চলার পথে – ৬
PreviousNext
জাপানের গল্প – ৩
দেখতে দেখতে আমার টোকিওবাসের মেয়াদ ফুরিয়ে এল। চলে আসব, তার আগের উইকেণ্ডে ক্লায়েন্ট কোম্পানির যে সিনিয়র ম্যানেজারের সঙ্গে কাজ করতুম তিনি বাড়িতে ডিনারে ইনভাইট করলেন। শুনে আমাদের কোম্পানির আর যারা যারা ছিল তাদের চক্ষু ছানাবড়া – এ নাকি বিশাল সম্মান। সবাই মিলে পাখিপড়া করে এটিকেট শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠাল।
(সেই নিমন্ত্রণের অভিজ্ঞতা মজা করে একটা ‘অফিসের গল্প তে লিখেছিলুম। সেসব তরল আলোচনা থাক, এখানে অন্য গল্প বলি।)
নির্ধারিত সন্ধ্যায় আমি তো দুরুদুরু বক্ষে কিছু কুকি-সুইটস ভেট নিয়ে গিয়ে হাজির হলুম। গিয়ে দেখি অফিসের কেউ নেই – তাঁর গিন্নি, শালী, ভাই ও আরও কত কে সব অচেনা লোকজনে সাজানো ফ্ল্যাট গমগম করছে। এদ্দিন অফিস করেছি পাক্কা ওয়েস্টার্ন ফর্মালে, সেদিন শখ করে একটা সালোয়ার কামিজ পরে গেছিলুম – বলব কী, ইন্ডিয়ান ড্রেস তারা নাকি আগে কখনো দেখেনি, সবাই মিলে এমন টানাটানি লাগাল, আমি তো ভয় পেলুম সেলাই খুলে না যায়! সেই ম্যানেজার ভদ্রলোক ভাঙা ভাঙা ইংলিশ বলতে পারেন, তাঁর আত্মীয়রা আরও কম। কিন্তু তাতে কি আটকায়? তাঁর স্ত্রী আর শালী আমায় গ্রেপ্তার করে “ইঞ্জিয়া”র হাজারো খবর নিতে লাগলেন। সেই অত্যন্ত ভদ্র এবং সরল, আন্তরিক আলাপে এখানে বিয়ে কেমন করে হয় থেকে কত ঘন ঘন ভূমিকম্প হয় অবধি সব ছিল।
তারপর ভদ্রলোকের মেয়ে আমায় পাকড়াও করল। তার তখন এই এখনকার তিতিরের মত বয়স হবে, বা আরও একটু ছোটো। পুরো পুতুলের মত দেখতে, পুঁচকি নাক, গাল টুকটুকে লাল। সে পাঁচ মিনিট পরেই আমায় ধরে তার ঘরে নিয়ে গেল। তার খানিকক্ষণ পরে দেখা গেল ঘর ভর্তি বড়োরা তাদের গল্পগাছা থামিয়ে হাঁ করে দেখছে, আর তাদের মধ্যে মেঝেতে কার্পেটের উপর থেবড়ে বসে আমি আর মেয়েটি গোটা চারেক বার্বি ডল নিয়ে হইহই করে রান্নাবাটি খেলছি।
এইখানে বলে নিই জাপানী বাচ্চারা চূড়ান্ত ভদ্র এবং ডিসিপ্লিনড, ভীষণই ওয়েল ম্যানারড। আমি যেখানে থাকতুম, তার কাছেই একটা ছোটদের স্কুল ছিল। আসা যাওয়ার পথে দেখতুম তারা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে, কোনো আওয়াজ নেই, এদিক ওদিক তাকানো নেই। ছোটো থেকেই সেল্ফ কন্ট্রোলের পাঠ শিখে যায় বাচ্চারা।
তো, এই যেখানে নর্মাল সেখানে মেয়ে এমন অচেনা এবং বিদেশী একজনের সঙ্গে এমন মিশে গেছে দেখে তো তার মায়ের হাঁ আর বন্ধ হয় না। এতই অভাবনীয় ওদের কাছে এটা, যে ভদ্রলোক আবার আমায় সরি বলতে এলেন, ‘ও তোমায় বিরক্ত করছে’ বলে! আমি দুজনকেই মিনতি করে বললুম, আমার খুব ভালো লাগছে, প্লিজ ওকে কিছু বলবেন না।
তবে তাদের তো বটেই, আমারও অবাক হওয়ার আরেকটু বাকি ছিল। খাওয়ার টেবিলে বসার ডাক পড়েছে, অমনি লক্ষ্মী মেয়ের মত বাচ্চাটি তার পুতুল গুছিয়ে নিয়েছে। তার ডিনার আগেই হয়ে গেছে – সে এবার নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আমিও উঠে দাঁড়িয়েছি, আচমকা সে পিছন থেকে আমার দু পায়ের ফাঁক দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসে আমার কোমর জাপটে ধরে ঝুলে পড়ল। গুড নাইট করছে।
ঘরশুদ্ধ লোক শকড্। আর আমার চোখের জল সামলাতে প্রাণান্ত হচ্ছে।
কচি হাত দুটো কোমর বেড় দেওয়ামাত্র ধ্বক করে মনে পড়ে গেছে, দু’মাসে এই প্রথম আমায় কেউ আদর করছে! হ্যাণ্ডশেকের বাইরে, দুই মাসে এই প্রথম কোনও মানুষের ছোঁয়া পেলুম! এমন ছোঁয়া যাতে প্রাণের স্পর্শ আছে! কথাবার্তা গল্পগুজব ঘোরাফেরা ছাড়াও যে মানুষের সঙ্গ বলতে আর কিছু লাগে সে তো এর আগে কখনও এমন করে টের পাইনি!
মেয়ের বাবা-মা বুঝেছিলেন। চলে আসার সময়ে একগাদা সুশি প্যাক করে দিয়ে দিয়েছিলেন আমায়, আর হাত ধরে বার বার করে বলেছিলেন আবার টোকিও এলে যেন অবশ্যই ওঁদের বাড়িতে আসি। ওঁদের মেয়ের এমন স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ করাটা ওঁদের কাছেও একটা বিরাট ব্যাপার।
সেই কল্পেশ্বরের সোনুর মত, এর কাছেও আর যাওয়া হয়নি। কোম্পানি চেঞ্জ করার পর ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ কমতে কমতে কবে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু ওই বিদেশী শিশুটির আদরটা আমার বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছে আজও। চোখ বুঁজলে, পিঠের উপর সোনুর উষ্ণ হাতের পাতার মতো,ঐ কচি হাত দুটোও কোমরে বেড় দিয়ে অনুভব করতে পারি, এখনও।
মানুষরতন সব জায়গায়ই এক, তাই না!