চলার পথে ৭ (cholar pogthe 7)
আজকের দিনটা চেয়ে দেখার মতো। এরকম নীল আকাশ দেখলে মনের মাঝে ঝাঁক বেঁধে থাকা জ্বালাযন্ত্রণাগুলো হুশ করে ঝুলঝাড়ুর খোঁচা খেয়ে উড়ে যায়। এমন রোদের মধ্যে আমসত্বের পরতের মতো মিশে থাকা ভালো থাকার হালহদিশ। এই অল্পের মধ্যে অসীম আনন্দটুকু যে দেখতে না পেল, সে বড়ো বেচারা।
এ সপ্তাহের বেড়ানোর গল্প লেখা হয়নি যথাসময়ে, বকুনিও খেয়েছি তাই। সপ্তাহভর, এমনকী শনিবারেও যে পরিমাণ আপিশের কাজ করতে হয়েছে, তাতে মনের মধ্যে গুছিয়ে গাছিয়ে, ভেবেচিন্তে সাজিয়ে নেওয়ার ফুরসৎটুকু পাইনি আর। তাই, ইচ্ছে যদিও ছিল আবার হিমালয়ের কোলে ফিরে যাবার, আরেক হপ্তা অপেক্ষা করতে হবে তার জন্য।
আজ বরং বলি একটা ছোট্ট মেয়ের বেড়ানোর গল্প। মোটামুটি বছর ছয় থেকে যার বেড়ানোর স্মৃতি। তার আগের পুরী বা দীঘা রয়ে গেছে শুধু বাবার মুখের গল্পে। সেই সঙ্গে আবছা একটা উঠোন পেরিয়ে ঘর, জানলার গরাদ, নুলিয়ার সঙ্গে দাদুর টায়ারে বসে সমুদ্রস্নান – নাতনিটকে নিতে বেজায় তাচ্ছিল্যভরে অস্বীকার করেছিল নুলিয়াটি – বেজায় প্যাংলা ছোট্ট বাচ্চা, ও ধরে বসতেই পারবে না!
ভীতু, লাজুক ছোট্টো মেয়েটা সমুদ্রের ঢেউ দেখে ভয় পেত তখন।
তারপর, ঐ বছর ছয়েকের সময়েই আর কী, কেরালার সমুদ্রে হুটোপুটি করে সে ভয় কেটে গেল।
কিন্তু সে তো পরের কথা। ব্যাপার হল, তার বেড়ানো শুরু হত অনেক আগে, ট্রেনের টিকিট কাটার দিনটি থেকেই। তখনকার সবাইকারই হয়তো তেমন হত। বইয়ের তাক থেকে নেমে আসত ‘ভ্রমণ সঙ্গী’, রাফ কাগজের তাড়া আর পেন পেন্সিল স্কেচপেন নিয়ে মেয়েটি আর তার বাবা বসে পড়ত রোজ সন্ধ্যায়, গজিয়ে উঠত প্ল্যানের পর প্ল্যান।
সকালে ঘুম থেকে ওঠা অবধি, রাত্রে শুয়ে পড়ার আগে পায়চারি করা অবধি সমস্ত খুঁটিনাটি ডিটেল এক এক করে ভরে উঠত রাফ কাগজে। জনান্তিকে বলে রাখি শেষোক্ত জিনিসটি লেখার কারণে ভদ্রলোক গিন্নির কাছে বেদম বকুনি খেয়েছিলেন। যাই হোক, পাতা জুড়ে খুদি খুদি অক্ষরে পনেরো দিনের ‘ট্যুর প্ল্যান’ লেখা হত।
তার পরের পর্ব ছিল বাচ্চা মেয়েটির। সে স্কেচপেন, পেন দিয়ে সেই প্ল্যানের ছবি আঁকত পাশে পাশে। সব না, কিন্তু ঐ, যেখান ট্রেন ধরে রামেশ্বরম যাবার কথা তার পাশে একটি খুদে কু-ঝিক-ঝিক গজাত, যেখানে মাদ্রাজ – তখন তো চেন্নাই হয়নি – পৌঁছে সমুদ্রতীরে বিলাসভ্রমণ করতে যাবার কথা, তার পাশে ছোট্ট একটি আনাড়ি হাতে আঁকা ঢেউ মাথা চাড়া দিত, যেখানে বা ‘ব্রেকফাস্ট’ লেখা হয়েছে, সেখানে থালায় লুচি আর আলুভাজা পড়ত (মেয়ে তো তখন জানে না ইডলি দোসা কী বস্তু, আর টক সম্বর রসম খেলে কেমন কান্না পায়!)।
