চলার পথে – ৮

চলার পথে – ৮


মধ্যপ্রদেশ -১
ছোটোবেলার বেড়ানোর গল্প মনে পড়ছে যখন, আরেকটু চলুক তাই।
দক্ষিণ ভারতের পর যে বেড়ানোটার কথা বেশ মনে দাগ কেটে আছে, সেটা হল মধ্যপ্রদেশ। দেখার জায়গা তো এ দেশে থরে থরে, প্রতি রাজ্যেই এমনকী সেই অত বছর আগেও এত বেড়ানোর জায়গা পাওয়া যেত যে এক ছুটিতে কিছুতেই পুরোটা ঘোরা সম্ভব হত না। তখন তো আর গুগল নেই, ট্রিপ-অ্যাডভাইসার নেই – একমাত্র ভরসা সেই “ভ্রমণ সঙ্গী” পেড়ে কদিন ধরে চলত হিসেব নিকেশ ঝাড়াই বাছাই। কিছুকিঞ্চিৎ বাদানুবাদও বাদ যেত না।
অবশেষে ট্যুর প্ল্যান ফাইনাল হল। টিকিট কাটাও হল সেইমতো। ব্যস, অমনি আমি বসে পড়লুম লম্বা সাদা কাগজ ছড়িয়ে – মধ্যপ্রদেশের ম্যাপ এঁকে, তাতে দেখার জায়গাগুলো মার্ক করতে হবে তো!
সব যদি লিখে রাখতুম তখন (কে জানে, রাখতুম হয়তো। মনে নেই এখন আর। রাখলেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।) হয়তো গুছিয়ে বলতে পারতুম আরও। কিন্তু সেসব নেই, আর আমি তো ভ্রমণ নিয়ে ফিচার লিখছি না যে সব খুঁটিনাটি লিখতে হবে, লিখছি নিজের মনের উপর যেটুকু ছাপ পড়েছে তার গল্প। কাজেই আমার গল্প শুরু হচ্ছে একদম সাতনা ষ্টেশন, একটা লম্বা ট্রেন জার্নির পরে। স্লিপার ক্লাসের ধরণ তখন আলাদা ছিল, তাছাড়া তখন এসিতে ট্রাভেল করা বিলাসিতা ছিল। বাড়ি থেকে আনা টিফিনকৌটো খুলে খবরের কাগজ পেতে ডিনার, তারপর বাড়ি থেকে আনা চাদর ভাঁজ করে বিছিয়ে, ফুঁ দিয়ে ফোলানো হাওয়া-বালিশ মাথায় দিয়ে রাত কাটানো। ট্রেনের দুলুনিতে ছোট্ট মেয়ে পড়ে যেতে পারে, এমন ভয় থেকেই মনে হয় আমার বরাদ্দ ছিল মাঝের বার্থ।
এইখানে আমার বাপি চিরকাল আমায় বেজায় টেনশনে ফেলে দিত।
‘কোনদিকে মাথা করে শুবি রে?’
হয়তো বললাম, ‘জানলার দিকে।‘
‘প্যাসেজের দিকে পা করবি বলছিস? কেউ যদি যেতে যেতে পা-য় সুড়সুড়ি দিয়ে যায়?’
তখন হয়তো ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, ‘না না ওদিকে মাথা করব।‘
‘যেতে যেতে কেউ যদি মাথায় গাঁট্টা মারে? কিংবা বালিশের হাওয়া খুলে দিয়ে যায়?’
অনেক মাথা খাটিয়ে ভাবতুম, কোনটা আটকানো সহজ হবে। কিন্তু একবারও মনে হত না, অচেনা লোকে খামোকা এরকম বিটকেল কাজকম্মো করবেটা কেন! এখনও, ট্রেনে রাত্রে শুতে গেলেই এসব মনে পড়ে যায় আর নিজে নিজেই খিক্‌ খিক্‌ করে হেসে ফেলি।
তবে যদ্দূর মনে পড়ছে, শেষ অবধি জানলার দিকে মাথা করেই শুতাম। ঘুম ভাঙলে কাত হয়ে একটু মুণ্ডু ঝুলিয়ে জানলা দিয়ে হু হু করে ক্ষেত জমি গাছপালা ছুটে যাওয়া দেখতে বেজায় ভালো লাগত, তাই। ট্রেনের খাবার খাওয়া হত ব্রেকফাস্টে… নাকি হকারদের থেকে… ,মনে নেই। অতক্ষণের জার্নি করতে তখন যে একটুও বোর লাগত না, এইটে বেশ মনে আছে। জানলা দিয়ে দেখা, আর গল্পের বই। মাঝে মাঝে কান খাড়া করে বড়োদের আলাপচারিতা শোনা। দিব্যি কেটে যেত সময়।
এইসব পেরিয়ে নামা হল সাতনায়। তারপর কী করে যে খাজুরাহো যাওয়া হল সে আর বিলকুল মনে নেই। খাজুরাহোও কিছুই সেভাবে মনে নেই… তবে পাথর খুদে অত কারুকার্য দেখে কেমন যেন ঝিম মেরে যাবার মতো খুব বেশি ভালো লেগেছিল, মনে আছে। বেশ ভালোমানুষ ভ্যাবলা টাইপের ছিলুম, সেসব মূর্তির তাৎপর্য কিচ্ছু বুঝিনি, বলা বাহুল্য।
সাঁচীর স্তূপ এর পর বেশ ন্যাড়া ন্যাড়া লেগেছিল। বড্ড বাহুল্যহীন গভীর ব্যাপার একটা। আমাদের শুভ্রবাস হেডমিস্ট্রেস সামনে এসে দাঁড়ালে সারা উঠোনে যেমন একটা তটস্থ পিনড্রপ সাইলেন্স হয়ে যেত, সেইরকম যেন। যদিও লোকজনে প্রচুর কথা বলছিল, অন্তত গাইডকাকু তো বটেই। এখন মনে হয় এটাই হয়তো স্থানমাহাত্ম্য, আনাড়ি মন কী করে যেন সে জায়গার ধ্যানগম্ভীর অন্তঃস্থলের সৌন্দর্য অনুভব করতে পেরেছিল। দুঃখের বিষয় চুপ করে তার সঙ্গে একাত্ম হবার চেষ্টা করার মতো বোধ তখন ছিল না – বরং ভাল্লাগছে না বলে কিছুটা ঘ্যানঘ্যান করেছিলুম।
স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে, এর পর সিধা চলে যাওয়া হয়েছিল ভূপাল। কিচ্ছু যে সেরকম মনে রাখার মতো পাইনি সেখানে, এটুকুই মনে আছে।
কিন্তু তারপর? উজ্জয়িনী, ইন্দোর, মান্ডু, জব্বলপুর। ইতিহাসে, ঐতিহ্যে, সৌন্দর্যে মাখামাখি শহর সব। সে গল্প বলব পরের পর্বে।
(তখনকার তোলা ছবি একে খুবই কম, তায় সময়ের অভিঘাতে রং ফ্যাকাশে। তাই নেট থেকে নেওয়া ছবিই রইল সঙ্গে।)

Leave a Comment