মা – অনুষ্টুপ শেঠ
মা
—–
– অনুষ্টুপ শেঠ
পড়তে বসতে হবে। বেলা হয়ে যাচ্ছে। সকালের পড়াটা খুব ভালবেসে করে মিতু। সকালে পড়ায় মন বসে চটপট।
তবে আজ মনটা খুব অস্থির। ঘুম ভেঙে উঠেই দেখেছে আকাশ প্রচণ্ড মেঘলা। যেকোন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। এমন আকাশ দেখলেই মিতুর মন অস্থির হয়, বুকের মধ্যে চাপ বেঁধে থাকে মন খারাপ। মায়ের অসুখটা এমন এক দিনেই শুরু হয়েছিল।
মা সেরে উঠলে ওকে আর এতদিন ধরে হোস্টেলে পড়ে থাকতে হবে না। কবে যে সারবে। শেষ যেদিন দেখতে গেছিল, তখন মা পুরোপুরি বিছানায় শোয়া। মিতুকে দেখতেও পায়নি মনে হল। চেয়ে থাকতে থাকতে মিতু দেখল চোখ থেকে জলের ধারা নিঃশব্দে নেমে আসছে মায়ের গাল বেয়ে। কাঁদছিল মা শুয়ে শুয়ে। খুব কষ্ট হয়েছিল মিতুর। কিছুই না বলে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। মাঝে মাঝেই ছুটে যেতে ইচ্ছে করে মায়ের বিছানার পাশে। কিন্তু মা তো আর নেই এখন এখানে…
হোস্টেলটা সকাল থেকে গমগম করছে ছেলেদের কথা হাসি চেঁচামেচিতে। শিমূলগঞ্জ বোর্ডিং হাই স্কুলের নামডাক আছে। ওদের ভিতরপাড়া গ্রামের কাছাকাছির মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভাল স্কুল বহুকাল ধরে। বাবা তাই মিতুকে এখানেই ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। ছুটিছাটায় এসে নিয়ে যেত বাড়ি। সে কদিন মায়ের আদরে আদরে মাখামাখি হয়ে ফিরত মিতু। একমাত্র সন্তান বলে কথা!
নীচে ব্রেকফাস্টের বেল বাজল। হুড়মুড় করে সবাই এখন ডাইনিং হলে গিয়ে ভীড় করবে। বেশী ভীড় ওর ভাল লাগে না। পায়ে পায়ে ছাত থেকে নেমে আসে মিতু, মানে ক্লাস সিক্স সেকশন বির অমিত সাহা। ভুগোলের চ্যাপ্টারটা কাল রাতে পড়ে শেষ করতে পারেনি, বইখাতা টেনে নিয়ে স্টাডিরুমের টেবিলে গিয়ে বসে। বাইরে বৃষ্টি নেমে গেছে ঝেঁপে।
না, বন্ধুবান্ধব ওর কোনকালেই নেই। লাজুক মুখচোরা ছেলে। দলে মিশতে পারে না। হোস্টেলে এদ্দিন থেকেও সে স্বভাব পালটায়নি। ছেলেগুলোও তেমনি, কোনদিন ওকে ডেকে দলে সামিল করেনা। প্রথম প্রথম চেষ্টা করত, তারপর ছেড়ে দিয়েছে। স্যারেরাও ক্লাসে ওকে পাত্তা দেন না।
তাতে অবশ্য পড়ার ইচ্ছা বা মনোযোগ কিছুই কমেনি মিতুর। শুধু এক এক সময়ে মনটা এমন করতে থাকে, আজ যেমন করছে। তবে আজকে মায়ের কথা এতবার মনে হবার কারণটাও বুঝতে পেরেছে সে। আজ শেষ দিন, কাল থেকে পুজোর ছুটি পড়ে যাবে। কাল বিকেলের মধ্যেই সবাই ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে যে যার বাড়ি চলে যাবে। বিরাট বাড়িটায় থাকবে শুধু দারোয়ান মঘাইকাকা, তার পোষা নেড়ি কুকুরটা, আর মিতু। মঘাইকাকা স্কুলের ছেলেদের একদম পছন্দ করে না, তাই মিতুর দিকে ফিরেও দেখে না, কিন্তু কুকুরটা ওকে দেখলেই উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ায়।
