চলার পথে – ৯ (cholar-pothe-9)

মধ্যপ্রদেশ -২
ছোটোবেলায় পুজোর ছুটি ছাড়া এই লম্বা বেড়ানোগুলো হত না। অতএব সাতনা, খাজুরাহো, সাঁচী, ভূপাল পেরিয়ে যখন উজ্জয়িনী এসে পৌঁছলুম তখন আকাশে শরতের ঝলমলে নীল, পেঁজা তুলোর মত মেঘ, আর দিকে দিকে দশহরার তোড়জোড়।
উত্তর-মধ্য-পশ্চিম ভারত জুড়ে দশহরা মানেই রাম রাবণের যুদ্ধশেষের দিন, আর তার মানেই সে দিনের স্মরণে ঘটা করে রাবণবধ। সেই প্রথম জেনেছিলুম এসব, আর উজ্জয়িনীতে শিপ্রা নদীর পারে নেমে প্রথমবার দেখেছিলুম ইয়া দশাসই খাড়া দশহাত দশমুণ্ড রাবণ বদনব্যাদান করে দাঁড়িয়ে আছে বধ হবে বলে – সেই ‘টংলিং’এর ভাষায় বলতে গেলে, “বীর আর কাকে বলে”!
না, ছবিতে রামায়ণ আর উপন্দ্রকিশোরের বাইরে রামায়ণ নিয়ে কিছুই প্রায় ধারণা ছিল না তখন, কিন্তু এই আখাম্বা পেট ভর্তি বাজি ভরা গুঁফো রাবণ-পুতুল দেখে বেজায় হাসি পেয়েছিল।
তবে সে তো নদী পার হবার পরে।
শিপ্রা নদী, যার তীরে সেই কালিদাসপ্রসিদ্ধ মহাকাল মন্দির, সেইটি আমরা কেন যেন নৌকো চেপে পার হয়েছিলুম। সম্ভবত স্থানীয়দের কথাতেই। সে ভারি মজার নদী পেরোনো, নৌকো যখন মাঝপথে তখন হঠাৎ দেখা গেল পাশ দিয়ে দেহাতী লোকেরা ছপছপ করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কী করে নৌকো চলেছিল কে জানে, বিশেষ কৌশলে হয়তো।
ইন্দোরে একটা প্যালেস দেখেছিলাম। সম্ভবত রাজওয়াড়া প্যালেস। মানে আরও অনেক কিছু নিশ্চয় দেখেছিলাম, মনে নেই। তবে ইন্দোর যাওয়া হয়েছিল মূলত মাণ্ডুর জন্য।
রানী রূপমতী আর বাজবাহাদুরের গল্প হয়তো সবাই জানে। আমি কি তখনই জানতুম, নাকি পরে আনন্দমেলায় পড়ি? গুলিয়ে যাচ্ছে সেটা, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে সেই প্রথম দেখেছিলুম ভারতবর্ষের রাজকীয় নির্মাণের অমন অপরূপ নমুনা। পাথরের কাঠিন্য এবং অজস্র তোরণ ও গবাক্ষের লাবণ্য মিলিয়ে নেহাৎ অজ্ঞ মনেরও সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়ার যোগ্য সেসব। বাজবাহাদুর প্যালেস, রূপমতী মহল- কী বিচিত্র সব গড়ন,ছাপোষা বাড়ী ঘর সিঁড়ি দেখে আসা চোখে অবিশ্বাস্য রকমের চওড়া সব উঠোন, প্যাসেজের পর প্যাসেজের কারিকুরি, বিশাল খিলেন, উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছাত, ধাপে ধাপে সিঁড়ি জলে নেমে যাওয়া। হিন্দোল মহলের বিস্ময় এখনও মনে আছে, পুরোটা এমন বিচিত্র সব অ্যাঙ্গলে হেলানো সব দেওয়াল দিয়ে তৈরি যে মনে হয় পুরো মহলটাই যেন হাওয়ায় দুলছে।
(এ ছবিগুলো নেট থেকেই দিলাম)