আমরা বেড়াতে যেতুম রাজ্য ধরে। একটা রাজ্যের দ্রষ্টব্য জায়গাগুলোর বাছাই কিছু, যা ছুটিতে, আর এখন বুঝি, পকেটে আঁটে। তাই আরেকটু বড়ো হলে, অ্যাটলাস খুলে দেখে দেখে সেই রাজ্যের ম্যাপ আঁকত মেয়ে, উমোর-ঝুমোর চোখে এসে পড়া চুল হাতের পিছনপিঠে ঠেলে সরিয়ে তাদের বেড়ানোর জায়গাগুলো মার্ক করত, রুটটা আঁকত ডট ডট করে।
স্কুলে ভূগোলে ম্যাপ পয়েন্টিং শিখতে তখনও ঢের দেরি।
এভাবেই, কাগজের মধ্যে একটা ছুটির বেড়ানো গড়ে উঠত। বেড়াতে যাবার আগেই।
তারপর হত জিনিসের লিস্টি, চারপ্রস্থ। তিনজনের তিনটে, আর একটা ক্যামেরা, তেল সাবান ইত্যাদি কমন জিনিসের। সে যে কতবার করে লেখা হত, কাটা হত, ভুলে যাওয়া জিনিস অ্যারো দিয়ে ঢোকানো হত – তার ইয়ত্তা নেই। উত্তেজনার পারা চড়তে থাকত রোজ একটু একটু করে… পারলে পরীক্ষার পড়ার চেয়েও ভালো করে লিস্ট মুখস্থ করে ফেলে মেয়ে!
তারপর ব্যাগ গুছোনোর দিন এসে যেত। সে এক মহা রণরঙ্গপর্ব! লিস্ট ধরে ধরে যেগুলো পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগে ঢুকল, তার পাশে পাশে পড়ল টিকমার্ক। তারপর যেগুলো তৎক্ষণাৎ পাওয়া যায়নি সেগুলর হালহদিশ করা হত – বাবার নীল শার্ট লন্ড্রিতে তো মায়ের সবুজ বুটি শাড়ি মাড় দেওয়া ইস্ত্রি করা হয়নি, ক্যামেরার রিল কেনা হয়নি, তো মেয়ের শখের ডোরাকাটা জামা লিস্ট থেকে বাদ দিতে হচ্ছে কারণ ইত্যবসরে, নিজেরও অগোচরে মেয়ে আরেকটু বড়ো হয়ে গিয়ে জামাটা আর পরা যাচ্ছে না।
তারপর সেই অনন্ত ‘কাঁচি কই, কয়েকটা খবরের কাগজ ভাঁজ করে নাও, এই তোর জুতো পালিশ করে রাখ, তোমায় পই পই করে বলে দিলুম এই সাবানটা আনবে না সেই এটাই নিয়ে এলে…” চলত শেষ তিন চার দিন। এযুগে শুনে হাসি পাবে, কিন্তু তখন সত্যিই অমন হুট করে রাস্তার ধারে দোকান পাওয়া যেত না, আর পেলেও তাতে সবসময়ে সব কিছু পাওয়া যেত না। গুছিয়ে নিয়ে বেরোনো হতে বলেই হয়তো, বেড়ানোগুলো প্রত্যেকটি হত প্রায় নিরুপদ্রব, নিশ্চিন্ত – সময়টুকু পুরোটাই সেই জায়গাগুলিকে উপভোগ করায় দেওয়া যেত, নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে।
ঝক্কি? হ্যাঁ, নিশ্চয়। তবে ঐ, তিনজনে মিলেমিশে করতুম তো – আনন্দের উদযাপন ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি কখনও।
