতেই চাইছিল না, সেটা হল টোকিওর চিড়িয়াখানা। জীবনে প্রথম জায়ান্ট পাণ্ডা দেখেছিলুম, বসে বসে বাঁশ চিবোচ্ছে পান খাওয়ার মত করে। মোটেই সফট টয়ের মত কিউট ব্যাপার নয়, বরং বেশ গম্ভীর ভারভারিক্কি, একটু ভয়-ভয়ই করে দেখলে। সীলমাছের সঙ্গেও সেই প্রথম দেখা।

ওইখানে আমি প্রথমবার পেঙ্গুইন দেখি। পরে মুম্বইয়ের চিড়িয়াখানায় পেঙ্গুইন এসেছে, তিতিরকে নিয়ে গিয়ে দেখেও এসেছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু এটা যখনকার কথা, তখন ছিল না। আমার আবার ইগলু আর পেঙ্গুইন নিয়ে একটা আলাদা ফ্যাসিনেশন আছে ছোট থেকে। সেই কোন জ্ঞান হয়ে ইস্তক এই দুটো লাখ লাখ বার চক দিয়ে এঁকেছি দালানের মেঝে জুড়ে!

অতএব রেলিং ধরে হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিলুম –  মাঠে গরু চরার মত সামনে খোলা বরফের চত্বরে পেঙ্গুইন চরছে – আমাদের আর তাদের মধ্যে জলে ভরা পরিখা। একটা পেঙ্গুইনের গ্রুপ দেখি লাইন করে জলের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, একজনের পিছনে একজন ঠেসাঠেসি একদম। হঠাৎ পিছনের চত্বর থেকে আরেকটা পেঙ্গুইন স্লাইড করে বেশ স্পীডে এসে লাইনের পিছনে ধাক্কা মারল, আর সব সামনের পেঙ্গুইনটা টুপ করে খসে ভ্যাবলার মত জলে পড়ে গেল। ব্যাপার দেখে সব ভুলে হো হো করে হেসে ফেলেছিলুম, আশপাশের লোকে মজা পেয়ে ঘুরে তাকিয়েছিল। তাতে সম্বিত ফিরে পেয়ে আমার  খুব লজ্জা করেছিল, কিন্তু অমন কার্টুনের দৃশ্যের জীবন্ত রূপ দেখে না হেসে করতুমই বা কী!
(ক্রমশঃ)

Leave a Comment