রানী রূপমতী প্যাভিলিয়ন

বাজবাহাদুর প্যালেস

হিন্দোল মহল
এইরকম প্রাচীন স্থাপত্যের পাথরের বুকে ইতিহাস ধরা থাকে। মনে হয় মালোয়া রাজ্যের সুলতান বাজবাহাদুর, যুদ্ধে হেরে পালিয়ে গেলেই বা! দ্যাখ না দ্যাখ এই তো তিনি মুঘল সৈন্যকে তাড়ানোর জন্য নতুন সেনা জড়ো করে ফিরে আসবেন, আর তাঁর প্রেয়সী রানী রূপমতী আসলে মুঘলরা পৌঁছোণোর আগেই বিষ খেয়ে প্রাণত্যাগ করেননি, আসলে এখনও সুলতানের ফেরার অপেক্ষায় আছেন তাঁর মহলে; নর্মদার দিক থেকে ভেসে আসা বাতাসে এখনও ফিসফিস করে বেড়াচ্ছে তাঁদের দুজনের অসংখ্য কাব্যগুঞ্জন।
এত স্পষ্ট করে হয়তো সে বয়সে বুঝিনি। হয়তো পরে প্রাপ্ত ইতিহাসের জ্ঞান নতুন করে মনে রেখে যাওয়া ছবিটিকে রাঙিয়ে নিয়েছে এখন। শুধু মনে আছে, পড়ন্ত সূর্যের আলোয়, ঐ বিশাল ছাতে চুপ করে বসে থাকার অবর্ণনীয় ভালো লাগার মধ্যে অনেকটা সে বয়সে দুর্বোধ্য, অহেতুক মন কেমন করাও মিশে ছিল।
পুরো বেড়ানোয় সবচেয়ে মনে দাগ কেটেছিল জব্বলপুর। সে সবার শেষে গেছিলাম বলে, নাকি সবচেয়ে বেশি দিন থাকা হয়েছিল বলে, নাকি জায়গাটাই বেজায় সুন্দর বলে – কে জানে!
ধুয়াধার ফলস দেখতে যাওয়া হয়েছিল লোকাল একটা সিক্স সীটার গোছের কিছুতে চড়ে। নামেই সিক্স, গাদাগাদি ভিড়। সব টুরিস্ট স্পটেই যেমন থাকে, তেমনি অনেক কুচো দোকান ছিল ধারে ধারে। খাবার দাবার, খেলনাপাতি। পাথুরে জায়গা। জল। সাদা ফেনা।
তার চেয়েও ঢের বেশি পাথুরে জায়গা, জল, ঢেউ ছিল ভেরাঘাটে, মার্বল রকে। আর জল ঘিরে ছিল সাদা মার্বল পাথরের দেওয়াল। মলিন, হাতির দাঁতের মতো সাদা পাথর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছিল কী শান্ত, কী সুন্দর। অথচ, জলে চোরা টান আছে, ঘূর্ণি আছে, ঠিকভাবে নৌকো না চালাতে পারলে বিপদের আশঙ্কাও আছে – এমন কথাও বলাবলি করছিল লোকে।
নৌকো?
না, শৌখিন নৌকাবিহার হয় না ওই জলে। অন্তত তখন হত না। কিন্তু দুর্গাপুজোর পর প্রতিমা ভাসান দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, নৌকোয় করে নিয়ে গিয়ে।
এসব চলতি কথা কানে এসেছিল সন্ধ্যার পর। দিনের বেলায় মার্বল রক দেখে সুন্দর লেগেছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পর যখন আকাশে চাঁদ উঠেছে? গুটিকয় ট্যুরিস্ট ছাড়া কেউ নেই আর আশপাশে চত্বরে – ধু ধু খোলা পাথুরে উঁচুনিচু চত্বর, ঝুপসি বেঁটে বেঁটে গাছ, চোখের সামনে লুকোনো মরণফাঁদ নিয়ে হ্রদের নীল জল, আর তার তিনদিকে জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া আলোমাখা সাদা রঙের উঁচু দেওয়াল। দিনের বেলায় দেখা মলিন ভাব ঘুচে গেছে, চাঁদের আলো যেন বা কোন জাদুকাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে তার গায়ে – অদৃশ্য পর্দা গুটিয়ে ফেলে বেরিয়ে পড়েছে পরীপ্রাসাদের দেওয়াল। ওখানে মানুষ যেতে পারে না, ও জলে মকরের মতো অলীক জীবেরা ঘুরে বেড়ায়।
চেয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লেগে যায়।

কখনও সুযোগ পেলে, আরেকটিবার যাব।
এখানেও দোকানপাট ছিল। খেলনার দোকানও। তখন তো আর প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরু হয়নি, জায়গায় জায়গায় যা পাওয়া যেত তার মধ্যে বেশ একটা স্থানীয় বৈশিষ্ট্য থাকত। পুরীর কাঠের খেলনা, দক্ষিন ভারতে ঝিনুকের কারুকার্য করা কত কিছু… সেইরকম এখানে ছিল মার্বলের জিনিসপত্র।
সাধারণত আমার খেলনার খুব একটা শখ ছিল না। কিন্তু এখানের মার্বেলের নানান রকম কুট্টি কুট্টি থালা বাটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলুম। বেজায় লোভ লাগছে, মনে হচ্ছে সব নিয়ে নিই – শেষে অনেক ভেবে একটা এইটুকুনি চাকি বেলুন আর একটা তদ্রূপ শিল নোড়া নেওয়া হল। এই দুটো আমার খেলনার বাক্সে তখন অবধি পিতল টিন কাঠ মিলিয়ে যা যা ছিল তার মধ্যে মিসিং ছিল। কী ছোটো, আমার এখন হাতের তালুতে এঁটে যাবে, কী নিখুঁত নকশা করা ওর মধ্যেই, কী মসৃণ! দোকানদার আবার বলল সত্যি সত্যি রুটি বেলা যাবে, মশলা পেষা যাবে ওতে। সঙ্গে ছবি দিলুম, স্কেচপেনটা সাইজ বোঝাতে।

তবে মোটেই আমি সত্যি সত্যি করিনি তা। রুটি যদি বা বেলতুম, প্রাণে ধরে ঐ শিলে আর মশলা বাটা পারিনি সত্যি করে। বা রে! অমন নরম সাদা রঙে হলুদ কি আদা কি পিছনের বাগানের বুনোঘাস বাটলে ছোপ ধরে যাবে না?
সে কি হতে দেওয়া যায়? ওগুলো যে সেই পরীপ্রাসাদের টুকরো। কেউ বলে না দিলেও আমি জানতুম, আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি, তখন পরীরা এসে চাকির উপর গোল হয়ে বসে রুমালচোর আর শিলের খোপগুলোতে এক্কা দোক্কা খেলে! কতবার ভেবেছি জেগে থেকে দেখব, ধরে ফেলব ঠিক কোনও এক রাত্রে – কক্ষনো হয়নি।
এখনো হয়তো করে। আজকাল বয়স বেড়েছে, অত গাঢ় ঘুম হয় না আর। ঠিক ধরে ফেলব এবার একদিন, দেখবেন!