চুপিচুপি বলি, এখনও করি। তিতির, তিতিরের দাদুমণি, দিম্মা আর আমি মিলে করি এখন।
সে যাক, বলছিলুম আমার স্মৃতির প্রথম স্পষ্ট মনে থাকা বেড়ানোর কথা। যেই হাওড়া স্টেশনের গমগমে অ্যানাউন্সমেন্ট শোনা যেত, বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ ওঠা শুরু হয়ে যেত। ট্রেনের স্লিপার ক্লাস, জানলা ধরে ঠায় চোখ মেলে বসে থাকা। ছুটে ছুটে পালানো গাছপালা, মাঠ-পুকুর, অন্যরকম গড়নের ঘরবাড়ি, একলা পথিক, তার অন্য ধাঁচে পড়া কাপড়… এইসবই আমার বুকের মধ্যে বেশ পোক্তভাবে বসে গেছে, জানেন। যেসব বিশেষ স্থান দেখা হয়েছিল, সেইগুলো বরং আর অত মনে নেই, কিন্তু চোখ বুজলেই সেই জার্নিতে দেখা এক একটা দৃশ্য দেখতে পাই এখনও, নাম ভুলে যাওয়া কোন এক ষ্টেশন, একটা কল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে, একটা পাটকিলে নেড়ি। কন্যাকুমারিতে বিবেকানন্দ রকে যাওয়ার স্মৃতি আমার আবছা, নৌকো, জলের ছিটে, সত্যি কিনা কে জানে। কিন্তু সমুদ্রের তিন রং, পরিষ্কার দুটি দাগ দিয়ে ভাগ করে… এখনও মনে আছে সেই চরম বিস্ময়। যে ময়লা সাদা শার্ট পড়া ক্ষয়াটে চেহারার কাকুটা আমাদের পাশে পাশে হাঁটছিল, মা যার থেকে দরদস্তুর করে কিছু ঝিনুক আর তিনরকম দেখতে বালির প্যাকেট কিনেছিল… তাকে মনে রয়েছে। অথচ অত যে বিশাল আর অপরূপ কারুকার্যের মন্দির দেখলাম এত – ভীষণ পরিষ্কার ছিল চত্বরগুলো, এই কথাটা ছাড়া আর কিছুই নাই, নাই, মনে নাই।
কন্যাকুমারীতে আমরা একটা লাইটহাউসে উঠেছিলাম। সেদিনটা ছিল আমার জন্মদিন, ছয় বছরের জন্মদিন। পিঙ্ক কালারের জাম্পস্যুট পরা, লাইটহাউসের সামনে দাঁড়ানো ছবিটা দেখলে, ছবিটা তোলার কথা মনে পড়ে, কিন্তু লাইটহাউসে উঠে কী যে দেখেছিলুম, সে আর মনে নেই।
ত্রিভান্দম আর কোভালাম – এই দুটো সমুদ্রতটে প্রাণ ভরে স্নান করেছিলাম মনে আছে। রামেশ্বরমের সেই ট্রেনে সেতু পেরোনোও মনে আছে, শেষই হচ্ছিল না যেন। আর?
কে জানে। মন বড়ো আজব সঞ্চয়ী। কী যে অনায়াসে মুছে ফেলে, আবার কত কণাপ্রমাণ আনন্দ যত্নে তুলে রাখে প্যাটরা খুলে – কে বলতে পারে!
শুধু এই জানি, চিরন্তন পথিক হয়ে আসা পৃথিবীতে। চলার পথে যেটুকু রইল, তা-ই অসীম।
(পুরোনো ছবি খুঁজে পেলুম না। তাই নিজের আঁকা একটা ছবি দিলুম সঙ্গে। এসব আঁকার মধ্যে কি এই ছোটোবেলার বেড়ানোটা মিশে নেই একটুও?)