মায়ের অসুখ হয়ে অবধি মিতুর বাড়ি গিয়ে থাকা ঘুচে গেছে। বাবা কোন দিনই খুব একটা আদর করেনি ওকে। মা করত। বুকে জড়িয়ে নিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। গায়ে হাত বুলিয়ে দেবার সময়ে মায়ের হাতে মৃদু হলুদের গন্ধ পেত মিতু। কখনো কখনো ঝাঁঝালো সর্ষের তেলের গন্ধও। চোখ বুজে সেই গন্ধটা এখন যেন আবার পেল মিতু। মা যেন কাজরী মাছ ভাজছে ওর জন্য…
চোখ খুলতে মনে হল যেন মা এতক্ষণ সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সেদিনের মত তাকিয়ে ছিল, সেই ছেলেটাকে যেমন দেখছিল বিহ্বল হয়ে।
কেন যে হল অসুখটা! দিনটা স্পষ্ট মনে আছে মিতুর। এরকম তুমুল বৃষ্টি সকাল থেকে। স্কুল থেকে বেরিয়ে ছেলেরা দেখল, চারদিক জলে থই থই।
সেই ছেলেটা ছাতা নিয়েও ভিজে যাচ্ছিল একদম। তাই হোস্টেলে যাবার জন্য, সামনের ক্লাস টেনের গ্রুপটার দেখাদেখি মাঠ পেরিয়ে শর্টকাট করতে গেছিল। তবে বড় ছেলেগুলো জানত মাঠের কোনদিকটায় গর্তটা আছে। এই ছেলেটা জানত না।
আচমকা ডুবে যাওয়া, সাঁতার না জানা, আতঙ্ক। বলতে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই টেনে তোলা হয়েছিল, সামনের ছেলেগুলোই টের পাওয়ামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে ওটা আর ছেলে নয়, একটা বডি মাত্র।
ছেলেরা আর তাদের অভিভাবকদের ভীড়ের মধ্যে, মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মিতুও দেখেছিল সেই নিথর চোখের দৃষ্টি।
ব্যাস। মা অসুস্থ হল। বাবা আর ওকে নিতে এল না। মাস দুই পর লুকিয়ে লুকিয়ে চুপি চুপি মাকে দেখতে গিয়ে শুনল বাবা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে, মামাবাড়ির কাছে হাওড়ায় চলে যাবে, এখানে নাকি মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে না ঠিকমত।
সেই থেকে মিতুর একমাত্র ঠিকানা এই হোস্টেল। স্কুলে গিয়ে ক্লাসে বসা, স্টাডি রুমে পড়াশুনো করা আর ছাতে ঘুরে ঘুরে মায়ের কথা ভাবা, এটুকুই। ও জানে, মা যদি বাবার ওকে দেখতে না আসার, বাড়ি নিয়ে না যাবার কথা একবারও জানতে পারত, তো ঠিক চলে আসত ওকে নিতে। অসুস্থ শরীর নিয়েই যে করে হোক আসত। খুব ভালবাসত যে মিতুকে। খুব!
কতকাল হয়ে গেল মাকে দেখেনি। কত যেন?
কড় গুনে হিসেব করল মিতু।
হ্যাঁ, আজকের তারিখে ঠিক বত্রিশ বছর হল বটে।
————
Tanusree Bhattacharya
December 28, 2021 - 10:17 am ·ভালো লাগলো গল্পটা
admin
January 16, 2022 - 7:10 am ·অনেক ধন্যবাদ।